মৌলবাদের থাবা যখন জীবনকে বিধ্বস্ত করে
ফকির ইলিয়াস
========================================
গ্রাউন্ড জিরোর পাশ দিয়ে আবারো হেঁটে গেলাম। ২ মে ২০১১ সোমবারের নিউইয়র্ক ছিল নিরাপত্তার চাদরে মোড়া। টুইন টাওয়ার এলাকায় হাজারো মানুষ। এসেছেন নাইন-ইলেভেনে স্বজন হারানো মানুষেরা। মিডিয়ার কর্মীরা ব্যস্ত রিপোর্টিংয়ে।
যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের হাতে নিজ নিজ স্বজনের ছবি। বলছেন- এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। ওসামা বিন লাদেনের হত্যা ঘটনাটি এভাবেই পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রবাসী।
বিন লাদেনকে জীবিত ধরে আনা হবে, এমন প্রত্যাশা কারো ছিল না। কারণ তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হলে তার জন্য প্রচুর সময়, ধারাবাহিকতার দরকার পড়তো।
তাছাড়া নানা ঝুঁকিও ছিল। ট্রায়াল পর্বের সময় নানা ধরনের আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারতো। যুক্তরাষ্ট্র সে ঝুঁকি নিতে চায়নি।
লাদেনের মরদেহ সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে আল-কায়েদা তাদের নতুন নেতার নাম ঘোষণা করেছে।
তারা প্রতিশোধের ঘোষণাও দিয়েছে। মৌলবাদ, কট্টর জঙ্গিবাদের এই যে ছোবল, তা থেকে পরিত্রাণ আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, তা বলা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে। বরং দেখা যাচ্ছে, এই ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা দেশে দেশে তাদের নখর দেখাচ্ছে নানাভাবে।
সিলেটে মে দিবসের অনুষ্ঠানে মৌলবাদীরা আক্রমণ করেছে। তারা শিল্পীদের গান গাইতে দেয়নি।
শ্রমিকদের মে দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রোববার রাতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট এলাকা। এর আগে সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় গণসঙ্গীত শিল্পীদের মে দিবস অনুষ্ঠানে হামলা চালায় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কর্মীরা। দুটি ঘটনায় রাতভর সিলেট নগরী ছিল উত্তপ্ত। সোবহানীঘাটে মাদ্রাসা ছাত্র, পুলিশ ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ২ ঘণ্টা সংঘর্ষ হয়। এ সময় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ৫০ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়ে। এ ঘটনায় আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মহান মে দিবসে সিলেটজুড়ে শ্রমিকরা নানা কর্মসূচির আয়োজন করে। রোববার সকাল থেকে অনুষ্ঠানের নগরীতে পরিণত হয় নগরী। দিনভর উৎসব শেষে বিভিন্ন এলাকায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
তবে রাতে সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় মে দিবস উপলক্ষে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। রাত দশটার দিকে কোর্ট পয়েন্টে স্থাপিত মঞ্চে গান পরিবেশন করা হচ্ছিল। এ সময় নগরীর সুরমা মার্কেট এলাকা থেকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কর্মীরা ঢাকার মহাসমাবেশকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল বের করে। মিছিলকারী সবার হাতে ছিল লাঠিসোঁটা। এ সময় কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় পুলিশের একটি দল অবস্থান করছিল।
মিছিলটি কোর্ট পয়েন্ট এলাকা অতিক্রমকালে আকস্মিক ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কর্মীরা গণসঙ্গীত শিল্পীদের স্থাপিত মঞ্চে হামলা চালায়। ‘চল চল ঢাকা চল’ স্লোগান নিয়ে তারা গণসঙ্গীত শিল্পীদের মঞ্চ ভাঙচুর করে। তারা মাইক কেড়ে নেয় এবং বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে। এ সময় পাশ থেকে কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে এলে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। কর্মীদের হামলায় পুলিশের হাবিলদার নূরসহ ১০ জন আহত হন।
প্রায় ৫ মিনিট তাণ্ডব চালিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কর্মীরা মিছিল নিয়ে আবার চলে যায়। খবর পেয়ে ওই এলাকায় ছুটে যান সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা তাৎক্ষণিক রাস্তায় বসে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা নগরীতে মিছিল বের করেন। মিছিল শেষে শহীদ মিনারে এক সমাবেশে তারা ঘটনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন।
শহীদ মিনারের সমাবেশে তারা জানান, প্রকাশ্য হামলা সিলেটের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। তারা এ জন্য মৌলবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্ত থেকে সতর্ক থাকার জন্য সিলেটবাসীকে আহ্বান জানান।
এদিকে গত ১ মে মহান মে দিবস উপলক্ষে সিলেটের ঐতিহাসিক কোর্ট পয়েন্টে সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনুষ্ঠানে মৌলবাদীচক্রের হামলার প্রতিবাদে সিলেটের সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মীদের আয়োজনে ২ মে সোমবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হামলাস্থলে একটানা প্রতিবাদী অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়, পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। বক্তরা বলেন- প্রশাসনের বিস্ময়কর নীরবতার সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে চায়, নারীদের অধিকার ক্ষুণœ করতে চায়, এই চিহ্নিত মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রগতিশীল সুস্থ সমাজ চেতনার প্রধান শত্র“। মে দিবসের গানের অনুষ্ঠানে মৌলবাদীদের হামলার শিকার একজন গণসঙ্গীত শিল্পী বলেন- আমাদের ভোটে সরকার নির্বাচিত হয়েছে, যে সরকার গান গাওয়ার নিরাপত্তা দিতে পারে না বরং হামলাকারীদের মদদ দেয় তাদের আমরা ভোট দেবো না।
এ প্রতিবাদের সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্যের পাশাপাশি চলে নানান প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আয়োজন।
দুই.
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জিহাদি জঙ্গিরা কেমন আছে? এ প্রসঙ্গে একটি স্পষ্ট কথা বলেছেন, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। তিনি বলেছেন, ইসলামাবাদের অদূরে আল-কায়েদার প্রধান নেতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুতে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানে নিরাপদে আশ্রয়ে আছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ২ মে সোমবার এ মন্তব্য করেন।
পি চিদাম্বরম বলেন, ‘আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বিবৃতিতে লক্ষ করেছি, পাকিস্তানের এবোটাবাদে গোলাগুলিতে ওসামা বিন লাদেন মারা গেছেন, ওই অঞ্চলটি পাকিস্তানের একেবারেই গভীরে।
’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে আর এই সত্য আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ’
স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি আবারো বলেন, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার ঘটনায় জড়িত পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীরা ইসলামাবাদেই অবস্থান করছে। একইসঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি ভারত-চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের আহ্বান জানান তিনি।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, পাকিস্তান জঙ্গিদের আশ্রয় দিচ্ছে এবং তাদের সমর্থন দিচ্ছে। মুম্বাই হামলার ঘটনায় দশজন বন্দুকধারী অংশ নেয়।
এতে ১৬৬ জন লোক নিহত হন।
নিউইয়র্ক, পেন্টাগন, লন্ডন কিংবা বাংলাদেশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় যারা জড়িত, মূলত এদের শিকড় একই। এরা মানবতাবাদ, বিশ্বশান্তির বিপক্ষ শক্তি। কিন্তু আমরা দেখছি পাকিস্তানে এর পক্ষেই দাঁড়াচ্ছে কিছু মানুষ প্রকাশ্যে। পাকিস্তানের কোয়েটা শহরে একযোগে কয়েকশ মানুষ নিহত আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সম্মানে মিছিল করেছে।
মিছিলে অংশ নেয়া লোকজন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দেয় এবং মার্কিন পতাকা পোড়ায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও সংগঠকরা এ তথ্য জানান।
বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটার স্থানীয় ধর্মীয় দলের সঙ্গে যুক্ত লোকজনই মূলত এই মিছিলে অংশ নেয়। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের সদস্য মৌলভী আসমাতুল্লাহ এতে অংশ নেন। পাকিস্তানি পার্লামেন্টের সদস্য আসমাতুল্লাহ বলেন, ‘বিন লাদেন মুসলিম বিশ্বের বীর।
তার মৃত্যুর পর তাকে মহান মুজাহিদ বলে অভিহিত করা হবে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘লাদেনের মৃত্যুর পরও আন্দোলন থেমে থাকবে না। এটা অব্যাহত থাকবে এবং আরো হাজারো নেতা তৈরি হবে। ’
মিছিলে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা জঙ্গি সংগঠন তালেবান ও এর নেতা মোল্লা ওমরের পক্ষেও স্লোগান দেয়। আসমাতুল্লাহ আরো বলেন, ‘আজকের অভিযানে এটাই প্রমাণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শ্রদ্ধা নেই।
তারা যে কোনো সময় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতে পারে। ’
আমরা দেখছি, বাংলাদেশেও কিছু কিছু মৌলবাদী পামরেরা বলছে, লাদেন নাকি ছিলেন চে গুয়েভারার মতো বীর! টিভির টকশোতে অংশ নিয়ে যারা কট্টরপন্থী সন্ত্রাসীদেরকে ‘বীর’ আখ্যা দেয় তারা কার স্বার্থরক্ষা করছে, তা কারো অজানা থাকার কথা নয়।
এটা অজানা নয়, আল-কায়েদা তাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। কিন্তু মানুষকেও তা প্রতিরোধ করতে শক্ত হাতে দাঁড়াতে হবে। কারণ কোনো অপশক্তির কাছে প্রজন্ম হারতে পারে না।
যারা মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা হরণের জন্য আজ তৎপর, তারা সুযোগ পেলে রক্তবন্যা ভাসাতে যে কসুর করে না, সে প্রমাণ আমরা বারবার দেখেছি। তাই সতর্ক পথচলার পাশাপাশি মৌলবাদের কুফলগুলো জানিয়ে যেতে হবে আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে।
নিউইয়র্ক/৪ মে ২০১১
------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা / ৭ মে ২০১১ শনিবার
ছবি- ট্রুডি বরল্যান্ড
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।