সাইবার ক্রাইম কী?
সাইবার ক্রাইম শব্দটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশের প্রান্তিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীর কাছে স্বল্প পরিচিত কথা হলেও এটি অতি পরিচিত ও ভীতিকর একটি শব্দ। এ বিষয়ে জানা থাক বা না থাক, এর শিকার হচ্ছে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ। তবে সাইবার অপরাধ বিশ্বে নতুন ধরনের কোনো অপরাধ নয়, শুধু মাধ্যমটি ভিন্ন।
অন্যান্য সাধারণ অপরাধ (যেমন—তথ্য চুরি, তথ্য বিকৃতি, প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, অর্থ চুরি ইত্যাদি) তথ্যপ্রযুক্তির মাধমে করা হলে সেগুলোকে সাধারণ ভাষায় সাইবার অপরাধ বলা হয়। অন্য ভাষায় সাইবার ক্রাইম মূলত কম্পিউটারে ব্যবহৃত কর্মকাণ্ড, যার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী ক্রাইম পরিচালিত করে থাকে অপরাধীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সাইবার অপারাধীদের অভ্যন্তরীণ লোক (Insiders), অনুপ্রবেশকারী (Hackers), ভাইরাস লেখক (Virus Writers) ও অপরাধী চক্র (Criminal Groups)—এই চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন।
বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধ
স্প্যামিং বা জাঙ্ক মেইল : এটি প্রতারণার জন্য চমত্কার একটি মাধ্যম এবং এটি সম্পূর্ণ ই-মেইলভিত্তিক! ভুয়া আইডি/ই-মেইল অ্যাড্রেস ব্যবহার করে নাম-ঠিকানা, ক্রেডিট কার্ড নাম্বার এমনকি ফোন নাম্বার নিয়ে মিষ্টি কথায় ভোলাতে চেষ্টা করবে অপরাধী চক্র। ফাঁদে পা দিলেই বিপদ! স্প্যাম ফোল্ডারে প্রায়ই এমন মেইল আসে।
পর্নোগ্রাফি: রগরগে অশ্লীল সাইটগুলোতে অনেক সময় Iur পেতে থাকে অপরাধীরা। বেশকিছু সাইটে থাকে ক্ষতিকর কম্পিউটার ভাইরাস।
ক্লিক করতে থাকলে কিংবা এক পর্যায়ে ই-মেইল আইডি (ফ্রি সাবস্ক্রাইব) দিলেও তথ্য চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মাদক ব্যবসা : ইন্টারনেটে মাদক ব্যবসায়ী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা এদের ওয়েবসাইটে মাদকদ্রব্যের তথ্যসংবলিত ডেটাবেজ (ক্রয়মূল্য, ডিস্ট্রিবিউশান প্রভৃতি) তৈরি করে এবং সারা বিশ্বের মানুষকে প্রদর্শিত করে।
হ্যাকিং ও ক্র্যাকিং : বাংলাদেশে ২০০৮ সালে র্যাবের ওয়েবসাইট স্বনামে হ্যাক করে ২১ বছর বয়সী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া তরুণ শাহী মির্জা। শুধু তাই নয়, সে বেশ কয়েকটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওয়েবসাইটে ঢুকতে সক্ষম হয়।
র্যাব সদস্যরা তাকে ধরতেও সমর্থ হয় এবং শাহী মির্জা তার অপরাধ স্বীকার করে। তবে মির্জা যা করেছিল তা হলো ‘হ্যাকিং’। আর ‘ক্র্যাকিং’ হলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কিংবা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার চুরি করে গোপনে অনলাইন ব্যাংক থেকে ডলার চুরি করা! সেক্ষেত্রে শাহী মির্জার বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশী ওয়েবসাইটগুলো রিয়েল প্যাকেজ সফটওয়্যার ব্যবহার না করার কারণে নিরাপত্তাহীন। হ্যাকিং ও ক্র্যাকিং দুটোই অপরাধ তবে ক্র্যাকিং মারাত্মক অপরাধ।
বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ
বাংলাদেশে যতগুলো সাইবার ক্রাইমের ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে শৌখিন ও কাঁচা হ্যাকার/ক্র্যাকারদের দ্বারা।
এর আগে পরিচয় লুকিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে (বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালীন) ই-মেইল হুমকি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওয়েব সাইট হ্যাক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি চুরিসহ আরও অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে।
প্রচলিত সাইবার ক্রাইমের মধ্যে আছে ফ্রড কিংবা প্রতারণা, ক্রেডিট কার্ডের নাম্বার চুরি, ব্ল্যাকমেইল, পর্নোগ্রাফি, হয়রানি, অনলাইনের মাধ্যমে মাদক পাচার/ব্যবসা প্রভৃতি। আবার জাল সার্টিফিকেট তৈরি, জাল টাকা বা জাল পাসপোর্ট, বিভিন্ন ধরনের দলিল-দস্তাবেজ কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরির ঘটনা অহরহ উদ্ঘাটিত হচ্ছে।
সাইবার ক্রাইমে নারী নির্যাতন
সাইবার ক্রাইমের করুণ শিকার আমাদের দেশের মেয়েরা। বিগত কয়েক মাসে উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেছে, দেশের প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীসহ বিদ্যালয়ের মেয়েরা পর্যন্ত সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে পর্নোগ্রাফিতে জড়িয়ে পড়ছে নিজের অজান্তে।
ক্যামেরায় বা মোবাইল ফোনে ধর্ষণ কিংবা সেক্সের দৃশ্য ভিডিও করে তা ইন্টারনেটে পোস্ট করে দেয়ার মতো বেশ কয়েকটি জঘন্য অপরাধও সংঘটিত হয়েছে আমাদের দেশে। ইদানীং এ কাজগুলো অনেক বেশি হচ্ছে।
সাইবার ক্রাইমে নারী নির্যাতনের অন্যান্য ধরনের মধ্যে রয়েছে ফেসবুকে অশ্লীল ছবি প্রদর্শন, ছবিসহ ভুয়া ঠিকানা খোলা, ই-মেইলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি। এসব আমাদের উদ্বেগের মাত্রাকে দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আর্থিক ক্ষতিও কম নয়...
প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী এসব অপরাধের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সংস্থা প্রতি বছর সারা বিশ্বে সাইবার ক্রাইমের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণের জরিপ প্রকাশ করে। কম্পিউটার ইকোনোমিক্সের জরিপ অনুযায়ী ২০০৬ সালে শুধু ভাইরাসজনিত কারণে ক্ষতি হয়েছিল ১৩.৩ বিলিয়ন ডলার। প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে যেহেতু তথ্য বা অর্থ কাগজের বদলে প্রযুক্তির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তাই এই অপরাধের শিকার ওরাই বেশি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাইবার অপরাধগুলো অর্থনৈতিক মূল্যমানে বড় ছিল না, কারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর নয় বিধায় এখানে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণেরও ব্যবস্থাও নেই।
বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে আইন
বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে—
১. যদি কোনো ব্যক্তি জনসাধারণের বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা ক্ষতি হবে মর্মে জানা সত্ত্বেও এমন কোনো কাজ করেন, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সেও কোনো তথ্যবিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা তার মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাস পায় বা অন্য কোনোভাবে একে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২. এমন কোনো কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করার মাধ্যমে এর ক্ষতিসাধন করেন যাতে তিনি মালিক বা দখলদার নন, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি হ্যাকিং অপরাধ। কোনো ব্যক্তি হ্যাকিং অপরাধ করলে তিনি অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বা উভয় দণ্ড দেয়া যেতে পারে।
— তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নম্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
— তথ্য০প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৬৮ ধারায় আরও বলা হয়েছে, সরকার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচারের উদ্দেশে এক বা একাধিক সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে।
তবে ২০০১ সালে টেলিকম্যুনিকেশন আইন পাস করা হলেও সাইবার ক্রাইম সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ২০০৬ সালে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিলের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলেও আজও তা সংসদে উত্থাপিত হয়নি।
সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে নেই আলাদা ইউনিট
বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগে একটি সাইবার ক্রাইম ইউনিট চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এই ইউনিট চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় মানব সম্পদ ও কারিগরি সহায়তা বাংলাদেশে নেই বলে জানা গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে কতিপয় কর্মকর্তাকে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল।
কিন্তু কেবল বিদেশে যাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা অর্জনের বাইরে তারা তেমন কোনো প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি বলেও জানা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি আলাদা সাইবার ক্রাইম ইউনিট গঠন দরকার।
সাইবার ক্রাইম বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একটি বড় আইনগত সমস্যা না হলেও বাংলাদেশ যে গতিতে তথ্য-প্রযুক্তির সুপার হাইওয়েতে ভ্রমণ শুরু করেছে, তাতে অচিরেই এটি একটি বড় সমস্যা রূপে আবির্ভূত হবে। যেহেতু সাইবার ক্রাইমের কোনো সীমারেখা নেই তাই বহির্বিশ্ব থেকে এদেশে এবং এদেশ থেকে বহির্বিশ্বের অন্য দেশেও এ ধরনের অপরাধ সম্পন্ন হতে পারে। তাই বিষয়টি ভাবতে হবে বাস্তবতার আলোকে সময়ের নিরিখে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।