শাহরিয়ার কবির (জনকণঠ--১৫/০৫/২০১১ )----
তথ্য সংগ্রহকারী সাহাবুদ্দীন বলেছেন, 'একজন ঋণ নিয়েছিল গরু কেনার জন্য এবং গরু কিনে ছিল কিন্তু গরম্নটি মারা গেল কিস্তির টাকা মাফ হলো না। কর্মী টাকা আদায় করেই ছাড়ে। '
দুই যুগ আগে কৃষক ফেডারেশনের জরিপে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার যে নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি ২০০৯-এর জরিপে আমরা তার আরো নির্মম রূপ দেখেছি। দারিদ্র্য অদৃশ্য করতে গিয়ে ডঃ ইউনূস যেভাবে ক্ষুদ্রঋণের বড়ি গিলিয়ে দরিদ্র মানুষদের সাতপুরুষের ভিটেমাটি থেকে অদৃশ্য করে দিচ্ছেন তার যে বিবরণ আমরা কৃষকনেতা সাত্তার খানদের জরিপেও দেখেছি, দুই যুগ পর একই ধরনের জরিপে দেখছি ঋণগ্রহিতাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, ঋণগ্রহিতা অবিবাহিত হলে কিংবা তাঁর বিবাহযোগ্য কন্যা থাকলে তাদের যৌতুকের অঙ্ক বেড়ে যাচ্ছে, যৌথ পরিবারের স্নেহ-ভালবাসা সহমর্মিতার সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, মানুষের ভেতর ভালবাসা কমে যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, শিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার কমে যাচ্ছে, বাধ্যতামূলক শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক জায়গায় কিস্তির টাকা দিতে না পেরে হামলা, হুলিয়া বা সত্য-মিথ্যা মামলার ভয়ে হতদরিদ্র ঋণগ্রহিতারা ঘর-বাড়ি, কাজকর্ম ফেলে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কিংবা শহরের বস্তিতে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। নোবেলবিজয়ী ডঃ ইউনূস এভাবেই দরিদ্রদের ভিটেমাটি থেকে অদৃশ্য করে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাচ্ছেন।
'নিজেরা করি'র গোলটেবিল বৈঠকে ঋণদাতা এনজিওদের কয়েকজন প্রতিনিধিও ছিলেন। তারা তথ্য সংগ্রহকারীদের বক্তব্য সম্পর্কে বলেছেন, এটি মঙ্গা এলাকার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে, অন্যত্র ঋণআদায় এত অমানবিক নয়। কেউ কেউ বলেছেন, দরিদ্র ঋণগ্রহিতাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ঋণ গ্রহণের পর বিভিন্ন কারণে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আরও দরিদ্র হয়েছেন, সামগ্রিক চিত্র এর বিপরীত।
সাত
গ্রামীণ ব্যাংক ও অনান্য এনজিও যারা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত এবং ৯৮%-৯৯% ঋণ আদায়ের কৃতিত্বের দাবিদার, তারা কখনও স্বীকার করে না ঋণ আদায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোন অমানবিক কর্মকা- কিংবা জোরজবরদসত্মি জড়িত। 'নিজেরা করি'র গোলটেবিল আলোচনায় ঋণ দাতা ও ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের কোন প্রতিনিধি এই আলোচনায় অংশগ্রহণ না করলেও অন্যরা ঋণ গ্রহীতাদের জবানবন্দী ধারণকারী ও তথ্য সংগ্রহকারীদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। 'বু্যরো বাংলাদেশ'-এর প্রতিনিধি সাইদ আহমেদ খান বলেছেন, ''আমার মূল কথা হলো এনজিওরা যে শুধু ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইড করছে শুধু তাই নয়, পাশাপাশি সেবামূলক কাজ, করছে। অনেক সফলতার মধ্যে যেমন_সঞ্চয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই সঞ্চয় জমা এর ওঠানোর নিয়ম-সুযোগ আছে। আমাদের সংস্থায় আছে।
গরিব মানুষের যে সঞ্চয়, অনেক গরিব মানুষের সঞ্চয় ৩ হাজার টাকার উপরে আছে। এভাবে যে গরিব মানুষের সঞ্চয় তুলে নিয়ে কাজে লাগানোর যে সুযোগ এবং ফলাফল তা গবেষণায় আসেনি। এনজিওদের সঙ্গে যুক্ত সদস্য এবং কমর্ী তাদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গ্রামে কর্মসংস্থানের যে অভাব তার বদলে গ্রামে কর্মসংস্থানের গতিশীলতা তৈরি হয়েছে। যারা কাজের অভাবে গ্রামে বসে থাকত, অবসর কাটাত, তাস খেলত তারা কিন্তু এখন আর বসে নেই, তাদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এটা কিন্তু তাদের গবেষণায় আসেনি। এটা অর্থনীতিতে একটা বড় সুফল বয়ে এনেছে বলে আমরা মনে করি। ''
সাইদ আহমেদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তথ্য সংগ্রহকারী ভূমিহীন সদস্য নূরম্নল ইসলাম বলেছেন, ''আমি সঞ্চয়ের ব্যাপারটা বলি। ভাই বলে গেল যে সঞ্চয় উত্তোলন করা যায়। কিন্তু কই, আমাদের এলাকায় তো সঞ্চয় দেয় না।
সঞ্চয় জমা নেয় কিন্তু ফেরত যাচ্ছে না। তারা বলে ঋণ নিচ্ছেন, ঋণ নেন। আমরা সংস্থার নাম তো বলছি না। আমাদের এলাকা মঙ্গা, বন্যা, নদী ভাঙ্গাও না, আমাদের এলাকা মোটামুটি একটু ভাল আছে। আমাদের পাশর্্ববতর্ী এলাকায়ও দেখেছি একই রকম ঋণ নিয়ে জর্জরিত হচ্ছে।
ঋণ নিয়ে এনজিও বেশি হওয়াতে এ সমস্যা হচ্ছে গরিব মানুষের। আমরা তো গরিব লোক, একটার পর একটা ঋণ নিতেই হয়। কিছুদিন আগে আমাদের এলাকায় এক ভাই এসে বলল_"আমরা আপনাদের গ্রামে জরিপ করব। এখানে লোকসংখ্যা কত ইত্যাদি তথ্য নিয়ে আমরা লোন দেব। " আমি বললাম, "ভাই আমাদের গ্রামে কয়েকটি সংস্থা আছে তাদের টাকা দিতে পারছে না, আপনারা আবার দেবেন? ভাই এই এলাকা থেকে আপনারা চলে যান।
" তারপরও এক ভাই অন্য ভাইদেরসহ আরও কিছু লোকজন নিয়ে ওই সংস্থা থেকে টাকা নিয়ে এখন লোন শোধ করতে পারছে না।
তথ্য সংগ্রহকারীদের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি এফএনবির প্রতিনিধি তাজুল ইসলাম। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে_'যে এলাকাটা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেটা ব্যতিক্রমী এলাকা, মঙ্গা এলাকা। মঙ্গা এলাকা এ জন্য বলা হয় যে, কার্তিকের টান বাংলাদেশে আসে। মঙ্গা থেকে মঙ্গা।
জিনিসের দাম বেড়ে যায়। মাইক্রো ক্রেডিট কিন্তু ইজ নট ডিজাইন টু কভার দ্যা পিপল হু আর ইফেক্টেড বাই 'মঙ্গা'। মাইক্রো-ক্রেডিট অতি দরিদ্রের জন্য ডিজাইন করা হয়নি। সেটা নিয়ে একটা সমালোচনাও ছিল। সে জন্য মাইক্রো-ক্রেডিট নিয়ে দরিদ্র মানুষের আনা সম্ভব হয়নি।
অনেক পরে ২০০৩ সালের দিকে একটা সংস্থা একটা স্পেশাল প্রোগ্রাম নেয়_ "দ্যা টার্গেট ইন দ্যা আলট্রা পুওর। " সেটা ঠিক মাইক্রো-ক্রেডিট না, মাইক্রো ক্রেডিটে আলট্রা পুওরকে যার মধ্যে মঙ্গা এলাকা পড়ছে, ফরিদপুরের নদী ভাঙ্গন এলাকা পড়ছে, এ সমসত্ম এঙ্ট্রিমলি ভাল্নারেবল এরিয়া পড়বে। তাদের মাইক্রো-ক্রেডিটে আনার আগে স্পেশাল দুই বছর ক্রেডিট প্রোগ্রামের আওতায় আনা হয়। সেটা ক্রেডিট না, সেটা ফ্রি, বিনা পয়সায় সম্পত্তি এ্যাসেট ট্রান্সফার। কাউকে গরম্ন, কাউকে ২০০ মুরগি, কাউকে অন্য কিছু, কাউকে কিছু জিনিসপত্র, ছোট একটা দোকান খোলার জন্য এগুলো কেবল টার্গেট করা হয়।
... দ্বিতীয়ত যেটা বলছেন_ গরম্ন মারা যায় এটা নরমাল মাইক্রো-ক্রেডিটের প্রশ্ন যে, গরম্ন মারা যায় বা বিভিন্ন ন্যাচারাল ক্লাইমেটের জন্য ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে কিন্তু জোর করে ক্রেডিট আদায়ের নিয়ম নেই। কনভেনশন হচ্ছে ওই ক্রেডিটটা_ কিসত্মিটা তখন ফ্রিজ করে দেয়া হয়। বা ওটা এখন আপনাকে দিতে হবে না। আমরা মুছে ফেলছি না, আমরা এখন রিলিফ নিয়ে আসছি।
তারপরে নতুন লোন নেন, আসত্মে আসত্মে আবার শুরম্ন করেন, তখন কিসত্মিটা রিএরেঞ্জ করে রি-সিডিউল করে আসত্মে আসত্মে শোধ দেবেন। কারণ আমাদের দেশে এমনি এটা বড় লোকের মধ্যে বেশি আছে, ঋণ শোধ না দেয়ার কালচার। রাইট অফ করে দিলে ইট উইল জেনারেট ভেরি ব্যাড কালচার। সে জন্য এটা ডিসকারেজ করা হয়। গরম্ন মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা গরু কেনার টাকা ঠিক ওভাবে করা হয় না, ফ্রিজ করে পরে দেয়া হয়, আরেকটা নতুন লোন দেয় এটাও শোধ দিতে হবে তোমাকে।
এ রকম একটা প্রেসার; যেহেতু কোন গ্যারান্টি নেই, কোন মর্টগেজ নেই। একটা না একটা প্রেসারে তো রাখতেই হবে। '
ঋণদাতা সংস্থার নীতি নির্ধারকরা যখন ঋণ গ্রহীতাদের 'প্রেসারে' রাখার কথা বলেন এবং ৯৮%-৯৯% ঋণ আদায়ের জন্য গ্রামের কর্মচারীদের 'প্রেসারে' রাখেন তার পরিণাম কী হয় ভুক্তভোগীদের জবানবন্দী থেকে আমরা জেনেছি। কবিগুরম্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় 'বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ'। বাংলাদেশে হতদরিদ্রদের বিনা জামানতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের জনক ড. ইউনূস ৯৮%-৯৯% ঋণ আদায়ের যে লক্ষ্য ও পদ্ধতি নির্ধারণ ও প্রবর্তন করেছেন এ দেশে তাঁর অনুগামীরা একই পথ অনুসরণ করছেন।
ঋণ আদায়ের এই অমানবিক পন্থা এত লেখালেখি, সমালোচনা, নিন্দা, প্রতিবাদের পরও অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ মে (২০১১) বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম-এর একটি প্রতিবেদনের শিরোণাম হচ্ছে, 'গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ : কিসত্মি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সবিতার খাট-সোফা নিলামে বিক্রি। ' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'সময়মতো গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের কিসসিত্ম দিতে না পারায় সবিতা দেবের ঘর থেকে খাট, সোফা, ফ্যান খুলে নিয়ে তা নিলামে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বুধবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটার সময় সবিতা বাড়িতেও ছিলেন না।
'সবিতার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের বিদ্যাগ্রামে।
বৃহস্পতিবার সবিতার ছেলে উজ্জ্বল চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, তাঁর মায়ের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া একই গ্রুপের ১০-১৫ নারী সদস্য তাঁদের ঘর থেকে এসব আসবাবপত্র নিয়ে যান। এ সময় গ্রামীণ ব্যাংকের রফিক নামে এক 'কালেকশন ম্যানেজার' ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন নির্দেশ দেন।
উজ্জ্বল জানান, তাঁদের ঘর থেকে তিনটি খাট খুলে নিয়েছে প্রতিটি তিন হাজার টাকায়, এক সেট সোফা ৪ হাজার টাকা, একটি সিলিং ফ্যান দেড় হাজার টাকা এবং দু'টি চেয়ার (একটি হাতাওয়ালা ও অপরটি হাতলবিহীন) এক শ' টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়। ঋণ গ্রহীতা নারী সদস্যরাই আবার সেগুলো নিলামে কিনে নেন।
উজ্জ্বল আরও জানান, তাঁর মা গ্রামীণ ব্যাংকের কানুনগোপাড়া শাখার অধীনে ৮ নম্বর কেন্দ্রের ৪ নম্বর গ্রম্নপের সদস্য।
ব্যাংক থেকে সদস্য হিসেবে গত এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ৪০ হাজার টাকা এবং তিন মাস আগে আরও ২০ হাজার টাকাসহ মোট ৬০ হাজার টাকা ঋণ নেন। দু'টি ঋণ সমন্বয় করে সবিতার পরিশোধের জন্য সাপ্তাহিক কিসত্মি ছিল ১ হাজার ১৭০ টাকা।
উজ্জ্বল জানান, গ্রামীণ ব্যাংক এবং আরও কয়েক নারী সদস্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সবিতা চিকিৎসার জন্য এপ্রিলের মাঝামাঝি কলকাতা যান। ফলে গত দু'সপ্তাহের কিসত্মি বকেয়া পড়ে যায়। এজন্য মায়ের অনুপস্থিতিতে উজ্জ্বলকে বুধবার সকালে গ্রামীণ ব্যাংকের কানুনগোপাড়া শাখায় তলব করে নিয়ে গিয়ে কর্মকর্তা এবং গ্রুপ সদস্যরা মিলে অপমান করেন।
এক পর্যায়ে ওই নারী সদস্যরা তাঁর ঘরে গিয়ে আসবাবপত্র নিলামে বিক্রির ঘটনা ঘটান। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় কানুনগোপাড়া শাখার উপ-ব্যবস্থাপক তাপস ভট্টাচার্য। (ক্রমশ) নিয়ন্ত্রণহারাদের নিয়ন্ত্রণ না করলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস এবং অপরাধ থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি
টাস্কফোর্সের নেতা এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে তার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হলো
সাবধানবাণী: বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই সাইটের কোন উপাদান ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ এবং কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস এবং অপরাধ থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি
শাহরিয়ার কবির
(গত শুক্রবারের পর)
তথ্য সংগ্রহকারী সাহাবুদ্দীন বলেছেন, 'একজন ঋণ নিয়েছিল গরু কেনার জন্য এবং গরু কিনে ছিল কিন্তু গরম্নটি মারা গেল কিস্তির টাকা মাফ হলো না। কর্মী টাকা আদায় করেই ছাড়ে।
'
দুই যুগ আগে কৃষক ফেডারেশনের জরিপে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার যে নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি ২০০৯-এর জরিপে আমরা তার আরো নির্মম রূপ দেখেছি। দারিদ্র্য অদৃশ্য করতে গিয়ে ডঃ ইউনূস যেভাবে ক্ষুদ্রঋণের বড়ি গিলিয়ে দরিদ্র মানুষদের সাতপুরুষের ভিটেমাটি থেকে অদৃশ্য করে দিচ্ছেন তার যে বিবরণ আমরা কৃষকনেতা সাত্তার খানদের জরিপেও দেখেছি, দুই যুগ পর একই ধরনের জরিপে দেখছি ঋণগ্রহিতাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, ঋণগ্রহিতা অবিবাহিত হলে কিংবা তাঁর বিবাহযোগ্য কন্যা থাকলে তাদের যৌতুকের অঙ্ক বেড়ে যাচ্ছে, যৌথ পরিবারের স্নেহ-ভালবাসা সহমর্মিতার সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, মানুষের ভেতর ভালবাসা কমে যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, শিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার কমে যাচ্ছে, বাধ্যতামূলক শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক জায়গায় কিস্তির টাকা দিতে না পেরে হামলা, হুলিয়া বা সত্য-মিথ্যা মামলার ভয়ে হতদরিদ্র ঋণগ্রহিতারা ঘর-বাড়ি, কাজকর্ম ফেলে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কিংবা শহরের বস্তিতে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। নোবেলবিজয়ী ডঃ ইউনূস এভাবেই দরিদ্রদের ভিটেমাটি থেকে অদৃশ্য করে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাচ্ছেন।
'নিজেরা করি'র গোলটেবিল বৈঠকে ঋণদাতা এনজিওদের কয়েকজন প্রতিনিধিও ছিলেন। তারা তথ্য সংগ্রহকারীদের বক্তব্য সম্পর্কে বলেছেন, এটি মঙ্গা এলাকার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে, অন্যত্র ঋণআদায় এত অমানবিক নয়।
কেউ কেউ বলেছেন, দরিদ্র ঋণগ্রহিতাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ঋণ গ্রহণের পর বিভিন্ন কারণে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আরও দরিদ্র হয়েছেন, সামগ্রিক চিত্র এর বিপরীত।
সাত
গ্রামীণ ব্যাংক ও অনান্য এনজিও যারা ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত এবং ৯৮%-৯৯% ঋণ আদায়ের কৃতিত্বের দাবিদার, তারা কখনও স্বীকার করে না ঋণ আদায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোন অমানবিক কর্মকা- কিংবা জোরজবরদসত্মি জড়িত। 'নিজেরা করি'র গোলটেবিল আলোচনায় ঋণ দাতা ও ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের কোন প্রতিনিধি এই আলোচনায় অংশগ্রহণ না করলেও অন্যরা ঋণ গ্রহীতাদের জবানবন্দী ধারণকারী ও তথ্য সংগ্রহকারীদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। 'বু্যরো বাংলাদেশ'-এর প্রতিনিধি সাইদ আহমেদ খান বলেছেন, ''আমার মূল কথা হলো এনজিওরা যে শুধু ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইড করছে শুধু তাই নয়, পাশাপাশি সেবামূলক কাজ, করছে।
অনেক সফলতার মধ্যে যেমন_সঞ্চয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই সঞ্চয় জমা এর ওঠানোর নিয়ম-সুযোগ আছে। আমাদের সংস্থায় আছে। গরিব মানুষের যে সঞ্চয়, অনেক গরিব মানুষের সঞ্চয় ৩ হাজার টাকার উপরে আছে। এভাবে যে গরিব মানুষের সঞ্চয় তুলে নিয়ে কাজে লাগানোর যে সুযোগ এবং ফলাফল তা গবেষণায় আসেনি।
এনজিওদের সঙ্গে যুক্ত সদস্য এবং কমর্ী তাদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গ্রামে কর্মসংস্থানের যে অভাব তার বদলে গ্রামে কর্মসংস্থানের গতিশীলতা তৈরি হয়েছে। যারা কাজের অভাবে গ্রামে বসে থাকত, অবসর কাটাত, তাস খেলত তারা কিন্তু এখন আর বসে নেই, তাদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটা কিন্তু তাদের গবেষণায় আসেনি। এটা অর্থনীতিতে একটা বড় সুফল বয়ে এনেছে বলে আমরা মনে করি।
''
সাইদ আহমেদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তথ্য সংগ্রহকারী ভূমিহীন সদস্য নূরম্নল ইসলাম বলেছেন, ''আমি সঞ্চয়ের ব্যাপারটা বলি। ভাই বলে গেল যে সঞ্চয় উত্তোলন করা যায়। কিন্তু কই, আমাদের এলাকায় তো সঞ্চয় দেয় না। সঞ্চয় জমা নেয় কিন্তু ফেরত যাচ্ছে না। তারা বলে ঋণ নিচ্ছেন, ঋণ নেন।
আমরা সংস্থার নাম তো বলছি না। আমাদের এলাকা মঙ্গা, বন্যা, নদী ভাঙ্গাও না, আমাদের এলাকা মোটামুটি একটু ভাল আছে। আমাদের পাশর্্ববতর্ী এলাকায়ও দেখেছি একই রকম ঋণ নিয়ে জর্জরিত হচ্ছে। ঋণ নিয়ে এনজিও বেশি হওয়াতে এ সমস্যা হচ্ছে গরিব মানুষের। আমরা তো গরিব লোক, একটার পর একটা ঋণ নিতেই হয়।
কিছুদিন আগে আমাদের এলাকায় এক ভাই এসে বলল_"আমরা আপনাদের গ্রামে জরিপ করব। এখানে লোকসংখ্যা কত ইত্যাদি তথ্য নিয়ে আমরা লোন দেব। " আমি বললাম, "ভাই আমাদের গ্রামে কয়েকটি সংস্থা আছে তাদের টাকা দিতে পারছে না, আপনারা আবার দেবেন? ভাই এই এলাকা থেকে আপনারা চলে যান। " তারপরও এক ভাই অন্য ভাইদেরসহ আরও কিছু লোকজন নিয়ে ওই সংস্থা থেকে টাকা নিয়ে এখন লোন শোধ করতে পারছে না।
তথ্য সংগ্রহকারীদের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি এফএনবির প্রতিনিধি তাজুল ইসলাম।
তাঁর বক্তব্য হচ্ছে_'যে এলাকাটা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেটা ব্যতিক্রমী এলাকা, মঙ্গা এলাকা। মঙ্গা এলাকা এ জন্য বলা হয় যে, কার্তিকের টান বাংলাদেশে আসে। মঙ্গা থেকে মঙ্গা। জিনিসের দাম বেড়ে যায়। মাইক্রো ক্রেডিট কিন্তু ইজ নট ডিজাইন টু কভার দ্যা পিপল হু আর ইফেক্টেড বাই 'মঙ্গা'।
মাইক্রো-ক্রেডিট অতি দরিদ্রের জন্য ডিজাইন করা হয়নি। সেটা নিয়ে একটা সমালোচনাও ছিল। সে জন্য মাইক্রো-ক্রেডিট নিয়ে দরিদ্র মানুষের আনা সম্ভব হয়নি। অনেক পরে ২০০৩ সালের দিকে একটা সংস্থা একটা স্পেশাল প্রোগ্রাম নেয়_ "দ্যা টার্গেট ইন দ্যা আলট্রা পুওর। " সেটা ঠিক মাইক্রো-ক্রেডিট না, মাইক্রো ক্রেডিটে আলট্রা পুওরকে যার মধ্যে মঙ্গা এলাকা পড়ছে, ফরিদপুরের নদী ভাঙ্গন এলাকা পড়ছে, এ সমসত্ম এঙ্ট্রিমলি ভাল্নারেবল এরিয়া পড়বে।
তাদের মাইক্রো-ক্রেডিটে আনার আগে স্পেশাল দুই বছর ক্রেডিট প্রোগ্রামের আওতায় আনা হয়। সেটা ক্রেডিট না, সেটা ফ্রি, বিনা পয়সায় সম্পত্তি এ্যাসেট ট্রান্সফার। কাউকে গরম্ন, কাউকে ২০০ মুরগি, কাউকে অন্য কিছু, কাউকে কিছু জিনিসপত্র, ছোট একটা দোকান খোলার জন্য এগুলো কেবল টার্গেট করা হয়। ... দ্বিতীয়ত যেটা বলছেন_ গরম্ন মারা যায় এটা নরমাল মাইক্রো-ক্রেডিটের প্রশ্ন যে, গরম্ন মারা যায় বা বিভিন্ন ন্যাচারাল ক্লাইমেটের জন্য ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে কিন্তু জোর করে ক্রেডিট আদায়ের নিয়ম নেই।
কনভেনশন হচ্ছে ওই ক্রেডিটটা_ কিসত্মিটা তখন ফ্রিজ করে দেয়া হয়। বা ওটা এখন আপনাকে দিতে হবে না। আমরা মুছে ফেলছি না, আমরা এখন রিলিফ নিয়ে আসছি। তারপরে নতুন লোন নেন, আসত্মে আসত্মে আবার শুরম্ন করেন, তখন কিসত্মিটা রিএরেঞ্জ করে রি-সিডিউল করে আসত্মে আসত্মে শোধ দেবেন। কারণ আমাদের দেশে এমনি এটা বড় লোকের মধ্যে বেশি আছে, ঋণ শোধ না দেয়ার কালচার।
রাইট অফ করে দিলে ইট উইল জেনারেট ভেরি ব্যাড কালচার। সে জন্য এটা ডিসকারেজ করা হয়। গরম্ন মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা গরু কেনার টাকা ঠিক ওভাবে করা হয় না, ফ্রিজ করে পরে দেয়া হয়, আরেকটা নতুন লোন দেয় এটাও শোধ দিতে হবে তোমাকে। এ রকম একটা প্রেসার; যেহেতু কোন গ্যারান্টি নেই, কোন মর্টগেজ নেই। একটা না একটা প্রেসারে তো রাখতেই হবে।
'
ঋণদাতা সংস্থার নীতি নির্ধারকরা যখন ঋণ গ্রহীতাদের 'প্রেসারে' রাখার কথা বলেন এবং ৯৮%-৯৯% ঋণ আদায়ের জন্য গ্রামের কর্মচারীদের 'প্রেসারে' রাখেন তার পরিণাম কী হয় ভুক্তভোগীদের জবানবন্দী থেকে আমরা জেনেছি। কবিগুরম্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় 'বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ'। বাংলাদেশে হতদরিদ্রদের বিনা জামানতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের জনক ড. ইউনূস ৯৮%-৯৯% ঋণ আদায়ের যে লক্ষ্য ও পদ্ধতি নির্ধারণ ও প্রবর্তন করেছেন এ দেশে তাঁর অনুগামীরা একই পথ অনুসরণ করছেন। ঋণ আদায়ের এই অমানবিক পন্থা এত লেখালেখি, সমালোচনা, নিন্দা, প্রতিবাদের পরও অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ মে (২০১১) বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম-এর একটি প্রতিবেদনের শিরোণাম হচ্ছে, 'গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ : কিসত্মি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সবিতার খাট-সোফা নিলামে বিক্রি।
' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'সময়মতো গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের কিসসিত্ম দিতে না পারায় সবিতা দেবের ঘর থেকে খাট, সোফা, ফ্যান খুলে নিয়ে তা নিলামে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বুধবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটার সময় সবিতা বাড়িতেও ছিলেন না।
'সবিতার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের বিদ্যাগ্রামে। বৃহস্পতিবার সবিতার ছেলে উজ্জ্বল চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, তাঁর মায়ের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া একই গ্রুপের ১০-১৫ নারী সদস্য তাঁদের ঘর থেকে এসব আসবাবপত্র নিয়ে যান। এ সময় গ্রামীণ ব্যাংকের রফিক নামে এক 'কালেকশন ম্যানেজার' ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন নির্দেশ দেন।
উজ্জ্বল জানান, তাঁদের ঘর থেকে তিনটি খাট খুলে নিয়েছে প্রতিটি তিন হাজার টাকায়, এক সেট সোফা ৪ হাজার টাকা, একটি সিলিং ফ্যান দেড় হাজার টাকা এবং দু'টি চেয়ার (একটি হাতাওয়ালা ও অপরটি হাতলবিহীন) এক শ' টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়। ঋণ গ্রহীতা নারী সদস্যরাই আবার সেগুলো নিলামে কিনে নেন।
উজ্জ্বল আরও জানান, তাঁর মা গ্রামীণ ব্যাংকের কানুনগোপাড়া শাখার অধীনে ৮ নম্বর কেন্দ্রের ৪ নম্বর গ্রম্নপের সদস্য। ব্যাংক থেকে সদস্য হিসেবে গত এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ৪০ হাজার টাকা এবং তিন মাস আগে আরও ২০ হাজার টাকাসহ মোট ৬০ হাজার টাকা ঋণ নেন। দু'টি ঋণ সমন্বয় করে সবিতার পরিশোধের জন্য সাপ্তাহিক কিসত্মি ছিল ১ হাজার ১৭০ টাকা।
উজ্জ্বল জানান, গ্রামীণ ব্যাংক এবং আরও কয়েক নারী সদস্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সবিতা চিকিৎসার জন্য এপ্রিলের মাঝামাঝি কলকাতা যান। ফলে গত দু'সপ্তাহের কিসত্মি বকেয়া পড়ে যায়। এজন্য মায়ের অনুপস্থিতিতে উজ্জ্বলকে বুধবার সকালে গ্রামীণ ব্যাংকের কানুনগোপাড়া শাখায় তলব করে নিয়ে গিয়ে কর্মকর্তা এবং গ্রুপ সদস্যরা মিলে অপমান করেন।
এক পর্যায়ে ওই নারী সদস্যরা তাঁর ঘরে গিয়ে আসবাবপত্র নিলামে বিক্রির ঘটনা ঘটান। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় কানুনগোপাড়া শাখার উপ-ব্যবস্থাপক তাপস ভট্টাচার্য।
(ক্রমশ) নিয়ন্ত্রণহারাদের নিয়ন্ত্রণ না করলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস এবং অপরাধ থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি
টাস্কফোর্সের নেতা এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে তার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।