আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মস্তিস্কের সীমাবদ্ধতা ও সত্য জানার পথ



এ জগতে পৃথিবী একটি অতি ক্ষুদ্র স্থিতি। এই স্থিতির মধ্যে মানুষ একটি প্রাণী। এই মানুষের আছে মস্তিস্ক। এই মস্তিস্ক দিয়ে মানুষ বোঝে। এক এক মানুষের বোঝার মতা এক এক রকম।

এটা মানুষের মস্তিস্কের মতার উপর নির্ভর করে। এ জগতে আরো অনেক প্রাণী আছে। তাদের রয়েছে মস্তিস্ক। তারাও তাদের মস্তিস্ক দিয়ে বোঝে। তারা কি বোঝে, কি বোঝে না, আমরা তা বুঝি না।

কেন না আমাদের সাথে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম জানা নেই। মানুষ একের সাথে অন্যের বোঝার বিষয় বিনিময় করে ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে। অন্য প্রাণীর ভাষা আমাদের জানা নেই। ভাষার দুই অংশ। কথ্য ও লিখিত।

আমরা যদি ‘দই’ লিখি বা বলি তাহলে এটা প্রকৃত দই নয়। এটা হলো ‘দই’ এর কথ্য বা লিখিত রূপ। ‘দই’ এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেও তা ‘দই’ খাওয়ার মাধ্যমে প্রকৃত যে অভিজ্ঞতা হয়, তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। এভাবে আরো গভীর অভিজ্ঞতার কথা বললে এ কথাই বলা যাবে যে, অভিজ্ঞতা ভাষার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ বোঝানো সম্ভব না। দার্শনিকগনের প্রশ্ন- আমরা যে উদ্দেশ্যে ভাষা ব্যবহার করি, সে উদ্দেশ্য পূরণ হয় কি না? ভাষার মাধ্যমে ‘জ্ঞাপন’ অর্থাৎ অভিজ্ঞতা বিনিময় আদৌ সম্ভব কি না? ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা কে দু’ভাগে ভাগ করে কেউ বলেন ‘আধার’ জ্ঞাপন করা যায়, ‘আধেয়’ যায় না।

সহজে বলা যায়, আমরা অভিজ্ঞতা বিনিময় করি না, করা যায় না, অভিজ্ঞতার ভাষ্যরূপ বিনিময় করি। টেলিফোনে কান পাতলেই বন্ধুর স্বর চিনি। যেভাবে বন্ধুকে চিনি, তা কি হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও অন্যকে এ পর্যায়ে নেয়া সম্ভব যে, তিনিও আমার বন্ধুকে চিনবেন? ভাষা বা জ্ঞাপনের এ সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই মানুষের মস্তিস্ক চর্চিত জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষের সমবায়ে গঠিত হয়েছে মানবীয় জ্ঞান ব্যাংক। আবার মস্তিস্কে ফিরে যাই। মস্তিস্ক একটি অঙ্গ।

মানুষ তার বিভিন্ন অঙ্গ সম্বন্ধে ভাবে মস্তিস্ক দিয়ে। আর মস্তিস্ক সম্বন্ধে ভাবে এই মস্তিস্ক দিয়ে। মস্তিস্ক সম্বন্ধে ভাবার জন্য তার কাছে মস্তিস্ক ব্যতিত অন্য কোন প্রযুক্তি নাই। মানুষের জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞান তার মস্তিস্কের শক্তির পর নির্ভর করে। এখন থেকে হাজার হাজার বছর আগে মানুষের মস্তিস্ক অনেক কম উন্নত ছিল।

এখন থেকে হাজার হাজার বছর পর মস্তিস্কের মতা আরো উন্নত হবে। হাজার বছর আগে মানুষ তার মস্তিস্ক দিয়ে যা বুঝতে পারতো তাকেই চর্চা করে বাড়িয়ে তার মস্তিস্ককে এগিয়ে নিয়েছে উন্নতির পর্যায়ে। না কি মস্তিস্ক চর্চাবিহীন আপনা আপনি উন্নত হয়েছে বিধায় মানুষ তার সেই উন্নত মস্তিস্ককে উন্নত চিন্তার জন্য কাজে লাগাতে পেরেছে, তা স্বতসিদ্ধ নয়। আমরা দেখি যে, ব্যয়ামের মাধ্যমে আমরা যেভাবে গতি তৈরি করি আমাদের মাংশপেশি সেভাবে উন্নত হয়। চিন্তা মস্তিস্কের ব্যয়াম।

তাই চিন্তার পথ ধরে মস্তিস্ক এগোয় বলে ধরে নেয়া যায়। আমাদের চিন্তা আদিতে যে দিকে ছিল, সেই চিন্তা মানুষের মিলিত ধারায় এগিয়ে গিয়ে তৈরি করেছে আজকের মানবীয় জ্ঞান ভাণ্ডার। মস্তিস্কের উন্নয়নকে আমরা ‘উন্নয়ন’ বললেও তা কেবল প্রকৃতপে একটি নিদৃষ্ট দিকে পরিবর্তনের নামান্তর। এই পরিবর্তনশীলতা কখনোও একটি স্বতসিদ্ধ চুড়ান্ত সত্য, যার উপর ভিত্তি করে এ জগৎ প্রতিষ্ঠিত তাকে আয়েত আনা সম্ভব নয়। কাজেই মানুষের মস্তিস্কের জ্ঞান দিয়ে জগৎ বোঝার চেষ্টা কেবল ‘মানুষের মস্তিস্ক দিয়ে জগৎ বোঝা’কেই বোঝাবে, প্রকৃত জগৎ বোঝাকে বোঝাবে না।

যেমন ভাষার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় ‘ভাষার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময়’কে বোঝাবে ‘অভিজ্ঞতা’কে নয়। অন্যকথায় কথ্য বা লিখিত ভাবে ‘দই’ কথাটি লিখলে বা বললে তা কখনোই প্রকৃত ‘দই’র সাথে কোনমতে সম্পর্কযুক্ত কিছুকেই উপলদ্ধির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে পারবে না। বলাই বাহুল্য, এখানে মস্তিস্ক চর্চিত জ্ঞান কে ফেলনা ভাবা হচ্ছে না, বরং সাধারণ মানুষের এটাই জ্ঞান অর্জনের পথ। এই জ্ঞান দিয়েই মানুষ পৃথিবীকে আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে নিয়ে এসেছে। আবিস্কার করেছে এতকিছু সুযোগ সুবিধা।

যে পথে মানুষ এই পরিবর্তন অর্জন করেছে, আরো সহজে অন্যকোন পথে তা অর্জন করা যেত না এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আর পৃথিবীর বর্তমান পরিবর্তনে মানুষই যে একমাত্র পারঙ্গম আর কেউ নয়, এটাও ঠিক নয়। মানুষের বিপরীতে যে এক কোষী প্রাণীদের আমরা চিনি অর্থাৎ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, যাদেরকে মারার জন্য আমরা বোমার মত ওষুধ নিপে করি, তারা তার বিপরীতে নিজের দেহে এমন পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে যে, তারা নিজেরা তো বাঁচেই বরং তার বদলা নেয় শত্র“ মানুষের উপর। মানুষ সেই ভাইরাসের আক্রমনে আর কোন অস্ত্র খুঁজে পায় না, এইসব ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচতে গিয়ে সম্পদ খুয়ে পৃথিবীর মানুষ দেউলিয়া হয়ে যায়। মানুষের দেহের ভিতর ভাইরাস এমন ক্রিয়া করে যে, মানুষের জীনে পরিবর্তন হয়ে দেহ পরিবর্তিত হয়, স্বভাব পরিবর্তিত হয়, নানান রোগের সৃষ্টি হয়।

এভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে এ পৃথিবীকে এ পর্যায়ে এনেছে। অপরদিকে মানুষ প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলেছে কৃত্রিম বস্তর আমদানি করে। যে বিজ্ঞানের প্রভাব বর্তমানে এত উল্লেখযোগ্য সে বিজ্ঞানই বিশ্ব রহস্য সম্বন্ধে কি বলে তা দেখা যাক। বর্তমান সময়ের জীবিত কিংবদন্তী স্টিফেন হকিং যিনি কিছুদিন আগে ইশ্বর নেই বলে তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন, তিনি কি বলছেন তা হুবহু তুলে ধরছি-‘ মহাবিশ্ব এমন একটি নিয়মে বাধা, সে নিয়ম আমরা এখন অংশত বুঝতে পারি এবং অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা সম্পূর্ণ বুঝতে পারবো। হতে পারে এই আশা নেহাতই মরিচিকা।

চরম তত্ত্ব হয়তো কিছুই নেই, থাকলে হয়তো সেটা আমরা খুঁজে পাবো না, কিন্তু মানুষের মন সম্পর্কে হতাশ হওয়ার চাইতে সম্পূর্ণ বোঝার চেষ্টা করা অনেক ভালো। ’ বিজ্ঞান সৎ। মিথ্যা বলা তার ধাতে নেই। এজন্যই বিজ্ঞান যে স্থির হয়ে কিছু বলতে পারবে না, তা প্রকাশ করে ফেলতে চায় বিনা দ্বিধায়। সৎ ও সজ্জন স্টিফেন হকিং যেভাবে আশা করেন চরম তত্ত্ব খুঁজে পাবার সেভাবেই নিরাশা ব্যক্ত করেন খুঁজে না পাবার।

হকিংয়ের যখন এই অবস্থা তখন ইশ্বর নেই তার এই উক্তি কতটুকু যথার্থভাবে আমরা গ্রহণ করবো তা সহজেই অনুমেয়। বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়েই সৎ। তবে তারা যে জ্ঞান আমাদের কাছে নিয়ে আসে তা মস্তিস্ক চর্চিত, শ্রমিকের মত, কুস্তিগীরের মত ঘাম ঝরিয়ে পাওয়া জ্ঞান এবং চরম কোন সত্যের বিষয়েই তাদের বক্তব্য নিঃসংশয় নয়। বিজ্ঞান যতটুকু জানে তার বেশি জানে না বলে স্বীকার করে এবং এ কথাও বলে যে তার পরিবেশিত তথ্য পরিবর্তনীয়। তত্ত্ব থেকে তত্ত্বে লাফানো তার স্বভাব।

দার্শনিকগণও বিভক্ত এবং তারা নিঃসংশয় নন। পরিবর্তনীয়। তত্ত্ব থেকে তত্ত্বে লাফানো তার স্বভাব। দার্শনিকগণও বিভক্ত এবং তারা নিঃসংশয় নন। এদের বিপরীতে জ্ঞানের আরেকটা ফ্যাকাল্টি রয়েছে যা সৃষ্টি অবধি চালু আছে।

নবীগণ এই জ্ঞানের বাহক। তারা তাদের জ্ঞানকে মস্তিস্ক চর্চিত নয়, বরং পরম প্রভুর কৃপায় প্রাপ্ত বলে দাবী করেন। এটা মস্তিস্ক কর্ষিত হয়ে নয় বরং মস্তিস্কে জমা হয় মাত্র। যাকে এলহাম বলা হয়। প্রাথমিকভাবে ভাষায় তা বর্ণনা করা হলেও প্রকৃতপে তা তাদের অনুগামীদের মধ্যে বিনিময় হয় এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক ধারায়।

সর্বশেষ নবীনেতা (স.) এই জগৎ সম্বন্ধে যা দাবী করেন, এ সম্বন্ধে তিনি তা শতভাগ নিঃসংশয় হয়েই দাবী করেন। এতো নিঃসংশয় যে এ জগতে তাঁর তুলনা হয় না। হাজার বিদ্রুপ- বিরোধিতাকে তিনি উড়িয়ে দেন। নবী (স.) মেরাজের বিবরণ তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.) এর কাছে প্রথম বর্ণনা করলে তা শুনে আয়েশা (রা.) এটা প্রচার করতে বারণ করেছিলেন। তা সত্বেও সকল বিরূপতাকে বিন্দুমাত্র আমলে না এনে তিনি নিঃসংকোচে তা প্রচার করেন।

জগৎ রহস্যের যে ‘মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব’ স্টিফেন হকিং আজও খুঁজে ফিরেন, খুঁজে পাওয়ার আশা করেন, আবার সংশয়ও প্রকাশ করেন, তাঁর ভাষায় যেই তত্ত্ব হবে সুষ্ট এবং সংপ্তি, সর্ব প্রশ্ন সমাপ্তকারী ও সরল, তা নবীগণ স্রষ্টার ধারণার মাধ্যমে অতি সরলভাবে উচ্চারণ করেন। অহি’র জ্ঞান হলো অলৌকিক। তা যে ব্যাক্তি অর্জন করে তার শক্তি তখন অপরিমেয় হয়, মরা ও বাঁচার ব্যাপারে হয় ভ্র“পেহীন, চাই জগৎ গ্রহণ করুক কি না করুক। তিনি তখন হয়ে যান সত্যের এক অনন্য উদাহরণ। নিংসকোচ, নিঃসংশয়, সুদৃঢ়।

অপরদিকে বিজ্ঞানীগণ যা বলেন তা স্টিফেন হকিংয়ের মতোই সংশয়যুক্ত, খণ্ডিত, আশা ও হতাশায়, পাওয়া ও না পাওয়ায় মিলেমিশে এক জগা খিচুড়ি। দার্শনিকগণও তেমনি। এখন এই তিন ধরণের ফ্যাকাল্টির মধ্যে কোনটি গ্রহণ করে নিব আমরা তাই আমাদের জন্য বিবেচ্য। যিনি একশ’বার নিশ্চিত হয়ে বলছেন তার কথা না যারা সংশয় নিয়ে বলছেন অথবা আংশিক বলছেন অথবা আংশিক পরে এসে বলবেন বলছেন, তার কথা। বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের প থেকে একটি মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিস্কার না করেই নবীগণের প থেকে নিঃসংশয়ে কঠিণ দৃঢ়তায় উদ্বৃত কথাকে উড়িয়ে দেয়া নিতান্তই অযৌক্তিক।

মস্তিস্ক চর্চার মাধ্যমে সর্বোচ্চ উত্তোরন এতটুকুই ঘটানো যায় যে, এ জগতের রহস্য মস্তিস্ক চর্চার মাধ্যমে সম্ভব নয়। ‘আমি পথ চিনি না... যিনি পথ চিনেন তিনি যেদিকে নিয়ে গেছেন সেদিকে গেছি আমি। এর চেয়ে কোন ভিন্ন কিংবা সহজপথ আছে কি না কিংবা তা একমাত্র পথ কি না, তা আমি কি করে বলবো? যিনি আমাকে পথ দেখিয়েছেন, তিনি দার্শনিক, জিজ্ঞাসা করাতে বললেন- তিনি তা স্পষ্ট জানেন না। তিনি বিজ্ঞানী, বললেন- তিনি তা পরে এসে বলবেন। তিনি নবী, বললেন- হা এটাই একমাত্র পথ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.