রাগ করলে আমি বসে পড়ি। পাশে যদি শুয়ে পড়ার মতো ব্যাবস্থা থাকে, আর রাগের পরিমানটা যদি প্রচন্ড বেশি হয় তাহলে শুয়ে পড়ি। চোখ বন্ধ করি। কিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করি। আমার চোখ দুটো বন্ধ থাকে।
দুটো লাল চোখ। ভেতরে প্রচন্ড ক্ষোভ। কিছুক্ষন ঝিমাতে ঝিমাতে ঘুম এসে যায়। ঘুম থেকে ওঠার পর আর রাগ থাকেনা। হারিয়ে যায় জীবনের অনেক কিছুর মতো।
সেদিন ব্যাতিক্রম হলো। সে সময়টাতে আমি ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই ওর সামনে গিয়ে দাড়াই। শক্ত হাতে ওর দুই চোয়ালে দু’টো চড় কষি। একটু নড়েনা, শব্দ করেনা আর শারীরিক আঘাত পাওয়ার পর মানুষের চোখে মুখে যে ব্যাথার চিহ্ন ফুটে ওঠে তার লেশ মাত্রও খুজে পাইনা ওর ভেতর।
দুই গালে পাচ পাচ দশটা আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট হয়। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ও কি মানুষ! মানুষ হলে কাদতো, না হলে চিতকার করে আমার সাথে ঝগড়া করতো, আর তার চাইতে ভাল মানুষ হতে পারতো যদি কিনা ঠিক ওরকম ভাবে আমার দু’গালে দু’টো চড় কষে দিত। আমি মুটামুটি অবাক হই। ওর তাকিয়ে থাকা আমার সহ্য হয়না।
সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ি। জুতা আছে মোজা নেই। চুল গুলো এলোমেলো। আমি বেরোচ্ছি ঠিক সে সময় কথা বলে, ‘ মোজ পরে যান। ’
আমি শুনিনা।
ওর কন্ঠে মমতা ঝরে, প্লিজ বেশি রাত করবেন না। দিনকাল ভাল না। ’
আমি হাটি। আমার পিছ পিছ দরজা পর্যন্ত হেটে আসে মেয়েটা। আমি ওর পায়ের শব্দ শুনি।
হেটে আাসার শব্দ। একবারও পেছন ফিরে তাকাই না।
ছোট বেলা থেকেই আমি একটু অন্যরকম। খুব অভিমানী। জানিনা কেন।
তবে একটা ভাল গুন আছে নাকি আমার। লিপি বলেছিল, আমি নাকি মানুষকে খুব ভালোবাসতে পারি। লিপি একটা মেয়ে। সতের বছর বয়সের সময় ওর সাথে আমার প্রথম দেখা। জুলেখা পার্কের ওপাশে দেয়ালের সাথে মেশা ছোট্ট একটা ঘর।
কুড়ে। মেয়েটা বসেছিল বারান্দায়। দেয়ালের উপর উঠেছিলাম মজা করতে। আমি একা নয় আরও কয়েকজন। মহিন, আজিজ, নজরুল।
দেয়ালের উপর উঠতেই মেয়েটার চোখে চোখ পড়ে। আমাদের দেখে মেয়েটা চলে যায়। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থেকে মেয়েটাকে আর একটি বারের জন্যও দেখতে পাইনি। আমার সামনে অনেক ছেলে মেয়ে, পার্কে। হাসে গান করে।
আমি যেন কাউকে দেখতে পাইনা। কোন শব্দে আমার চিন্তায় ছেদ পড়েনা। একটা মেয়েকে ভাবছি। কি সুন্দর, কি মায়াবী!
তবে কয়েকদিন পর এক পড়ন্ত বিকালে লিপিদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। একা একা।
কেমন ভয় ভয় করে আমার। বাইরে দাড়িয়ে খুক খুক করে কয়েকটা কাসি দিতেই পঞ্চাশোর্ধ একজন মহিলা বেরিয়ে আসেন। আমাকে ভাল করে সময় নিয়ে দেখেন। না আমি তার পরিচিত কেউ নই। চিনতে না পেরে বলেন, ‘ কে আপনি বাবা?’
ঠিক সে সময়টাতে লিপি বেরিয়ে আসে।
ফুলকরা একটা লাল জামা পরা। বড় ওড়নায় মাথা ডাকা। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, কিছু সময়। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি কোনদিন, কোন সময় কোন মেয়ের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকিনি। একটা ফুল আনা উচিত ছিল; রজনীগন্ধা অথবা লাল গোলাপ।
লিপিরা গরিব মানুষ। গরিব হলে অনেক কিছু বলা যায়। আমিও আমার কথা গুলো নির্দিদ্ধায় বলে ফেলি। ‘ আপনার মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে। ’
আমার কথা শুনে লিপি আর দড়িয়ে থাকতে পারেনা।
ঘরে চলে যায়। লিপির মা সোৎসাহে বলেন, ভেতরে এসো বাবা।
আমি যাই। কিছু একটা জয় করতে যাচিছ।
ঘরে তেমন কিছু নেই।
একটা কাঠের বড় চেৌকি। পুরানো আমলের একটা কাঠের আলনা আলনায় কিছু জামা কাপড়। একপাশে কয়েকটা হাড়ি পাতিল। চেৌকির উপর কিছু এলামেলো বই খাতা। বেড়ার এক রুমের ঘর।
সবকিছু দেখে অনুমান করতে পারি মা-মেয়ের সংসার। তারপরও প্রশ্ন করি, ‘ আপনাদের কেউ নেই?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মহিলা। লিপি চেৌকির শেষ প্রান্তে বসে আছে। আমি আর ওর মা পাশাপাশি গিয়ে বসি। লিপির মা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ একটা চেয়ারও নেই যে তোমাকে বসতে দেব।
ভাত খেতে পারিনা চেয়ার কিনবো কি করে। ’
‘ না না চেয়ার কিনতে হবেনা। ’
‘ এই যে তুমি এসেছো। আমাদের খারাপ ভাবছো। ভাবছো গরিব, নিকৃষ্ট।
’
‘ গরিব হলেই কি মানুষ নিকৃষ্ট হয়?’
‘ সমাজ তো তাই মনে করে। ’
ও বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে আমি আমার কথা বলি, ‘ লিপিকে আমি বিয়ে করতে চাই। বিয়ে দেবেন?’
‘ কি করো তুমি?’ পাল্টা প্রশ্ন করেন লিপির মা।
‘ চাকরি করি। বি এ পাশ করে কেরানীর চাকরি করছি।
’
‘ ভালতো, আজকাল ক’জনের ভাগ্যে চাকরি জোটে। ’
‘ তা ঠিক। ’
‘ তোমার বাবা-মা কি আমার লিপিকে মেনে নেবেন?’
বললাম, আমি চাকরি করি। কেউ বাধা হয়ে দাড়ালে ওকে নিয়ে আমি আলাদা হয়ে যাব।
আমার কথা শুনে লিপি হাসে।
হাসিটা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। লিপির মা গভীর ভাবে কি যেন চিন্তা করেন। ওদের অভাবের সংসার। লিপির বাবা মারা গেছেন দু’বছর আগে। ভদ্রলোক ব্যাবসা করতেন।
জুলেখা পার্কের সামনে ছোট্ট একটা দোকান ছিল। দোকানের উপর সংসার চলতো। বাবা মারা যাবার পর বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলেন মা-মেয়ে। পৃথিবীতে ওদের আপন বলতে কেউ ছিলণা। কি করবেন ভদ্রমহিলা! লিপি শুধু বাবার জন্য কাদে।
ঘরে খাবার নেই। বেচে থাকার জন্য আরও অনেক কিছু দরকার। সেই দূর্দিনে হাসান এসে পাশে দাড়ায়। হাসান এম.এ পাশ বেকার ছেলে। লিপিদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে ওদের বাড়ি।
হাসানের বাবা রিকশা চালান। ছেলে অনেক বার নিষেধ করার পরও শোনে না। অভিমানের সুরে বলেন, খাবি কি! এম.এ পাশ করেছিস তুই তো আর রিকশা চালাতে পারবি না। একটা চাকরি জোগাড় কর। তোর চাকরি হলে কি তোর বাবা রিকশা চালাবে? দেখিস তখন আমার অনেক সুখ হবে।
হাসান ব্যাথা নিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। সেই হাসান যখন লিপির মাকে এসে বলে, খালাম্মা আপনাদের দোকানটা দেবেন আমাকে?
মহিলা ভেতর ভেতর খুশি হয়ে ওঠেন। একটা ভাল ছেলে। বলেন, ‘ বাবা দোকান তো বন্ধ বেশ কয়েকদিন। ’
‘ জানি, খালুজান মারা যাবার পর আর খোলা হয়নি।
আমি আপনাদের কথা অনেক ভেবেছি। ’
‘ চাবি নেবে?’
‘ হ্যা। ’ মাথা নিচু করে জবাব দেয় ছেলেটা। ‘ আপনাদের দোকান আপনাদেরই থাকবে, লাভের কিছু অংশ................’ হাসানের কন্ঠ দিয়ে বাকি শব্দগুলো বের হয়না। শব্দ গুলো বুকের।
বুকের মাঝেই উচ্চারিত হয়। লিপির মায়ের চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ঘর থেকে দোকানের চাবিটা হাসানের হাতে তুলে দেন। সেই থেকে হাসান লিপির একজন বড় ভাই। লিপির মায়ের এক সন্তান।
সেদিন রাতেই বাসায় ফিরে লিপিকে বিয়ে করার কথাটা স্পষ্ট বলে ফেলি। বাবার কাছে। বাবা সবকিছু শুনে বলে দেন, বিয়ে করলে করতে পার তবে এ বাড়িতে তোমার যায়গা হবেনা।
বাবার মুখের উপর কথা বলিনা। জানতে চাইনা কেন বাড়িতে যায়গা হবেনা।
ভেতরে ভেতরে আমার সিদ্ধান্ত অটল। পরের মাসে একটা বাসা ভাড়া করে লিপিকে বিয়ে করে ফেলি। কারও সাথে ঝগড়া ঝাটি ছাড়াই জীবন চলতে থাকে। দোতলার উপর দুই রুমের ফ্লাট। সামনে ছোট্ট একটা খোলা বারান্দা।
মাঝে মাঝে বারান্দায় দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখি। কাকে নিয়ে বৃষ্টি দেখলাম? রং-বেরংয়ের স্বপ্নের জাল বুনলাম!
চারভাজ করা কাগজটা হাতে নিয়েই রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। একটা ডাষ্টবিনে ফেলে দেব। কি সব লেখা! আমার চেতনাকে অস্থির করে তোলে। তোর কি পুরানো কথা মনে পড়ে? বিয়ের পর ভেবেছিলাম আমাকে ভুলে যাবি।
ভুলতে পারিসনি ভেবে খুব খুশি হয়েছি। বিয়ে হয়েছে তাতে কি আমাদের সেই সর্ম্পকটা কিন্তু থাকবে।
কোন সর্ম্পক? লেখার শেষে নাম নেই। ছেলেটা হাসান ছাড়া আর কেউ নয়। হাটতে হাটতে মাকে মনে পড়ে খুউব।
সেই কতোদিন মাকে দেখিনা। বাবাকেও না, ভাইকেও না। লিপির জন্য সব ছেড়েছি আমি। হায় লিপি আমার!
যখন বাড়ি পেৌছি তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ঢুকতেই বাবার সামনে পড়ি।
‘ কিরে কেন এসেছিস?’
‘ তোমাদের দেখতে এসেছি। ’
‘ কেন?’
‘ তাহলে কি চলে যাব?’
বাবা কি যেন ভাবেন। ‘ ঠিক আছে এক ঘন্টা থাকতে পারিস। তার এক মিনিটও বেশি থাকবি না কিন্তু। ’
‘ ঠিক আছে, এক ঘন্টা থাকবো।
’
মায়ের কাছে গিয়ে দেখি মা জায়নামাযে বসে কাদছেন। কেন কাদছেন কে জানে! আমাকে দেখে চোখ মোছেন। ‘ কি রে কেমন আছিস?’
‘ ভাল আছি মা। ’ জবাব দেই আমি।
‘ না, তোর মুখ কালো কেন?’
আমার মা এমন।
সেই ছোট বেলা থেকে এমন। আমার যদি মন খারাপ হয় ঠিকই ধরে ফেলেন। পৃথিবীর সব মা গুলোই হয়তো সন্তানের দু:খ অনেক দূরে থেকেও টের পান। অনুভব করেন।
‘ না, তেমন কিছু না।
তোমাদের কথা ভেবে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। এখন ভাল আছি। ’ আমি হাসতে চেষ্টা করি। মা আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কিছু পড়ছেন যেন।
আমি কি উপন্যাস! আমার মুখ?
মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে যায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা বাজে। মা বলেছিলেন, ‘ অনেক রাত হয়েছে আজ থাক। ’
‘ মা লিপি একা রয়েছে। ’
মা আর কিছু বলেন না।
আমাদের বাড়ি থেকে আমার ভাড়া ফ্লাটে রিকশায় করে আসতে আধা ঘন্টা সময় লাগে। রিকশায় বসে বসে ভেবেছি- আজ সারা রাত ধরে লিপিকে বোঝাব। লিপি এসব করতে নেই। আমি তোমার স্বামী। জানো আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি।
তোমাকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন। তোমার স্বপ্নগুলোর সাথে আর কাউকে জড়িও না। রিকশা থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে উঠছি। একটা সিড়ি, দুটো সিড়ি, তিনটে সিড়ি............। দরজার দিকে তাকাতেই অবাক হই।
তালা ঝুলছে চলে গেছে লিপি। যাক, যেখানে খুশি সেখানে যাক। আমার কাছের চাবিটা দিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢুকি। সবকিছু গোছগাছ। সুন্দর করে সাজানো গোছানো।
বিছানায় গা এলিয়ে দেই। ঘুম আসেনা আমার। শেষ রাতের দিকে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সাত সকালে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। ‘ কে?’ বিছানায় শুয়ে থেকেই প্রশ্ন করি।
‘ আমি। লিপি। ’
বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলি। আমার সামনে দাড়িয়ে আছে দু’জন মানুষ। মানুষ না অমানুষ! ওদের চার চার মোট আট পা হলে ভাল হতো।
আমার খুব রাগ হলেও মুখে হাসি টেনে বলি, ‘ কিছু ভুলে রেখে গেছ নাকি? তালাক দেবার আগেই রাত কাটানো শুরু করলে?’
‘ কি যা তা বলছেন ভাইজান!’ হাসান মৃদু প্রতিবাদ করে।
আমি সহ্য করতে পারিনা। আমার চোখ দুটো লাল হয়। ‘ সার্টআপ শয়তান। আর একটা কথা বললে আমি তোর জীব টেনে ছিড়ে ফেলবো।
’
‘ আমার একটা কথা শুনুন। ’ হাসান বড় বিনয়ের সাথে কথা বলে।
‘ কিসের কথা শুনবো আমি! তোদের রাত কাটানোর গল্প?’ আমি আরও ক্ষিপ্ত হই। ‘ বের হ কুত্তার বাচ্চা। ’
আমার কথা শুনে হাসান এক মুহুর্ত দাড়ায় না।
লিপি মাথা তুলে আমার দিকে তাকায়। মলিন কন্ঠে বলে, ‘ আমিও?’
‘ হ্যা, গো আউট। চিরদিন, চিরকালের জন্য তোমাকে তালাক দিলাম। ’
লিপির চোখটা ভিজে ওঠে। মায়াকান্না দেখাচ্ছে।
দুটো অমানুষকে দরজা থেকে তাড়িয়ে দেই। ঠিক কাজটাই করি আমি। তারপরও কেন যেন কষ্ট হয়। কষ্টটা লিপির জন্য। ওর সাথে আমার সুখ-দু:খের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
মে মাসেই ফ্লাট ছেড়ে বাড়ি গিয়ে উঠি। মা খুশি, বাবা খুশি। বাবা দরাজ কন্ঠে বলেন, আমি জানতাম এমন হবেই। ওদের কালচার আর আমাদের কালচার কি এক! ফুটপাতের, বস্তির মানুষ গুলো কি মানুষ?
প্রশ্নটা আমারও হয়তো অমানুষ অথবা বেশিমানুষ। অমানুষ হলে এজন্যই অমানুষ যে, আমরা ওদের মানুষ ভাবতে শিখিনি।
বাবা-মা আমাকে আর একটা বিয়ে দিতে চান। বিয়ে করার কোন ইচ্ছা আমার নেই।
তার অনেক দিন পরের ঘটনা। মাস ছয়েক হবে। লাঞ্চের পর আমি অফিসে বসে ঝিমাচিছ।
খোরশেদ আসে। আমার কলিগ। একসাথে কয়েক বছর কাজ করছি। খুব খাতির তার সাথে।
আমার হাতে একটা চিঠি দেয়।
বলে, ‘ দোস্ত দেখতো বানান ভুল আছে নাকি। আমি বদলি হয়ে গ্রামের বাড়ি যেতে চাই। দরখাস্ত। ’
ওর মুখের দিকে চেয়ে বলি, ‘ গ্রামে যাবি কেন?’
‘ আর কতোকাল বাইরে থাকবো? গ্রামে গেলে সুবিধা হয়। ’
‘ কি সুবিধা?’
খোরশেদ হাসে।
‘ সে তুই বুঝবি না। বউ নিয়ে থাকিস। মজার সংসার। হা হা হা......’
আমার কন্ঠ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। মজার সংসার।
লিপির প্রতারনার কথা আমি কাউকে বলিনি। কউকে বলা যায়না।
বউ আর সংসারের কথা উঠতেই খোরশেদের কি একটা কথা যেন মনে পড়ে যায়। চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ ওহ্ হো বেমালুম ভুলে গেছি। কি হলো......?’
আমি কিছু বুঝিনা।
প্রশ্ন করি, ‘ কিসের কথা বলছিস?’
‘ ওই যে মজা করে তোর পকেটে একদিন একটা চিঠি ভরে দিয়েছিলাম। ’
‘ তুই দিয়েছিলি?’
‘ হ্যা, কেন ভাবী পায়নি?’
‘ পেলে কি হতো?’ খুব ঠান্ডা আমার কন্ঠস্বর।
ভারী মজা হতো। ভাবী ভাবতো তোর সাথে কোন মেয়ের সর্ম্পক আছে। তোকে আচ্ছামত ঝাড়তো।
তুই অফিসে সব বলতি। আমি হাসতাম। ’ থোরশেদ আবার হাসে। আমার রাগ প্রতিটি রক্ত বিন্দুর সাথে মিশে মিশে আমাকে হিংস্র করে তোলে। আমি খোরশেদের লেখা বদলির আবেদন পত্রের দিকে তাকাই।
একই হাতের লেখা। কম্পিউটারে কাজ করে বলে ওর হাতের লেখাটা দেখার তেমন সেৌভাগ্য হয়নি আমার। সেদিনকার সেই চিঠিটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। স্পষ্ট হয়। আমার পকেট থেকে কাগজটা সম্ভাবত লিপিই বের করে ড্রয়ারে রেখেছিল।
ও যখন আমার কাপড় ধোয় তখন পকেটের কাগজপত্র গুলো সুন্দর করে ড্রয়ারে রেখে দেয়।
আমি আমার ছিট ছেড়ে উঠে দাড়াই। একেবারে খোরশেদের সামনে গিয়ে দাড়াই। ওর দুই পাশের দুই চোয়ালে শক্ত হাতে দুটো চড় মারি। ওর মুখে দশ আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট হয়।
খোরশেদ কিছু বুঝে উঠতে পারেনা। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে থাকে। আমি এক সেকেন্ডও দাড়াই না। আমাকে জুলেখা পার্কের পাশে সেই ছোট্ট কুড়েটায় যেতে হবে। তখন বিকাল।
ঠিক এ রকম এক বিকালে ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সূর্যটা স্নিগ্ধ লাল আলো বিলাচ্ছে। কি পবিত্র নীলাকাশ। লিপিদের বাড়ির সামনে গিয়ে ডাক দেই, লিপি লিপি।
আমার ডাক শুনে মেয়েটা দেৌড়ে আসে।
দরজার সামনে এসে থমকে দাড়ায়। কি পবিত্র, স্নিগ্ধ একটা মুখ। ব্যাথায় ভরা।
আমি এগিয়ে যাই। ‘ মা কোথায় লিপি?’
লিপি অনেক সময় কথা বলতে পারেনা।
চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মাটি ওর চোখের পানি চুষে নেয়।
‘ মা কোথায় লিপি?’ আবার প্রশ্ন করি আমি।
লিপি এবার বলতে শুরু করে, সেদিন বিকালে হাসান ভাই গিয়ে খবর দেন মা পৃথিবী ছেড়ে প্রভুর কাছে চলে গেছেন। সারাদিন আপনার মোবাইল বন্ধ।
অনেক বার কল দিয়েছি। তারপর রাত দশটা পর্যন্ত আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। আপনি আসলেন না। ভাবলাম আপনি হয়তো রাতে আর আসবেন না। সকালে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলেন।
কেন মেরেছিলেন জানিনা। স্বামী তার স্ত্রীকে শাষন করতেই পারে। ভেবেছিলাম আপনার রাগ কমলে শুনবো। দুর্ভাগ্য তা আর শোনা হয়নি। মাকে বিদায় করে যখন আপনার কাছে গেলাম তখন আপনি আমাকে বিদায় করে দিলেন।
লিপি থামে। আমি আবেগ সামলাতে পারিনা। শব্দ করে কেদে উঠি। ‘ আমাকে মাফ করো লিপি। ’ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি।
এক ঝটকায় লিপি আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। বেশ জোরের সাথেই বলে, ‘ আমাকে ছোবেন না। ’
আমি অবাক হই। ‘ কেন!’
‘ সে অধিকার আপনার এখন আর নেই। ’
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
সব ক্রোধ সেই ভাঙ্গা আকাশের চাপায় পিষ্ট হয়, বিলীন হয়। মনে হয় আমিও বিলীন হয়ে যাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।