পর্ব-২
এক. বাংলাদেশে ইসলামের প্রসার এবং দলে দলে নিম্নবর্ণের মানুষের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘটনাটি ঘটেছিল তরবারির জোরে নয়। এ ব্যাপারে অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত। ইসলাম ধর্মের তুলনামূলক মানবিক দিকগুলো অত্যাচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দু প্রজাদের আকৃষ্ট করেছিল। তারাই দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। লক্ষ্মণ সেনের সময়কালে কীভাবে এই বিরাট আকারের সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছিল তার এক চমৎকার চিত্র অংকন করেছেন লেখক শওকত আলী তার বিখ্যাত উপন্যাস 'প্রদোষে প্রাকৃত জন'-এ।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলাদেশে শ্রমজীবী গরিবদের মধ্যে যে ধর্মীয় মতবাদ ও ধর্মীয় প্রথা চালু ছিল, তার মধ্যে বাউল বৈষ্ণবদের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। পরবর্তী সময়েও ইসলাম ধর্ম প্রচার যারা করেছিলেন তাদের মধ্যে সুফি মতবাদের প্রভাব ছিল। বাউল-বৈষ্ণব ও সুফি মতবাদ উভয়ই উদার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন এবং মানবিক দিকটিই তাদের কাছে প্রধান ছিল। ফলে ঐতিহাসিকভাবে এই দেশে মৌলবাদ এখনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মৌলবাদের বীজ বপন করা হয়েছে ব্রিটিশ আমলে, প্রধানত বিংশ শতাব্দীতে।
এ কথা সত্য যে, বিংশ শতাব্দীর আগে ভারতবর্ষের দুই বড় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কখনো দাঙ্গা হয়নি। মুসলিম বাদশাহর দরবারে অনেক উচ্চবর্ণের হিন্দু রাজা, সামন্ত ও সেনাপতির ভালো অবস্থান ছিল। আমরা জানি, পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দ্দৌলার পক্ষে ছিলেন সেনাপতি মোহনলাল ও মীরমদন, দুজনই হিন্দু। আর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মীর জাফর আলী খান। তিনি ছিলেন মুসলমান।
সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া (যেমন আওরঙ্গজেব) মুসলিম শাসনকালে ধর্মীয় নিপীড়নের কথা জানা যায় না। তাই মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল দিলি্ল আগ্রার চারপাশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দুরা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ দিলি্ল থেকে সবচেয়ে দূরে বাংলা, যেখানে সাম্রাজ্যের বাঁধন সবচেয়ে দুর্বল ছিল, সেখানেই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
তবে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, শত শত বছর পাশাপাশি বাস করার পরও এবং একই ভাষায় কথা বলা, একই কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও (পার্থক্য কিছু আছে, যথা গরু বা শূকরের মাংস খাওয়া সংক্রান্ত, বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদি) এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন কিন্তু থেকে গিয়েছিল। পরস্পরের মধ্যে বিবাহ হতো না এবং একসঙ্গে খাওয়াও চলত না।
হিন্দুদের মধ্যেও অবশ্য অসমবর্ণ বিবাহ সম্ভব হতো না। অথবা ব্রাহ্মণ শূদ্রও একসঙ্গে আহার করত না। অবস্থাটি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছিলেন, 'ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু-মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে; ধর্মমতে হিন্দুর বাধাপ্রবল নয়, আচারে প্রবল, আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। '
এই যে বিভাজন তাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিল। শাসনের স্বার্থে তাদের নীতি ছিল devide and rule।
ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম দিকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ব্রিটিশ আনুকূল্য পেয়েছিল। বাংলাদেশের অধিকাংশ জমিদার ছিল হিন্দু। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের উঁচু জায়গায় চলে যায়। পাশ্চাত্যের শিক্ষার মাধ্যমে তাদের অনেকে সেক্যুলার ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী ও সমাজ সংস্কারকের অভ্যুদয় ঘটে।
রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন তাদের অন্যতম। কিন্তু এই মহান পুরুষদের প্রভাব হিন্দু মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা মুসলমান সমাজ এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষক তথা শ্রমজীবীর মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে, যেখানে সাহিত্য প্রতিভা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। অন্যদিকে পাল্টা মুসলিম জাতীয়তাবাদও বিকাশ লাভ করে।
নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলমান সমাজের ওপরতলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তারা জাতীয়তাবাদের উৎস খুঁজতেন ভারতের বাইরে আরব, ইরান, তুরস্ক এসব জায়গায়। উর্দু বলাকে আভিজাত্যের লক্ষণ মনে করতেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মুসলমান জাতীয়তাবাদী সাহিত্যিকরা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ব্যস্ত ছিলেন। পাশাপাশি বঙ্কিমের রচনায় স্পষ্টই মুসলিম বিদ্বেষ ছিল।
সেই যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে মীর মশাররফ ছিলেন মহৎ ব্যতিক্রম।
এ কথা জোরের সঙ্গে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু-মুসলমান সাহিত্যিক 'বুদ্ধিজীবী' সমাজ সংস্কারকদের সঙ্গে ব্যাপক গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। বাংলার কৃষক বার বার জমিদার ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সেই বিদ্রোহ ছিল হিন্দু-মুসলমানদের মিলিত সংগ্রাম এবং ১৮৫৭ সালের আগ পর্যন্ত কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল প্রধানত সশস্ত্র। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ নামে খ্যাত প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধও ছিল হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াই।
দুই. বাংলাদেশে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকেই। যা স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। বিদেশি কাপড় বর্জন ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উপাদান। কিন্তু এই আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান সমানভাবে অংশগ্রহণ করেনি। বিলাতি কাপড় পোড়ানোর মতো ঘটনায় মুসলমানদের এমনকি গরিব হিন্দুদেরও যে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি, তা রবীন্দ্রনাথের নজরে এসেছিল।
'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে এর উল্লেখ আছে। সে সময় সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী দল ও আন্দোলনও গড়ে ওঠে। সেখানেও মুসলমানদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য ছিল। তবে গরিব মুসলমানদের সমর্থন ছিল। বিপ্লবী সূর্যসেনের কিশোর শিষ্য কমরেড শরবিন্দু দস্তিদার বলেছেন, মুসলমান গ্রামবাসীর সমর্থন না থাকলে সূর্যসেনের পক্ষে মুসলিম প্রধান চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে লুকিয়ে থাকা সম্ভব ছিল না।
মহাত্দা গান্ধীর নেতৃত্বে যে প্রবল জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল (অসহযোগ আন্দোলন, লবণ আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলন), সেখানে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াই আমরা দেখেছি। গান্ধীজী পুরোপুরি ও আন্তরিকভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তবে তার চিন্তাধারা ও কার্যক্রমের মধ্যে ধর্মীয় উপাদান ছিল যথেষ্ট পরিমাণে যা সত্যিকারের সেক্যুলার রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা ছিল। পরাধীন ভারতে জাতীয় নেতাদের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই বিপ্লবী ও সেক্যুলার।
জাতীয় আন্দোলনকে বিভক্ত করার জন্য ইংরেজ মদদ দিয়ে তৈরি করল মুসলিম লীগ।
এক পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত জিন্নাহ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে আসেন। তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে জোরদার করে তুললেন। পাকিস্তান দাবি ছিল সেই রাজনীতির বিস্ময় ফল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বাংলাদেশে ছোটখাটো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। কিন্তু বড় ও ভয়াবহ আকারে সর্বপ্রথম দাঙ্গা হলো ১৯৪৭ সালের ১৬ আগস্ট থেকে।
অথচ ওই বছরই বোম্বেতে হিন্দু-মুসলমান নৌসেনারা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন (২১ ফেব্রুয়ারি)। একই বছর রশীদ আলী দিবসে কলকাতায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছিল হিন্দু-মুসলমান জনতা। (সুভাষ বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দুফৌজের সৈন্যদের বিচারকে কেন্দ্র করে রশীদ আলী দিবস। আজাদ হিন্দুফৌজে সেনাপতি ও সাধারণ সৈন্য উভয় ক্ষেত্রেই হিন্দু-মুসলমানের সম অংশীদারিত্ব ছিল)। ১৯৪৬ সালের নভেম্বর থেকে শুরু ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন_ হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আন্দোলন।
তা হলে আমরা একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দু মুসলমানের যৌথ সংগ্রাম_ যেখানে উদার নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা প্রবল। আবার তার মাঝে আছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষাক্ত ছোবল। মনে হয় যেন সমাজটা দুই বিপরীত মেরুর মধ্যে দোল খাচ্ছে।
তিন. আগেই বলেছি, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এক জিনিস নয়।
তবে আমাদের দেশে এই দুটি বিষয় জড়াজড়ি করে আছে। ধর্মীয় মৌলবাদ কিন্তু খুব পুরনো কোনো বিষয় নয়। ইংরেজিতে Fundamentalism শব্দটিও সৃষ্টি হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের বেশ পরে। ইউরোপে আলোক প্রাপ্তির যুগে, বিশেষত ফরাসি বিপ্লবের পর যাজক শ্রেণীর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তারই প্রতিক্রিয়ায় খ্রিস্টীয় ধর্মকে কেন্দ্র করে যে আধুনিকতাবিরোধী জীবন আচরণ সংক্রান্ত মতবাদ জন্ম নেয়, তাকেই ইংরেজিতে বলা হচ্ছে Fundamentalism।
খ্রিস্টীয় মৌলবাদই প্রথম এসেছে। হিন্দু ও ইসলামী মৌলবাদ বিংশ শতাব্দীতে এসেছিল। খ্রিস্টীয় মৌলবাদ, ইসলামী মৌলবাদ, হিন্দু মৌলবাদ, ইহুদি মৌলবাদ এখন বেশ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। বৌদ্ধ মৌলবাদ সম্পর্কে এখনো তেমন জানা না গেলেও বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে খুব সাম্প্রতিক সময়ে। সব ধর্মীয় মৌলবাদ বলে যে আদিতে স্ব স্ব ধর্মে যেভাবে জীবন আচরণ বর্ণিত আছে সেভাবে ব্যক্তি ও সমাজ জীবন চালিত করতে হবে।
ধর্মীয় ব্যাখ্যাও হতে হবে তাদের মনমতো। তা যদি বর্তমানকালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে আধুনিকতাকেই বর্জন করতে হবে। এর একটি উদাহরণ হলো, ইসলামী মৌলবাদীরা সিনেমা, নাটক সবকিছুকেই ইসলামবিরোধী মনে করে এবং সে জন্য তারা সিনেমা হলে বোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা করেছিল এবং এভাবে মানুষ হত্যাকে তারা 'পবিত্র' 'ধর্মীয়' কাজ বলে প্রচার করে। সহিংস উপায়ে নিজের অভিমতকে সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান মৌলবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ মৌলবাদ মাত্রই ফ্যাসিস্ট।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঊনবিংশ শতাব্দীতে হলেও তা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রূপ লাভ করেছিল ভারতে ১৯২৫ সালে RSS প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এর আগে মৌলবাদী ধারণাকে কেন্দ্র করে ইউরোপে খ্রিস্টীয় মৌলবাদের সাংগঠনিক অবস্থান দেখা গিয়েছিল। ইহুদি মৌলবাদ বিংশ শতাব্দীর ঘটনা, যা এখন রাষ্ট্রীয় রূপ ধারণ করেছে (ইসরায়েলে)। ইসলামী মৌলবাদও সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক রূপ ধারণ করেছে বিংশ শতাব্দীতে। সিরিয়ার নেতা রশিফরিদা ১৯২০ সালে একটা বই লেখেন ‘The Khelafat of the suprime Imamat’।
এই বইয়েই প্রথম ইসলামী মৌলবাদের তত্ত্বীয় ধারণাসমূহ বর্ণিত হয়েছিল।
লেখক : রাজনীতিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।