আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস এবং অপরাধ থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি

শাহরিয়ার কবির-- (জনকনট---২০/০৫/২০১১ )----- (গত বুধবারের পর) ১৯৯০ হতে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে। গ্রামীণ ব্যাংকের যাবতীয় প্রিন্টিং ও পাবলিকেশন কার্যাদি প্যাকেজেস কর্পোরেশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। উলেস্নখ্য, গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী ২ লাখ টাকার অধিক প্রিন্টিং/স্টেশনারি ক্রয়ে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করার বিধান রয়েছে। তথাপিও, উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়াই প্যাকেজেস কর্পোরেশন হতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রিন্টিং/স্টেশনারি ক্রয় করা হয়। 'গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের ওপর জানুয়ারি, ১৯৯৪-এ দাতাদের চূড়ানত্ম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ঝঃঁফরবং, ওহহড়াধঃরড়হ, উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ ঊীঢ়বৎরসবহঃধঃরড়হ (ঝওউঊ) চৎড়লবপঃ অব্যাহত রাখা এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান প্যাকেজেস কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠানটিকে ঝওউঊ কার্যক্রমের আওতায় ঋণ প্রদান করার ব্যাপারে আপত্তি প্রদান করা হয়।

এতদসত্ত্বেও ঝওউঊ তহবিল হতে প্যাকেজেস কর্পোরেশনকে ঋণ সুবিধা প্রদান অব্যাহত রাখা হয়। ' রিভিউ কমিটি আমাদের এই তথ্যটি জানাতে পারেনি_এ পর্যনত্ম ড. ইউনূসের উক্ত পারিবারিক ছাপাখানাকে গ্রামীণ ব্যাংক কত টাকার কাজ দিয়েছে এবং বাজারদরের চেয়ে কত গুণ বেশি দরে এসব কাজ প্যাকেজেস পেয়েছে। আমাদের জানা মতে, গ্রামীণ ব্যাংক এ পর্যনত্ম প্যাকেজেসকে প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাজ দিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজারদরের চেয়ে ৪০-৫০% বেশি দরে এবং তারপরও এই লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি ড. ইউনূসের কল্যাণে ঋণ মওকুফের সুবিধা পেয়েছে, যা গ্রামীণ ব্যাংকের আসল 'মালিক' (!) গ্রামের হতদরিদ্র ঋণগ্রহীতারা কস্মিনকালেও পাননি। নয় নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস পশ্চিমের দেশগুলোতে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বেচার ব্যবসা আরম্ভ করেছেন গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। স্যাম্পল হিসেবে প্রথমবার বেছে নিয়েছিলেন তারই জেলার জোবরা গ্রামের হতদরিদ্র মানুষদের।

একজন ভাল বিক্রেতাকে কথা বলার আর্ট জানতে হয়। বাচনশিল্পে ড. ইউনূসের পারদির্শতার প্রশংসা তাঁর কড়া সমালোচকদের মুখেও শুনেছি। তাঁর লেখার হাতও চমৎকার। ইউনূসের বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত গ্রন্থ 'গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন। ' এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছেন ইংল্যান্ডের যুবরাজ চার্লস।

ভূমিকায় ড. ইউনূস আমাদের তালিকাসহ জানিয়েছেন তাঁর এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থ বিশ্বের ১৪টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এই ভূমিকা জানুয়ারি ২০০৪-এর। আশা করি তার নোবেল বিজয়ের পর আরও অনেক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। আত্মজীবনী যে কত রোমাঞ্চকর, নাটকীয় এবং উত্তেজনায় ভরপুর হতে পারে 'গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন' তার উজ্জ্বল উদাহরণ। কাজী আনোয়ার হোসেনের 'মাসুদ রানা' সিরিজের মতো ড. ইউনূসের এই গ্রন্থ একবার পড়া শুরম্ন করলে শেষ না করে থামা যাবে না।

ড. ফখরম্নদ্দীন আহমেদ সামাজিক ব্যবসার জন্য ইউনূসকে আরেকটি নোবেল পুরস্কার দেয়ার কথা বলেছেন। এ বইটি তার পড়া থাকলে ইউনূসকে সাহিত্যে তৃতীয় নোবেল পুরস্কারের জন্য তদ্বির অনায়াসে তিনি করতে পারেন। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম 'জোবরা গ্রাম', উপশিরোনাম 'পাঠ্যপুসত্মক থেকে বাসত্মবে। ' কাহিনী আরম্ভ হয়েছে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের মর্মস্পশর্ী বর্ণনার মাধ্যমে। ড. ইউনূস তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।

দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি কিভাবে তাঁর সহ অধ্যাপক লতিফী ও ছাত্র দীপালচন্দ্র বড়ুয়াকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশর্্ববতর্ী জোবরা গ্রামে গেলেন, কীভাবে এক হতদরিদ্র নারী সুফিয়া বেগমের সন্ধান পেলেন এবং কিভাবে ম্যাজিকের মতো দারিদ্র্যের কারণ আবিষ্কার করে ফেললেন তার বিবরণ অত্যনত্ম চিত্তাকর্ষক ও নাটকীয় ভঙ্গিতে এই কাহিনীতে বিধৃত হয়েছে। সুফিয়াদের দারিদ্র্যের কারণ আবিষ্কার করা খুব সহজ কাজ ছিল না। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে এই আবিষ্কারের জন্য কখনও নোবেল বিজয়ী ফরাসী লেখক ফ্রান্য কাফকার 'মেটামরফসিস' গল্পের মতো নিজেকে 'কীট' হিসেবে কল্পনা করতে হয়েছে, কখনও নিজেকে ভাবতে হয়েছে 'হাড়চিবোনো কুকুর। ' এত সব কল্পনা-ভাবনার পর তিনি আবিষ্কার করেছেন জোবরা গ্রামে সুফিয়ার মতো দরিদ্রলাঞ্ছিত বেয়ালিস্নশ জন মানুষকে সর্বমোট ৮৫৬ টাকা যদি তিনি ধার দেন তাহলেই তাদের দারিদ্র্য মোচন হবে। ইউনূস লিখেছেন, 'দারিদ্র্য এমনই এক সামাজিক অবস্থা যা একটি দুটি নয়, সমসত্ম মানবিক অধিকারকে নস্যাত করে দেয়।

একজন দরিদ্র মানুষের জানার কোনও অধিকারই নেই সরকার কোন কাগজে সই করছেন বা কোন আমলা তার জাবেদা খাতায় কী লিখছেন। 'সুফিয়ার দৃষ্টি দিয়ে আমি সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম। নিজেকে একটি কীট হিসেবে কল্পনা করলাম আমি এবং আমার সামনে দাঁড়ানো বিপুল বাধা অতিক্রম করার পথ খুঁজলাম। একজন কিভাবে বাঁশ কেনার খরচ জোগাড় করবে? এই বাধা অতিক্রম করার জন্য যে-কোনও পন্থায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। 'সুফিয়ার সমস্যার কোনও সমাধান আমার জানা ছিল না।

তাঁর কেন এত দুর্ভোগ তা আমি সহজভাবে বুঝতে চেষ্টা করলাম। তিনি কষ্ট পাচ্ছেন কারণ বাঁশের দাম পাঁচ টাকা এবং তাঁর প্রয়োজনীয় নগদ টাকা নেই। তাঁর যন্ত্রণাময় জীবন একটা কঠিন চক্রের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে মহাজনের কাছে ধার নেওয়া ও তাকেই হাতের কাজ বিক্রি করা। এই চক্র থেকে তিনি কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছেন না। এইভাবে ভাবলে সমাধান বার করা খুবই সহজ।

আমাকে শুধু তাঁকে পাঁচ টাকা ধার দিতে হবে। 'এখনও পর্যনত্ম তাঁর পরিশ্রম এক কথায় পারিশ্রমিকহীন। সোজা ভাষায় তিনি বেগার শ্রমিক বা ক্রীতদাস মাত্র। ব্যবসাদার বা মহাজন সবসময় চেষ্টা করছে কাঁচামালের দামের সঙ্গে যৎসামান্য পারিশ্রমিক সুফিয়াকে দিতে যাতে তিনি শুধুমাত্র মৃতু্যকে রম্নখতে পারবেন। কিন্তু আজীবন ধার তাঁকে করে যেতেই হবে।

'আমি বিবেচনা করতে শুরম্ন করলাম সুফিয়া যদি কাজ শুরম্ন করবার জন্য মাত্র পাঁচ টাকা হাতে না পায় তো বেগার শ্রমিক হিসেবে তাঁর ভূমিকা কোনওদিনই পালটাবে না। ঋণই একমাত্র তাঁর সেই টাকা পাবার রাসত্মা। তাহলে খোলা বাজারে তাঁর তৈরি মাল বিক্রি করতে কোনও বাধা থাকবে না। কাঁচামাল ও প্রাপ্ত দামের মধ্যে গ্রহণযোগ্য লাভও থাকবে। 'পরের দিন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মাইমুনাকে ডেকে পাঠালাম।

ও আমার জরিপ কাজের জন্য তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করেছিল। জোবরা গ্রামে সুফিয়ার মতো এরকম কত জন মানুষ মহাজনের কাছে ধার নিতে বাধ্য হচ্ছে তার একটা তালিকা প্রস্তুত করতে বললাম মাইমুনাকে। 'এক সপ্তাহের মধ্যে তালিকা তৈরি হল। বিয়ালিস্নশ জন মানুষের নাম পাওয়া গেল যাঁরা মোট ৮৫৬ টাকা ধার করেছেন। "হায় আলস্নাহ, এতগুলো মানুষের জীবনে এত দুর্দশা মাত্র ৮৫৬ টাকার অভাবে।

" 'মাইমুনা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। দু'জনেই আমরা সেই হতভাগ্যদের চরম দুর্দশার কথা ভেবে অসম্ভব যন্ত্রণায় সত্মম্ভিত হয়ে রইলাম। 'এই সমস্যাটি ভুলে যাওয়া চলবে না। সেই বিয়ালিস্নশ জন শক্তসমর্থ, কঠোর পরিশ্রমী মানুষের সাহায্যে আসবার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। একটি কুকুর যেমন পুরো স্বাদ না পাওয়া পর্যনত্ম হাড় চিবিয়েই চলে আমিও তেমন এই সমস্যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশেস্নষণ করে চললাম।

৮৫৬ টাকা ঋণ যদি এমন ঋণ হয় যা তাদের নিজের তৈরি মাল যাকে খুশি বেচবার সুযোগ করে দেবে, তবেই তারা তাদের সম্ভাব্য উচ্চতম মূল্য পাবে। ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছে আর তাদের বিকিয়ে থাকতে হবে না। 'ঠিক করলাম তাদের আমি ৮৫৬ টাকা ধার দেব। তারা আমাকে সুবিধা অনুযায়ী তা ফেরত দেবে। 'সুফিয়ার ঋণ দরকার।

প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করার জন্য তাঁর কোনও অবলম্বন নেই। পারিবারিক কর্তব্য সাধনের জন্য, জীবিকার জন্য (মোড়া বানানো) ও চরম বিপর্যয়ের মুখে অসত্মিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তা তাঁর একানত্ম দরকার। 'দুর্ভাগ্যবশত গরিবদের ঋণদানের জন্য তখনও পর্যনত্ম কোনও প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ছিল না। চালু প্রতিষ্ঠানগুলির ভ্রানত্ম নীতির জন্য ঋণের বাজার পুরোপুরি মহাজনদের কবলিত হয়ে গেছে। এই তথাকথিত নিয়মনিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দারিদ্র্যের একমুখী বিশাল স্রোত তৈরিতে সাহায্য করেছে।

'মানুষ অপদার্থ বা অলস বলে দরিদ্র নয়। তারা সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। তারা গরিব শুধুমাত্র এইজন্য যে তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নত করার জন্য কোনও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর অসত্মিত্ব নেই। এটা একটা সাংগঠনিক সমস্যা। কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়।

'মাইমুনার হাতে ৮৫৬ টাকা দিয়ে আমি বললাম, "আমাদের তালিকার ৪২ জনকে এই টাকা ধার দিয়ে এসো, যাতে তারা মহাজনের ঋণ শোধ করতে পারে ও নিজেদের তৈরি জিনিস ভাল দামে বেচতে পারে। ' 'মাইমুনা জিজ্ঞেস করল, "কখন তারা আপনাকে টাকা ফেরত দেবে?' "যখন পারবে, কোনও তাড়া নেই। " আমি উত্তর দিলাম, "যখন তাদের তৈরি মাল বিক্রি করা সুবিধাজনক হবে, আমি তো আর মুনাফালোভী সুদের কারবারি নই। " ঘটনা এভাবে মোড় নেয়ায় মাইমুনা হতবুদ্ধি হয়ে চলে গিয়েছিল। ' ৩৫ বছর আগে অধ্যাপক ইউনূসের ছাত্রী মাইমুনা যত না হতবুদ্ধি হয়েছিল আমরা ছাপোষারা খবরের কাগজে তার সম্পদের বিবরণ পড়ে হাজারগুণ বেশি হতবুদ্ধি হয়েছি।

৮৫৬ টাকা পুঁজি লগি্ন করে নোবেলবিজয়ী ইউনূস যে দারিদ্র্য বাণিজ্য আরম্ভ করেছিলেন গত ৩৫ বছরে তার বিশাল গ্রামীণ সাম্রাজ্যের সম্পদের পরিমাণ ফুলে ফেঁপে দাঁড়িয়েছে প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি টাকা। আমরা জানি না এই হিমালয়প্রমাণ সম্পদের পর্বত নির্মাণ করতে গিয়ে কত পঁচিশ হাজার সুফিয়া, জরিমন সর্বস্বানত্ম হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, কত পঁচিশ হাজার গরিব মানুষ বাপদাদার ভিটেমাটি হারিয়ে ফেরারি হয়েছেন। তবে এটুকু জানি একবার যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়েছেন আমৃতু্য সেই ঋণের ঘানি টেনেছেন বলদের মতো ঠুলি পরে। (ক্রমশ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.