আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জরিমানা

A passionate writer

জরিমানা - হোসাইন আব্দুল হাই মাহমুদ সাহেব পেশায় প্রকৌশলি। জার্মানির বন এসেছেন বছর খানেক হলো। দু'মাস আগে অনেক দিনের শখ পূরণ হলো। ফোক্সভাগেন এর শো রুম থেকে লেটেস্ট মডেলের একখান ঝাঁকাস দেখে গাড়ি কিনেছেন। শখের চেয়েও বড় কথা হচ্ছে বউ এর তাড়া।

দেশ থেকে বউ নিয়ে আসার মাস খানেকের মধ্যেই সুন্দরী বউ এর মন রাখতেই এমন একখান বন্দোবস্ত করা। ঢাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন বছর পাঁচেক। এর মধ্যেই ভাগ্য দেবী কিছুটা উঁকি মেরে গেল। জার্মান সরকারের কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছরের জন্য গবেষণার কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। ভাগ্য দেবী যখন উঁকি দিয়েছেন, তখন তাকে ঘরে আসন দিতে কার্পণ্য করাটা নেহায়েত বোকামিই হবে।

তাই মাস দু'একের মধ্যেই সব কাগজপত্র তৈরি করে মধ্য ইউরোপে পাড়ি দিয়েছিলেন মাহমুদ সাহেব। আর ছয়-সাত মাস পরেই ব্যবস্থা হয়ে গেল বউকে আনার। তা আর দেরি কেন? বসন্তের এক সন্ধ্যায় বউ এসে হাজির পাপেলভেগের ছাউনিঅলা বাংলোতে। নতুন গাড়িতে করে বউকে পাশে নিয়ে বেশ অনেকগুলো মনোমুগ্ধকর জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রকৌশলি দম্পতি এই সপ্তাহান্তে। আসলে সপ্তাহান্ত মানে জার্মান সমাজে যেন এক সাপ্তাহিক উৎসব।

প্রতি শনি আর রবিবার তাই ট্রাভেল এজেন্সিগুলো যেমন আয়োজন করে হরেক রকম ট্যুর প‌্যাকেজ, তেমনি প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই থাকে নিজস্ব একেকটা মহাপরিকল্পনা সপ্তাহান্তকে ঘিরে। সাপ্তাহিক ছুটির ধারণাটি এমন যে, পাঁচদিনের একটানা কাজের শেষে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু জার্মানদের অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, তারা সপ্তাহান্তের উৎসব করতে এতটাই মনোযোগী আর ব্যস্ত থাকে যে আরো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে একটি ব্যস্ত সপ্তাহান্ত শেষ করে সোমবার নতুন সপ্তাহ শুরু করে আবারও ক্লান্ত অবস্থাতেই। অবশ্য, এতে করে পেশাগত কাজের কোন ক্ষতি হয়, তেমনটি ঠিক বলা যায় না।

কারণ তা না হলে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব হতো না। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই সোমবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার জন্য গাড়ি বের করছেন মাহমুদ সাহেব। গাড়ির পেছনে কোথাও ঘাপটি মেরে শুয়ে বিশ্রাম করছিল পড়শির কুকুর ছানা 'কেটি'। মাহমুদ সাহেবের তা চোখে পড়েনি। স্টিয়ারিং হুইল ডানে ঘুরিয়ে একটু পেছনে সরিয়েছেন ছোট্ট ফোক্সভাগেনটি।

হঠাৎ পেছন থেকে একটি কুকুর ছানার আর্ত চিৎকার কানে আসল মাহমুদ সাহেবের। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ হয়ে গেছে। আহত হয়েছে কেটি। মাহমুদ সাহেব তৎক্ষণাৎ গাড়ি থেকে নেমে আসলেন। কেটির অবস্থা ভালো করে দেখলেন।

তবে আঘাত তেমন একটা গুরুতর বলে মনে হলো না। একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটা শুরু করল কেটি। মনিবের বাসায় পৌঁছতে সময় নিল ঠিক সাত মিনিট। মাহমুদ সাহেব আরো পাঁচ মিনিট ধরে তাকিয়ে থাকলেন কেটির যাত্রাপথে। কেটি চোখের আড়াল হয়ে গেছে ততক্ষণে।

তবুও যেন থ' হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাহমুদ সাহেব কিছুক্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাদিনই কাটল কেটির কথা ভেবে ভেবে। বিকেল পাঁচটায় রওয়ানা দিলেন বাসার উদ্দেশ্যে। বাসায় পৌঁছেই শুনলেন কেটির মনিব এসেছিল জরিমানার বায়না নিয়ে। মিসেস মাহমুদ তাকে বলেছে বিকেলে আসতে।

অর্থাৎ সে অনুযায়ী আর ১৫ মিনিট পরেই এসে হাজির হবেন কেটির মনিব হের বয়েটলার। আর সময়ের ব্যাপারে এতটুকু হেরফের হয় না কোন জার্মান নর-নারীর। ঠিক সময়মতো এসে হাজির হলেন বয়েটলার। সাথে তার একমাত্র সঙ্গী বউ ফ্রাউ কেটলিন। পুলিশকেও ডাকতে ভুলেনি বয়েটলার।

মাহমুদ সাহেব বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, তিনি এটার জন্য আদৌ দায়ী নন। কারণ কেটি লাগামহীন ছিল। তাকে বেঁধে রাখা হয়নি বলেই সে এসে গাড়ির নিচে কোথাও বসেছিল। তবুও নাছোড় বান্দা বয়েটলার। তার এক কথা, কেটির সামনের ডান পা'টি ভেঙ্গে গেছে।

আর সেটির চিকিৎসার জন্য খরচ হয়েছে দেড় শ' ইউরো। সাথে কেটির জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সেই বাবদ আরো পঞ্চাশ ইউরো। তাই তার দাবি, এক্ষুনি বুঝিয়ে দিতে হবে দুই শ' ইউরো। বয়েটলারের দাবির সাথে পুলিশ সদস্য দু'জনও একমত যে, দুই শ' ইউরো দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলুন।

কিন্তু মাহমুদ সাহেবের কথা, কেটি যেহেতু বাঁধা ছিল না, তাই আমি এককভাবে এটার জন্য দায়ী নই। সুতরাং আমি সর্বোচ্চ এক শ' ইউরো দিতে পারি, সাফ কথা মাহমুদ সাহেবের। দুই শ' ইউরো মানে প্রায় বিশ হাজার টাকা। একটি কুকুর ছানাকে গাড়ি দিয়ে আহত করার জন্য কি এতো বেশি জরিমানা দেওয়া সম্ভব? মনে মনে ভাবছেন, মাহমুদ সাহেব। শেষ পর্যন্ত কোন মিমাংসা হলো না।

আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়ে ফিরে গেলেন বয়েটলার পক্ষ। সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেই খারাপ সংবাদটি শুনতে হলো মাহমুদ সাহেবকে। কেটি পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। সপ্তাহান্তের সব সুখ মাটি হলো। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন মাহমুদ দম্পতি।

তবে এটুকু স্বস্তির খবর জানা গেছে যে, তিন দিন আগে নাকি কেটির ঠাণ্ডা লেগেছিল। হতে পারে, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা-জ্বরেই মারা গেছে কেটি। কিন্তু তবুও কেটির অকাল মৃত্যুর জন্য এখন মাহমুদ সাহেবকে দায়ী করাটা বেশ সহজ হবে বয়েটলার পক্ষের জন্য। ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় যেন ছিল বয়েটলার দম্পতি। সোমবারই কুকুর ছানা কেটিকে হত্যার জন্য মাহমুদ সাহেবকে আসামী করে মামলা ঠুঁকে আসল আদালতে।

মঙ্গলবার আদালতের চিঠি পৌঁছে গেল মাহমুদ সাহেবের বাংলোয়। বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির হতে হবে তাঁকে। রীতিমত মামলার কাজ শুরু হলো বৃহস্পতিবার। মাহমুদ সাহেবের আইনজীবী সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন মক্কেলকে বাঁচানোর জন্য। পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক চলল দুই পক্ষের আইনজীবীর মধ্যে।

তবে এতো সহজেই শেষ হলো না কেটি মামলার। শুনানি চলল আরো কয়েক সপ্তাহ। পুলিশি প্রতিবেদন, তদন্তের খুঁটিনাটি, সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনা সাপেক্ষে আদালতের রায় হতে সময় লাগল দুই মাস। রায়ে মাহমুদ সাহেবকে জরিমানা করা হলো দুই হাজার ইউরো। এখন আর জেদ করার কিছু নেই।

দুই শ' ইউরো অর্থাৎ প্রায় বিশ হাজার টাকা দিতে রাজি হন নি মাহমুদ দম্পতি। এখন গুনতে হলো প্রায় দুই লাখ টাকা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।