গালাগালের মধ্যে যেটা সবচেয়ে প্রকট সেটা হলো যার প্রতি এটি উচ্চারিত হয় তার প্রতি রাগ, ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের প্রকাশ। আরো একটা বিষয় একটু প্রচ্ছন্ন, সেটা হলো যাকে গাল দেয়া হয় সে লোভী, ইতর, অধঃপতিত, অনভিজাত, মূর্খ, অপরাধী এবং হিংস্র, অসভ্য, অযোগ্য ইত্যাদি। আরো একটা বিষয়, আরও একটু প্রচ্ছন্ন, আমরা আসলে কী পছন্দ করি না বা অমঙ্গল বলে আমাদের সংস্কৃতিতে লালন করে চলি ও প্রকাশ পায়। এবং গালাগাল এভাবে আমাদের সমাজের রাজনীতি, সংস্কৃতি, আমাদের বিশ্বাস, সংস্কার, আমাদের আপ্ত ধারণাগুলোকে প্রকাশ করে দেয়, যদিও আমাদেও মনোযোগ সেখানে থাকে না। কিন্তু কেউ না কেউ যখন গালি দেয় এবং যে গালি খেয়ে রাগে ফুসে দুজনের সংস্কৃতিবোধ এবং বিশ্বাস যে প্রায় এক সে বিষয়টা ফোটে উঠে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জন যে যাকে গালি দেয়, তাকে যে বিষয়গুলো এবং যে বস্তুরাজি বা জীব বা প্রাণীর সাথে তুলনা বা উপমা বা উপমান বা সমান্তরাল হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের প্রতি সেই সমাজের তীব্র তাচ্ছিল্য মনোভাব ফুটে উঠে। এবং এর ভেতর দিয়ে প্রতিটি মানুষ কী হতে চায় না ঐ সংস্কৃতিতে তা বেশ বোঝা যায়। এবং এটি ঐ সমাজের যে রাজনীতি অবিরত চলছে তার সপক্ষে কার্যকর একটি জিনিস।
সুশীল সমাজ যতোই একে এড়িয়ে চলুক। আসলে তারা দৈনন্দিন জীবনে বন্ধু মহলের কথা বার্তায় শত্রুপক্ষকে নিয়ে কথা বলার সময়ে একে একেবারেই এড়িয়ে চলতে পারে না।
যদিও তাদের লেখায় কেবল গালির মূর্ত রূপের তীব্র বিমূর্তায়ন ঘটে। এবং এও রাজনীতি। এটা হলো সভ্য-অসভ্যের বিভেদের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিব্যবসায়ী সমাজের শ্রেণী পরিচয়কে সমাজে জারি রাখা। আর এ কারণেই তারা নিজের জীবনে তাকে ছদ্মভাবে বা সরাসরি ব্যবহার করলেও তারা তাদের লেখায় একেবারে এড়িয়ে চলতে চায়, কিন্তু সফল হয় না, বরং ছদ্মভাবে এর ব্যবহার চালিয়ে যায়। যেনো ‘শীলভদ্র’রা কিভাবে গালি দেয় তাও ভদ্রতার ব্যাপার।
গালির ব্যাপারটাতে যদি অপরকে তীব্রভাবে অস্বীকারের ব্যাপারটি থেকেই যায়, আর আমারা যারা যেশ্রেনীকে তীব্রভাবে এড়িয়ে চলছি, বা বঞ্চিত করে চলছি বহুদিন ধরে, দুটো তো যমজ ভাই হয়ে সমান্তারাল জিনিস হয়ে আমাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতেই তাকে। এবং গালির সাথে এটি পার্থক্য হারায়। ফলে আসলে আমরা সবাই গালিবাজ অভদ্রলোকই, যতো নির্গাল থাকি বলে ভাবি না কেন। এবার এগোনো যাক গালাগালের দিকে:
শুয়োর বা শুয়রের বাচ্চা, কুত্তা বা কুত্তার বাচ্চা, খানকি বা খানকির বাচ্চা, ছাগল বা ছাগলের বাচ্চা, ...
এখানে যাকে পছন্দ করছি না, বা যাকে ঘৃণা করছি, বা যার উপর ক্রুদ্ধ আছি, তাকে শুয়োর, কুত্তা, ছাগল, খানকি বা এগুলোর বাচ্চা হিসেবে অভিহিত করছি। এর মানে একটা মানুষ আর মানুষ থাকছে না যেমন, তেমনি খানকিও আর মানুষ নয় (মনোগ্যামী সমাজে বহুগামীতা সবচেয়ে বড়ো অধঃপতন মানুরের ক্ষেত্রে, প্রাণী বা উদ্ভিদের কেএষত্রে নয়)।
আর যেহেতু শুয়োর, কুত্তা, বা খানকির ওপর আমাদের কোন ভালবাসা নেই, নেই যত্ম-আত্তিও। যেকোন সময় এদের পাছায় লাথি মারতে পারি চাইলেই। চাইলেই এদেরকে এদের অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত করতে পারি। এ জন্যই দেখবেন বেশ্যাদের কোন অধিকারও কোথাও স্বীকৃত নয়। তেমনিভাবে যাকে গালাগাল দিচ্ছি তার যে অধিকার হরণের অধিকার আমরা বহন করছি, তা যে গাল দিচ্ছি এবং যে গাল খাচ্ছি দুজনেই সমানভাবে এই বোধ অবচেতনে লালন করছি।
এবং শুয়োর, খানকি, কুত্তা বা এসবে বাচ্চা হতে চাচ্চি না! দুপক্ষই এ ব্যাপারে একমত মানবকেন্দ্রিক পুরুষকেন্দ্রিক সভ্যতায়। এদেরকে এভাবে গালির ভেতর দিয়ে একটা সংস্কৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা লোকসম্প্রদায় কী বিশ্বাস ও লালন করে তা যেমন বোঝা যায়, তার গালি থেকে এবং এই গালাগালির ভেতর দিয়েও এটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কার্যকর ভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে।
তাই গালাগালের ভেতর এই সংস্কৃতি কাদের উপর খড়গ হস্ত এবং তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ চালিয়ে যায় তাও জানা যায়, তীব্রভাবে। ভদ্রলোকদের ছদ্মগালাগালি মানে যুক্তির জামা গায় দিয়ে সেই একই অমানবিকতাকে লালন করে, কিন্তু তারা এটাকে নিজে না ভুলে থাকলেও এবং যেবিষয়ের পক্ষে বলে সেই বিষয়ের বিপরীত পক্ষের লোকদেরকে তা বুঝিয়ে দিতে ভুলে না। যারা তার পাঠক সে বিষয়টির যে পক্ষেরই হোক না কেন, তাদের কাছে সুশীল লেখকটির ভদ্রতা বজায় থাকুক আশা করে।
মুখোশই ভদ্রতা। এর অধিক কিছু বোঝায় না।
যেমন বাংলা একাডেমির অভিধান থেকে সমস্ত গালাগাল ঝরে গেলেও কিংবা যারা স্থান পায় কিন্তু গায়ে অশীল অভিধা নিয়ে ব্রকেটবন্দী হয়ে, তারা বাংলা ভাষা থেকে ঝরে না, এবং বাংলাদেশের সব লোকের মাঝে ঠিকই সেই গালাগাল অনুশীলিত হতেই থাকে, যতোই ভদ্রলোকেরা তা না শোনার ভান করুক, বা এড়িয়ে চলুক, আর ছলুক আমাদের। যে সমাজটাই দাঁড়িয়ে আছে ডিভাইড এন্ড রোলের মধ্যে, যে সমাজটাই দাঁড়িয়ে আছে মানব বৈষম্যের ভিত্তিতে, সেখানে গালাগালিও এর আবশ্যিক উপজাত, এবং একে কোন প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে চললেও পুরো সমাজটা একে ঠিকই বয়ে চলবে। এই হলো ভাষা নিয়ে ভাষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের ভুলসংস্কার এবং ব্যর্থ প্রয়াস।
এসব মনে হবে অযার্থ রাজনীতি, যদিও ক্ষমতাকে সংহতই রাখতে ভুমিকা নেয় এসব বিষয়, ফলে তাদের লক্ষ্য যতো স্ববিরোধময় হোক না কেন, রাজনীতিক লক্ষ্য এখানেও কার্যকর থাকে, সচেতনে, অবচেতনে, বুদ্ধিব্যবসায়ীদের।
আবার এটাও ভাবা যায়, ভদ্র অভিধান, এটা আসলে ভদ্র শ্রেণির। ভাষার ওপর নিজেদের আত্মপরিচয় বাজয় রাখার রাজনীতি, বা আধিপত্যশীল অভিজাত শ্রেণীর প্রতি তাদের দায়িত্বপালন, বা তাদের কাছে নিজের আজ্ঞাবহতার অভিজ্ঞান, যে অভিজাত বা আধিপত্যশীল শ্রেণী নিজেরাই গালাগালকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। তাদেরই প্রয়োজনে এইসব গালাগাল সৃষ্ট এবং লালিত এবং তাদেরই কৃতদাস আসলে এইসব গালাগাল। তথাপি অভিজাতরা যেমন নিজের গা থেকে সবসময়েই বুর্জোয়া, পুঁজিপতি এই নামগুলোর সাথে নিজের একটু দুরত্ব ধরে রাখে কৌশলগত কারণেই, তেমনি গালাগাল থেকে তারা এবং তাদের প্রতিনিধিরা একটু দূরত্ব ধরে রাখতে চায়, একই কৌশলগত কারণে।
কিন্তু সংকট সামনে এলে এই উদারীকরণ নিভে যায় পলকেই। সংকট তীব্র হওয়ার প্রথম ধাপে যেটা খসে পড়ে সেটা এই ভদ্রতার মুখোশ। তখন গালাগালিই হয় তাদের অবলম্বন আর তা অনলের মতো ছিটকে যায় বিপরীতমতের লোকের দিকে বা 'অধস্তন'দের দিকে। দ্রুতই গালাগালাগালের সাথে যুক্ত হয় নীপিড়ন। তো গালাগাল থাকেই বেঁচে সমাজে তাদের বন্ধু হয়ে, একটু দূরে, আর সারাক্ষণ তো তাদের গুণই গাইছে প্রতিটা গালি, যারা নু্যনতম অপরের একধাপ ওপরে অনুভব করে, তারই পক্ষে, তাই না?
১৫.০৭.২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।