আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন

আমার অহংকারে, অহংকারী হয়ে , উষ্ণতার আগুন মেখে, পোড়াও আমাকেই : অচেনা দহনে...

মোনাজাতউদ্দিন-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে। পিতা আলিমউদ্দিন আহমদ , মাতা মতিজাননেছা। পিতা আলিমউদ্দিন ছিলেন চাকুরিজীবি। তিনি রংপুর পৌরসভার উর্ধ্ব-করণিক, রংপুর পুলিশ দপ্তরে প্রধান-করণিক এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। আলিমউদ্দিন ‘আম্বিয়া চরিত’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন।

অপ্রকাশিত ‘আধুনিক যোদ্ধা’ নামে একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও রচনা করেছিলেন। মোনাজাতউদ্দিনের পড়াশোনা শুরু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। রংপুরের কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে রাজশাহী বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজে থেকে মানবিক শাখায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কারমাইকেল কলেজে বি.এ পড়াকালীন হঠাৎ করেই পিতার মৃত্যুতে পরিবারের দায়-দায়িত্ব নিতে হয় মোনাজাতউদ্দিনকে।

তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। চাকুরি নেন নিশাতগঞ্জ সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। কিছুদিন পরে সেই চাকুরি ছেড়ে দিয়ে পিডিবি অফিসে একজন একাউনটেন্ট হিসেবে যোগ দেন । কিন্তু এই চাকুরিতে তাঁর মন বসেনি। তিনি কিছুকাল কাজ করেন রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ক্যাটালগার হিসেবে।

হাতের লেখা সুন্দরের কারণে এই কাজটি তিনি অনায়াসেই পরিছন্নভাবে করতে পারতেন। পারিবারিক কারণে বিভিন্ন স্থানে কাজ করলেও প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাশ করেন । মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ছাত্র অবস্থাতেই। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।

পরে ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। এর আগে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায়ও কাজ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রকাশ করেন ‘দৈনিক রংপুর’। শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এই পত্রিকাটি বের করার চিন্তা করেন। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা।

মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক-প্রকাশক। এর অর্থ যোগাতেন একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী। বাহ্যিকভাবে সেই ব্যবসায়ী সৎ মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন অসৎ ব্যবসায়ী। যে কারণে তাঁর সঙ্গে মোনাজাতউদ্দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটে। অবধারিতভাবেই এই পত্রিকাটির করুণ মৃত্যু হয়।

তখন ঢাকায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ । তাই বাধ্য হয়ে মোনাজাতউদ্দিনকে জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকুরি নেন। ১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। তারপর থেকে একটানা প্রায় বিশ বছর সেখানেই কাজ করেছেন । ‘সংবাদ’ই ছিল তাঁর ঠিকানা।

বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকন্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন। ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান।

স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোনাজাতউদ্দিন প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন।

কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার। রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। যদিও চারুশিল্পে তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন।

একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন । মোনাজাতউদ্দিন তাঁর কর্ম জীবনের সাধনা ও স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে রংপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক সংবর্ধণা, ১৯৮৪ সালে পান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, আলোর সন্ধানে পত্রিকা তাঁকে ১৯৮৫ সালে সংবর্ধণা দেয়, ১৯৮৬ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়া কর্তৃক সম্মাননা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপস্ পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সংবাদপত্রে প্রভূত অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার পান, রংপুর পদাতিক গোষ্ঠী তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধণা দেয় ১৯৮৮ সালে, বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে, একই সালে লেখনির মাধ্যমে প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রত্যক্ষ ও জনপ্রিয় করার দুরূহ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সমাজ ও প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা ‘কারিগর’ সম্মাননা পান, ১৯৯৫ সালে মর্যাদাশালী অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন, রংপুরের নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৯৬ সালে, ১৯৯৬ সালে তিনি লালমনিরহাট ফাউন্ডেশন ও উন্নয়ন সমিতি স্বর্ণপদক পান, ঢাকাস্থ রংপুর জেলা সমিতি তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধিত করে ১৯৯৫ সালে, ১৯৯৭ সালে পান রংপুর জেলা প্রসাশন কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধণা। ১৯৯৭ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক। খুলনায় তাঁকে রুমা স্মৃতি পদক প্রদান করা হয় ১৯৯৮ সালে।

এছাড়া ওয়াশিংটনের পদ্মার ঢেউ বাংলা সম্প্রচার কেন্দ্র সম্মননা প্রদান করা হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। তবে মোনাজাতউদ্দিন এই পুরস্কারের চাইতেও বড় পুরস্কার মনে করতেন মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধা ও ভালবাসাকে, যা তিনি অকুন্ঠই পেয়েছেন। মোনাজাতউদ্দিন নাসিমা আক্তার ইতির সাথে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মোনাজাতউদ্দিন ও নাসিমা আক্তার ইতি’র দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মাহফুজা মাহমুদ চৈতি ও হোসনাতুল ফেরদৌস দুই বোন।

দুজনেই ডাক্তার। একমাত্র ছেলে আবু ওবায়েদ জাফর সাদিক সুবর্ণ (১৯৭৪-১৯৯৭) ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় আত্মহত্যা করে। মোনাজাতউদ্দিন তাঁর সংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। এসব নিয়ে বইও হয়েছে।

পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। যা পাঠক সমাজকে মোহতায় আবিষ্ট করে রাখে এখনো। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’: ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’। এছাড়াও মাসিক মোহাম্মদি, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়। নাটকের একমাত্র প্রকাশিত বই ‘রাজা কাহিনী’।

এছাড়া তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন। *** তথ্যসূত্র: বাংলা একাডেমী প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থ- ‘মোনাজাতউদ্দিন’ , লেখক- মোহাম্মদ জয়নুদ্দিন। মোনাজাতউদ্দিন ফেসবুক পেজ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.