আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিনলিপি ৯: ঈর্ষা এবং ক্রোধ



ঠিক কোন সময়ে সমস্ত পৃথিবীর উপর বিরক্ত ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি সেটার একটা প্যাটার্ন আজকাল বের হচ্ছে। যেটা মনে এলো সেটা মানুষ হিসেবে নিজেকে বেশি একটা উঁচু স্তরে বসায় সেই দাবী করতে পারছি না,কিন্তু সত্যিটা এটাই যে যখনই কোন কাজে তথাকথিত অভিজাত এলাকা,যদিও অভিজাত শব্দটার প্রচলিত অর্থের সাথে আমার পুরোই দ্বিমত আছে,সেক্ষেত্রে বলি যে জাঁকজমকপূর্ণ এলাকাতে ঢুকি,তখনই চড়াক করে মেজাজটা একলাফে তালগাছের মগডালের দিকে রওয়ানা করে। এক্ষণে এই এলাকাগুলোর মাঝে কারা আছে সবাই জানলেও একটু স্মরণ করিয়ে দিই পুণর্বার,মানে গুলশান ধানমন্ডি বনানী বা বারিধারার বাসিন্দারা মনে কষ্ট নিলেও নামগুলো বলে তাদের জাঁক এবং জমকঠমকত্বের পরিচয়টা এবেলা দিয়ে দেয়াটাই ভাল মনে করি,এবং তাদের আভিজাত্যের ফান্ডা করে দেয়ার জন্য আগাম ক্ষমাও প্রার্থনা করি। কথা হলো ঠিক কি কারণে ঠমকপূর্ণ এলাকাগুলোতে গেলে একজন আধা বেকারের দুনিয়া ধ্বংস করার মত ক্রোধের উন্মেষ ঘটতে পারে। জবাবটা নিন্দুকরা দেয়ার আগেই বলে দিই,ঈর্ষা,বুঝলেন,বিশুদ্ধ ঈর্ষা।

মানে কিনা সুযোগ পেলে এই আধা বেকারও সেই একই ক্ষুরে মাথা মুড়াতো আর বাপের পয়সায় সুন্দরী বগলদাবা করে ঘুরতো সন্দেহ নেই,কিন্তু সুযোগ যখন নেই তখন একটা দামী ল্যান্ড রোভার কি একটা দামী বাঘা টাইপ কেলে কুত্তা বা তারচেয়েও দামী পুতুলসুন্দরী কোলে বসিয়ে সাঁ করে চাকা ঘুরিয়ে হর্ন বাজিয়ে ছুটে যাওয়া সেটওয়েট জেল ডিজুস নন্দনকে যে কেলে কুত্তা দিয়েই খাওয়াতে ইচ্ছা করবে তাতে আর বিচিত্র কি? ঘটনার সূত্রপাত দুপুরবেলার একটু আগে থেকে। একটা সরকারী অফিসে অকাজে ফাউ ঘুর্ণি দিতে হলো একটা,তারপর ফার্মগেট,যেটাকে ঢাকার জাহান্নাম বলা যায়,সেখান থেকে বারিধারা যাত্রা দিয়ে মেজাজ টঙে ওঠার পালা শুরু। কাওরানবাজার পার হয়ে বাংলা মটরে রোদের মাঝে ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরে কাঁঠাল বোঝাই একটা বাস পাওয়া গেল,সেটাতে ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই সমঅধিকারের মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে একজন আরেকজনের ঘাড়ে চেপে দাঁড়িয়ে আছে,বরাবরের মতই উদাস দৃষ্টি। এমন নির্বিকার থাকা কত জন্মের সাধনার ধন জানি না, নিজে এখনো হতে পারিনি, খালি উসখুস করি ভিড়ের মাঝে আর হাতের টিকিট দিয়ে কপালের ঘাম মুছি। সাথে ঢাকাবাসীর সহ্যক্ষমতারও প্রশংসা করি,আফ্রিকার শান্তি মিশনে যে বাঙ্গালির এত সুনাম সেতো আর এমনি এমনি নয়; ঢাকার যাতায়াতে হাফ কমান্ডো ট্রেইনিং হয়ে যাবার কথা।

নতুনবাজার আমেরিকান অ্যাম্বেসি পার হয়ে বাস নদ্দা বাজারে নামিয়ে দিয়ে ঢেকুর ঢুকুর করে চলে যায়। এবার গন্তব্যে যেতে হবে। বাপস,৭ ফিট উঁচু বিশাল দেয়াল। কে হে মহারাজা তুমি অন্দরে কিরণ ছড়াইছো? তোমার রাজকন্যা কি অসূর্যস্পশ্যা? এদিকে একটা গেট থাকার কথা,পাই না। এইবারে সামলাও,পুরো ১ কিলো হেঁটে নতুনবাজার যাও,আবার গেট ঘুরে ১ কিলো হেঁটে এদিকেই ফিরে এসো।

বিরস বদনে রওনা করি, আশপাশে তাকাতে থাকি ফাঁকফোকড় আছে নাকি গলে যাবার। নেই,মহারাজারা তাহাদের দূর্গপ্রাকারে ফোঁকড় রাখে না,পাছে হার্মাদ ঢুকে পড়ে। বিশেষ করে,ভুখা হার্মাদ বড় ভয়াবহ,খালি চোখে আঙ্গুল দিয়ে মহারাজদের বিবেকের দৈন্য দেখিয়ে দেয় আর লেক্সাস টয়োটার ঝাঁককে ব্যঙ্গ করে কিনা। মাঝে মাঝে ২-১ টা গাছ দেখা যায়,ফুটপাথের কংক্রিট বাঁচিয়েও দেয়াল ঘেঁষে কিভাবে যেন টিকে গেছে। দেয়ালের এপাশের জীবন অহর্নিশ দেখি,১টা পাম্পার নিয়ে বসে থাকা রিকশা মিস্ত্রি,ক্যানভাস বা চট বিছিয়ে পোকামাকড়ের ঘরবসতি,মুড়ি-চানাচুরের ঝাঁকা।

ভোঁ-ভাঁ কানফাটানো হর্নে সিটিবাস আর ধুমধাম বডি থাবড়ানো লোকাল বাসের হেলপারের চিৎকার। ২-১টা গাছের গায়ে দেখি গজাল পোঁতা,পা লাগিয়ে লোকজন দেয়াল পার হচ্ছে,বৃক্ষ তার শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে মানবজাতিকে তরিয়ে যাচ্ছে। নতুনবাজারের কাছে এসে দেয়াল ঘুরে ঢুকে রিকশার খোঁজে তাকাই। কপাল ভালো হবার কথা না,একটা রিকশাও নেই,হাঁটো এবার। খানিক হেঁটে বামে তাকাই,৮ নম্বর বাড়ি।

সর্বনাশের কথা,যেতে হবে ৮৭ নম্বরে। পিছন থেকে বিকট হর্ন শুনে লাফিয়ে সরে যাই,বিড়বিড় করে অশ্রাব্য গালি দিই,গাড়ি থাকলেই কেন যে অকারণে হর্ন বাজায় লোকজন কে জানে! দেখো,আমার একটা গাড়ি আছে,ওহে পদসম্বলধারী,দূরে দূরে থাকো,নাকি? নাকি শুধু অহেতুক ঈর্ষা,ঐ চোখা জুলফির পাশের রঙিন চুলো হরিণী আমার পাশে নেই বলে? তা কেউ তো মানা করেনি,হয়ে যাও এমন একটা গাড়ির মালিক,যেভাবে হয়েছে সেটওয়েটের বাপ,পিষে দাও সামনের সবকিছু,দেখাও সারভাইভ্যাল অভ দ্য ফিটেস্ট এর সার্থক প্রয়োগ,কে মানা করছে? মানা কেউ করেনা,তবে মানতেও পারিনা,যেমন হয়তো ভাল স্কুলে,বা একেবারেই স্কুলে পড়তে না পারা বংশানুক্রমিক রাস্তার ছেলেগুলো মানতে পারেনা আমার রিকশাতে চড়া। অক্ষমের ক্রোধ? হলিউডের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন ডাউনটাউন তরুণও হয়তো জোরে জোরেই গালি দিয়ে বসে বিশাল প্রাসাদপ্রতীম বাড়িতে দেয়ালঘেরা নক্ষত্রদের,আবার হয়তো তারই অটোগ্রাফ নিতে লাইন ধরে মারপিট বাঁধায়; ঠিক যেমন মাঝে মাঝে আমি বা আমরাও একটা চাকরির খোঁজে বিনয়বিগলিত স্যার স্যার বলে মাথা নুইয়ে ডিগ্রি পানিতে ভাসিয়ে দিই গাড়িওয়ালা অসভ্য শোষকের সামনে। তবে ডাউনটাউনের তরুণরা,গীনসবার্গের বীট জেনারেশন ধনিক শ্রেণীর শ্রাদ্ধ করে কবিতাকে বেছে নিতে পারে এক জীবন কাটিয়ে দেয়ার সাধনা হিসেবে,আমি কিন্তু দু'টো পয়সা আর একটা বউ নিয়ে গাড়ি চড়ার স্বপ্নে আমার কবিতাকেই বিলিয়ে দিতে পারি অনায়াসে। গুরু গীনসবার্গ,কবিতা পড়িয়েছো,মানুষ করতে পারোনি।

সামনে থেকে আসা একটা ক্লুগার হর্ন দেয়, আবারো চিন্তা ভাঙে, আবারো রক্তচক্ষু করে গালি দিই,আফসোস,কলিকাল,ড্রাইভারের কানেও পৌঁছে না গায়েও আঁচ লাগেনা,ধুলো খাইয়ে চলে যায় পাশ দিয়ে। গুলশান বনানী ধানমন্ডিতে এই ধুলো বারবার খেয়েও ঠিক অভ্যস্ত হতে পারিনি এখনো,গায়ে যখন পানি ছিটিয়ে চলে যায় তখন ইচ্ছা হয় সবক'টাকে ধরে পশ্চাতে বাঁশ ঢোকাই। হিংসা,হিংসা,সবই হিংসা। এখন যেমন টোকাইগুলোর সাথে আমিও হেলভেশিয়ার ঠাণ্ডা হাওয়ার মোলায়েম আলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি,সেই লোকজনের সাথে এক কাতারে মিশে যাই,আমার পকেটের বাসভাড়াটা যাদের এক বেলার জীবন। তবে ওখানে ঢুকতে পারলেই চোখে কালো চশমা পরে আমিও প্রেমিকার মুখ ছাড়া কিছুই দেখবো না কসম কেটে বলা যায়।

কিন্তু আপাতত পকেট খালি,কাজেই আইইউবি নামের তথাকথিত ভার্সিটি থেকে মাজাঘষা চকচকে ছোঁড়াছুঁড়িগুলোর ঢঙ্গী হাসাহাসি ঢলাঢলি দেখে আরো দু'টো গালি দিয়ে নিই। একটু করুণাও বোধ করি,সারাটা জীবন ব্যাটারা গাড়ি হাঁকিয়েই গেলি,চিপার মাঝে এক দালানে কি যে বিদ্যা অর্জন করলি নিজেরাই জানিস না। খোলা আকাশের নিচে আড্ডা নেই,ঠাণ্ডা হাওয়াতে মগজে কিছু সমীকরণ আর ব্যবসাবিদ্যা ঢুকতেই পারে তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞাতে ওরকম শিক্ষা দেয়ার কথা ছিল কিনা জানা নেই। যাকগে,মরুক,তুমি বাপ এসির হাওয়া খেতে পারোনা তাই ঈর্ষা হয়েছে,এখন আঙ্গুর ফল টক আর গাছের মালিক চোর,না? ৮৭ নম্বরে পৌঁছে যাই,নিচে দাঁড়িয়ে ফোন দিই,বড় ভাই জানায়,আসছে। অস্বস্তি বোধ করি একটু,একে জামাকাপড়ের অবস্থা সুবিধার না,তার উপর ৩ বার বাস বদলে ধুলো খেয়ে চেহারাটাও খোলতাই হয়েছে,পাশের রেস্টুরেন্টে দল বেঁধে ঢোকা হাস্যোজ্জ্বল ডিজুসদের সামনে কেমন যেন বেমানান।

আবার গালি দিই,মুখ খারাপ হয়ে যাচ্ছে আজকাল, এভাবে দেখার কি আছে রে? স্কলাস্টিকার সামনে দিয়ে যেতে হয় রোজ,সেখানকার মোটাসোটা বার্গার মুখে আরো ২টা বার্গার হাতে ধরা নাদুস পোলাপান গুলোও দোকানের বাইরে দাঁড়ানো টোকাইদের দিকে এমন কৌতুক আর কৌতুহল মেশানো চোখেই তাকায়,ভাবখানা,আমাদের স্বর্গরাজ্যে এ কোন উৎপাত প্রবেশিলো প্রভো? ঠিক তখন,রাস্তার ছেলেগুলোর কি আমার মতই গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে সামনের ঐ দালানটা, আগুনে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করে রূপালি রঙের গাড়িটা,সেই গাড়িটা যার আরোহিনীর মেকআপের পয়সায় তার সারামাসের খোরাকি হয়ে যাবে,যে কিনা ডার্টি পিপল বলে তার বাড়ানো হাতের সামনে কাচটা তুলে দেয়?নাকি পরক্ষণেই আমার মতই ঐ রূপালি গাড়িটায় একদিন আমিও চড়বো আর নিয়ন আলোয় তার হাত ধরে অভিসারে বেড়োব ধাঁচের বস্তাপচা চিন্তায় আচ্ছন্ন হয় মন? বড় ভাই যখন কাগজপত্রগুলো হাতে দিচ্ছিলো,ঠিক তখনো ভাবছিলাম আমরা এক কদমও এগোইনি,খুব পুরানো সেই ভাবসম্প্রসারণের মতই যাদের পেছনে ফেলে আমরা সামনে চলে যাচ্ছি তারা আমাদের পেছনে টানছে। উপরে,আরো উপরে উঠে যাচ্ছে একদল,সাথে যারা ছিল তাদের লাথি মেরে,ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে। নীতি,দূরের বিষয়,অভিজাত এলাকায় বাড়িগাড়ি করতে ওসব ভাবলে চলে না। আমার ছেলে আমেরিকা যাবে,আমার মেয়ে রঙিন আলোয় ডিনার করবে,বউ করবে মালয়েশিয়াতে ট্রুলি এশিয়ান শপিং আর আমি রঙিন পানি খেয়ে মজুরের পয়সা মেরে বিদেশি ডেলিগেটকে সোসাইটি গার্লের স্মার্টনেস দেখিয়ে ব্যবসা বাগাবো,একটাই তো জীবন,মেরেকেটে ধুম ফূর্তি করে যাও,রেডিও ফুর্তি জিন্দাবাদ। বোধ করি একটা পল্টনি ভাব এসে গেছিলো চেহারায়,বড় ভাই দেখলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

তাড়াতাড়ি কাগজগুলো নিয়ে ধন্যবাদ দিই,তারপর বের হবার রাস্তা খুঁজি। পাওয়া গেছে রে,বাড়িটার সামনে দেয়ালে দু'টো ফোঁকড়,ছেঁড়া জামা পরা দুটো দেবদূত অনেক কষ্টে পার হয়ে এলো। আহ,ঐ মুখ দু'টো একটু ধুয়ে মুছে দিলে জনসন বেবিগুলোও হিংসা করতো। হাত বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে, মেকি সভ্যতা ভেতর থেকে বাধা দেয়,ন্যাকামির সময় নেই,দৌড়া ব্যাটা। পেছনে তাকাই,গাড়িটার সামনে ক'টা স্মার্টি ছেলেমেয়ে জটলা পাকাচ্ছে।

টপকাবো? ভাববে কি? আবার তাকাই। দুত্তোর,ব্যাগটা আড় করে ঘাড়ে ঝুলিয়ে ফোঁকড় দু'টোয় পা ঠেকিয়ে উঠে পড়ি। বাহ,এখনো নষ্ট হইনি,এখনো ৭ ফিট দেয়ালে একটানে উঠে যেতে পারি। দেয়াল থেকে লাফিয়ে নামি অপর পারে,চেনা জগতে,ধুলোর মাঝে। পেছন থেকে কে যেন কি বলে উঠেছিলো,শুনি নি,কে যায় শুনতে? এই লেক্সাস সভ্যতার আমি খেতা পুড়ি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।