"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অপর্ণার সাথে শুভর রিলেশনটা তখন ব্রেকআপ হয়ে গেছে। মানসিকভাবে শুভ তখন ভেঙে পড়েছে। শুভ অনেক ভালোবাসতো অপর্ণাকে। কিন্তু মেয়েটার ফেমিলি থেকে যখনই বিয়ের জন্য চাপ আসে মেয়েটি তখনই রাজি হয়ে যায়। শুভ অনেক অনুনয় করেছিল তখন কিন্তু মেয়েটি কোন কথই শুনে নাই।
সে তার পরিবারের প্রস্তাবেই অনড় ছিলো।
ধানমন্ডি ৩২ এর পার্কে সেদিন বসেছিলো শুভ। মাথাটায় প্রচন্ড পেইন ফিল হচ্ছিলো। বিকেলের রোদ তখনও পড়েনি। কিছুদিনের অনিদ্রা ছিলো তার চোখে।
চোখ মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছিলো। দুহাতে মাথা চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে ।
ভাইজান মালা নিবেন, মালা?
মাথা তুলে তাকায় শুভ। ওর সামনে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। কালো গায়ের রং এর পরিচ্ছন্ন একটা ছোট মেয়ে।
বয়স হবে আট কি দশ বছর। পড়নে ছোট একটা ফ্রগ যার সামনে দুই স্থানে তালি দেয়া আর কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। হাতে কতগুলি বকুল ফুলের মালা। ফুলের মালা দেখে শুভর মাথার ব্যাথাটা হয়তো আরেকটু উস্কে উঠলো।
অই এখানে কি চাস? যা সামনে থেকে।
ফাজিল পোলাপান কোথাকার।
মেয়াটা নিরব চলে গেলো। আবার মাথা চেপে নিচে তাকালো শুভ। ওর কানে শুধু বাজছে মেয়েটার কথা, "ভাইজান মালা নিবেন?" মেয়েটাকে ধমক দেয়া হয়তো ঠিক হয়নি। ছোট মেয়েটা তো মালা বিক্রি করতে এসেছিল, ও তো আর জানতোনা শুভ ডিপ্রেশন এ আছে।
শুভ মাথা তুলে। দেখে মেয়েটা কিছু দূরে দাড়িয়ে কৈতহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুভ মুখটা হাসি হাসি করে হাত দিয়ে ইশারায় মেয়েটাকে ডাকলো।
ফুল বেচস?
জি ভাইজান
কি ফুলের মালা এইটা?
বকুল ফুল
নাম কি তোর?
কাকলী
মালা কত করে বেচস?
৫ টেকা ভাইজান
হুম, দে আমাকে দুইটা মালা দে
দশটাকা নিয়ে চলে যায় মেয়েটি। চকলেট বিক্রেতা ছেলেগুলো তাকিয়ে ছিলো।
শুভ নাড়াচাড়া করে মালাগুলো। অনেকদিন বকুল ফুলের ঘ্রান নেয়া হয়নি। গত ফাল্গুনে অপর্ণার জন্য মালা কিনা হয়েছিল। অবশ্য সেটা বকুল ফুল ছিল না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।
পার্কবেন্ঞে মালা দুটি রেখে উঠে পরে শুভ। রাতে অনিকের ছাদে পার্টি আছে। ছোটখাট একটা গানের আসর বসবে। আজ সারারাত সেখানেই থাকবে শুভ। কিছুদূর যাওয়ার পরে কেন যেন আবার পিছু ফিরে আসে শুভ।
মালাদুটো বেন্ঞথেকে তুলে পকেটে নিয়ে হাটা শুরু করে।
এর পরে প্রতিদিনই শুভ যখন ৩২ নম্বরে যেয়ে বসতো কাকলী পাশে এসে দাড়িয়ে থাকতো। শুভ যখন দুইটা মালা নিত তখনই চলে যেতো অন্য দিকে। মাঝে মাঝে কথা বলতো শুভ ওর সাথে। মেয়েটার বাবা নেই।
ছোট থাকতে ফেলে চলে গেছে। মা শাহবাগ ব্রিজের নিচে ছোট সৎ ভাইটাকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করে। দ্বিতীয় বাবা পঙ্গু। ঘরে বসে সারাদিন চেঁচামিচি করে। কাকলী নাইট স্কুলে যায়।
ঢাকা ভার্সিটির কিছু ছেলেমেয়ে মিলে রাতে এমন পথশিশুদের ক্লাস করায়। ফুলির মামা নাকি বড়লোক। রিক্সা চালায়। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে কাকলী মামার বাড়িতে যায়। মামার বাড়িতে টেলিভিশন আছে।
সিসিমপুর নামের একটা পাপেট শো দেখতে নাকি কাকলীর খুব ভালো লাগে।
কথার পরে কথা সাজিয়ে গল্প বানিয়ে ফেলতে পারতো কাকলী। আর দশটাকার বকুল ফুলের মালার বিনিময়ে বোনাস গল্প শুনতে খারাপও লাগতো না শুভর। একটা লোকাল নিউজপেপারে লেখালেখি করতো শুভ। কাকলীকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে বলে ঠিক করেছে ও।
প্রতিদিনের একটা বান্ধা কাস্টমার পেয়ে কাকলীও দারুন খুশি। আর গল্প বলা তো ওর বাঁ হাতের খেলা মাত্র। বিকেলে কাকলীর গল্প শুনলে মন হালকা লাগতো শুভর। মাঝে মাঝে শুভ কাকলীর জন্য নানা জিনিস কিনে নিয়ে খেতে বলতো। এভাবেই অনেকটা দিন অতিবাহিত হয়ে যায়।
এরই মাঝে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী হয় শুভর। দিনে দিনে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ছুটির দিনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর বাকিদিন অফিস করেই দিন পার। এরই মাঝে আনুস্কা নামের একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ে শুভ। আনুস্কাই শুভকে অফার করেছিলো।
শুভও না করতে পারেনি। নিজের জীবন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে শুভ।
অনেকদিন পরে শুভ একদিন আনুস্কাকে নিয়ে সংকরের শর্মা হাউজে লাঞ্চে বসেছে। আনুস্কার খোপায় বকুল ফুলের মালা দেখে চমকে উঠে শুভ। ৩২ নম্বরের সেই হতাশার দিন আর সেদিনের সাথী ছোট্ট কাকলীর কথা।
উঠে দাড়ায় শুভ। আনুস্কাকে বলে চলো আজ তোমাকে নতুন একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। তরিঘরি করে নিচে নামে শুভ। আনুস্কা কিছুটা অবাক হয়। রিক্সায় রাতুল কাকলীর কথা খুলে বলে আনুস্কা কে।
৩২ নম্বরের পশ্চিম গেটে রিক্সা থামায়। শুভ দ্রুতপায়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সেই পার্কবেঞ্চের আশেপাশে কাকলীকে খুঁজতে থাকে। কাছেই কয়েকটা টোকাই ছেলে মল্লযুদ্ধ খেলছিলো।
ঐ তোরা কাকলীকে চিনস?
ছেলেগুলা অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে চাইতে লাগলো।
একটা ছোট ছেলে এগিয়ে আসে তখন,
ক্যারে খুঁজেন? ফুলআলি কাকলী?
হুম, কই কাকলী?
কাকলী তো মইরা গেছে!!!
থ হয়ে দাড়িয়ে থাকে শুভ। ঝিগাতলার সিগন্যাল এ ফুল বিক্রি করতে যেয়ে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কাকলী মারা গেছে। শুভর বিশ্বাস হচ্ছিল না। বার বার কানে ভেসে আসছিলো কাকলীর কথা, কাকলীর বানিয়ে বানিয়ে বলা অর্থহীন গল্পগুলো। কাকলী কি তাহলে আর কোনদিন ফুল নিয়ে পাশে এসে নিরব দাড়িয়ে থাকবে না? কাকলী তাহলে একেবারেই ফুলের দেশে চলে গেলো? শুভ শুনতে পাচ্ছিলো পাশ থেকে কে যেন বলে যাচ্ছে, "ভাইজান গল্প হুনবেন, আমার যে মামার কথা কইছিলাম না?হের শ্বশুর আছিলো পালোয়ান।
কেউ ডরে হেইবেডার লগে জোলাইতে যাইতো না......। "
চোখ ছল ছল করে উঠে। আনুস্কা বুঝতে পেরে হাত চেপে ধরে শুভর। শুভ আনুস্কার দিকে তাকাতে পারছিলো না যদি চোখের জল গড়িয়ে পরে। তারপর কিছুক্ষনের নিরবতা।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। দুজন চলে যেতে থাকে। শুভর কেমন যেন মনে হচ্ছিলো পিছন থেকে অতিপরিচিত একটি কন্ঠস্বর বলছে,"ভাইজান মালা নিবেন,মালা?"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।