যদি মানুষ না হই তবে যেন আবার জন্ম নিই মানুষ হয়ে. . .
শেষ পর্যন্ত মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়ায়। মানুষকেই পরস্পরের জন্য পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া ও সিলেটের কিছু এলাকায় মানুষ বুঝে গেছে, নিজেরা ছাড়া নিজেদের রক্ষা করার জন্য পাশে আর কেউ নেই।
এই বোধের মধ্যে দুর্ভাগ্য ও অসহায়ত্ব আছে। কিন্তু শক্তি আর সৌভাগ্যই বড় করে দেখতে চাই—মানুষ তো মানুষের পাশে থাকতে পারে!
চৌঠা মার্চ থেকে প্রথম আলোয় এই মানুষদের কথা পড়ি আর আমার কানে বেজে চলে লোপামুদ্রা মিত্রের গাওয়া গানের কলি, ‘আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক’।
মানুষের সেই সম্মিলনই শক্তি, যে সম্মিলন অবিচার, অরাজকতা, সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা-দ্বেষ, হত্যা রুখতে মানুষকে পরস্পরের জন্য পরস্পরের পাশে দাঁড় করায়। সেই সম্মিলন অন্য সবাইকে ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে।
এই পথ চিনতে না পারলে, এই মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারলে, সরকার আর নির্বাচনী রাজনীতি অর্থহীন। ব্যর্থ। গত কয়েক দিনে সরকার সাধারণ মানুষকে তো দূরের কথা, নিজের পুলিশ-প্রশাসনকেই রক্ষা করতে পারেনি।
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরীক্ষায় পাস করা তো আরও দূরের কথা।
রাজনৈতিক দলগুলোর বড় নেতৃত্ব মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোতেই ব্যস্ত থাকছেন। জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি তাঁদের মাথায় আছে বলে মনে হয় না। কিছু কিছু জনপদে মানুষ তাই বুঝে নিচ্ছে, শান্তি-স্বস্তিতে বেঁচে থাকতে হলে নিজেদেরই পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাজনৈতিক শক্তিগুলো এর বার্তা বুঝতে না পারলে তাদের চেয়ে দুর্ভাগা কেউ হবে না।
সেটা মানুষের জন্যও বড় দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে।
ঢাকার শাহবাগে এবং দেশের আরও অনেক অনেক জায়গায় যে মানুষেরা রাজনীতির হিসাবনিকাশের বাইরে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে চাইছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের শক্তি আর অর্জনের পরীক্ষাও এখানেই হবে।
২.
মানুষের শক্তি থেকে শক্তি পেতে চাই, কিন্তু তার পরও আমার বিষাদ কাটছে না।
মৃত্যু সব মানুষকে এক জমিনে দাঁড় করায়। যে মানুষকে হত্যা করা হয়, অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে তার পরিচয়, সে মানুষ।
মানুষের সবটুকু সম্ভাবনা বিকাশ করে বেঁচে থাকা তার অধিকার ছিল। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় ৭৭ জনের প্রাণ চলে গেছে, সবকিছু ছাপিয়ে এ কথাই বারবার মনে হচ্ছে।
তিন দিনব্যাপী হরতালের শেষ দিনে রিকশায় করে অফিসে যাচ্ছিলাম। রিকশাচালক তরুণ কুণ্ঠিত গলায় বলেন, ‘আমাদের তো লেখাপড়া নাই...কিন্তু দ্যাখেন, দুইজন মানুষের জন্য কত জন মরল!’ জিজ্ঞাসা করি, কে এই ‘দুইজন’? ‘ওই যে, সাঈদী হুজুর...। ’ কোনো কোনো মানুষ এতই দুর্ভাগা যে তাদের কারণে, তাদের হাতে, মানুষ কেবলই মরে।
৪২ বছর পরও।
রিকশাচালক ছেলেটি আরও বলেছিলেন, কয়েক দিন ধরে রোজগারের ঠিক নেই; ঢাকায় নিজের খরচ চলে না; দেশে টাকা পাঠাতে হবে। আগের দিন সংঘর্ষের মধ্যে এক রাস্তায় পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছেন। এসব কথা বলার সময় তাঁর গলার স্বরে বিপন্নতা আর অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।
কিছু ছবি ভুলতে পারছি না।
বাঁশখালীর ধোপাপাড়ায় পুড়ে কয়লা হওয়া ঘরের ভিটায় একটি হাঁড়ি অক্ষত পড়ে আছে; একটু দূরে ঘরহারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী বৃদ্ধাটি কোলের কাছে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছেন। আরেকটি ছবিতে দেখা আরেক নারীর ডুকরে কান্নার শব্দটাও যেন কানে শুনতে পাই। পত্রিকার রিপোর্টে বিভিন্ন এলাকায় আক্রান্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের কথায় ফিরে ফিরে পড়ি একাত্তরের সঙ্গে তুলনা।
পিটিয়ে-কুপিয়ে মানুষ হত্যার বর্ণনাই সহ্য করা কঠিন, কিন্তু তেমন ছবিও দেখতে হচ্ছে। মন থেকে সেসব চিত্র সরানো যাচ্ছে না।
পক্ষে-বিপক্ষে আর ঘটনাচক্রে নিহতদের মধ্যে অনেকের কম বয়সটা মনের মধ্যে গিয়ে বিঁধে থাকে। সহিংস মিছিলের সামনে নারী ও শিশু-কিশোরদের মানবঢালের ছবি ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না যে, চাঁদে নুরানি চেহারার অবিশ্বাস্য, কারসাজি করা ছবি এবং সেটা নিয়ে অধর্মসম্মত গুজব অনেককে হিংস্র মিছিলে ডেকে আনার ক্ষমতা রাখে।
ছবিতে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলায় সরকারি দপ্তরে লাগানো আগুনের সামনে এক কিশোরের মুখ দেখি। তার মাথায় টুপি, এক হাতে লাঠি।
এই বাচ্চা ছেলে সহিংস আক্রমণকারী?! ছবিতে দেখি, তার চোখেমুখে হতবিহ্বলতা। আমার মনকে কুরে কুরে খায় এই প্রশ্ন—এ কিশোর যে আজ এখানে পৌঁছেছে, তার দায় আমাদের কে অস্বীকার করতে পারবে?
কোনো দল নিষিদ্ধ করলেই কি এই ধরনের সমস্যার মীমাংসা হয়ে যাবে? এর মোকাবিলা করতে হয় যুক্তি-বুদ্ধি-ন্যায়-ন্যায্যতাবোধের স্বাধীন বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে, মানুষের মৌলিক স্বপ্নকে সুরক্ষা দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায়বিচারের বিষয়টি কেন্দ্র করে। ন্যায্য বিচার আজ পেতেই হবে। তবে একাত্তরে লড়াই হয়েছিল, একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য; অস্ত্র ধরা হয়েছিল একটি মুখের হাসির জন্য।
আজও মূল লড়াই কিন্তু সেটাই। মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানো সে জন্যই।
৩.
গানটা প্রথম শুনেছিলাম লোপামুদ্রার ‘এই অবেলায়’ সংকলনে। কঠিন, বিষাদময় এই সময়ে এরই কিছু কথা ফিরে ফিরে মনে করি, ‘ঠিক যেখানে দিনের শুরু, অন্ধ কালো রাত্রি শেষ, মন যত দূর চাইছে যেতে, ঠিক তত দূর আমার দেশ। ...এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক, এই দাবানল পোড়াক চোখ, আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক।
...দেশ মানে কেউ ভোরের স্লেটে লিখছে প্রথম নিজের নাম, হাওয়ার বুকে দুলছে ফসল, একটু বেঁচে থাকার দায়। ...সব মানুষের স্বপ্ন তোমার চোখের তারায় সত্যি হোক, আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।