আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঈশ্বরের অস্তিত্ব : আমার চিন্তাভাবনা (পর্ব – ৩; শেষ পর্ব)

শালিক পাখি

ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে লেখা আগের দুটো ব্লগে আমি ‘বিশ্বাস’ ও ‘মানুষ’ শব্দদুটো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম| আরো একটি শব্দ বাকি আছে| চলুন, আজ তাহলে ‘ঈশ্বর’ নিয়ে কথা বলা যাক| ৩. ঈশ্বর: এবার সবচেয়ে কঠিন প্রসংগ| ‘ঈশ্বর’ কে বা কী? তার আগে চলুন দেখি, ঈশ্বর (যদি থেকে থাকে) নিজেকে কি বলে দাবি করেন? ঈশ্বর বলেন তিনি সর্বস্থানব্যাপী, তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন ইত্যাদি ইত্যাদি| তাঁর এই কথা কিন্তু বড় ধর্মগুলোর সবগুলোতেই পাওয়া যায়| এই কথাগুলো প্রমাণ করে, যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন, তাহলে তিনি অবশ্যই ত্রিমাত্রিক নন, বরং অনেক বেশি মাত্রা সম্পন্ন কেউ| প্রকৃতপক্ষে, তিনি দাবি করেন, তাঁর কোনো সীমা নেই, অর্থাৎ তাঁর কোনো মাত্রা নেই| কাজেই মাত্রার ধারনাগুলোও তার জন্য খাটবে না| তাঁর কথা অনুযায়ী তিনি অসীম, স্থান-কাল-পাত্রের ধারনাটাই তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়| কাজেই, তাঁর কাছে সব কিছুই বর্তমান| এবার আসি যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন, তাহলে তিনি কীভাবে মানুষকে জানাবেন যে তিনি আছেন? বা কীভাবে মানুষকে জানাবেন যে তাঁর উপাসনা করতে হবে? চিন্তা করুন তো, আপনি আপনার সেই দ্বিমাত্রিক বন্ধুদের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবেন? আপনি কি সরাসরি তাদের সাথে কথা বলতে পারবেন? প্রশ্নই উঠে না| কারণ তারা আপনার ঐ ত্রিমাত্রিক কথাবার্তা বুঝতেই পারবে না| দ্বিমাত্রিকের প্রসঙ্গে পরে আসেন| ত্রিমাত্রিক একটা পিপড়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন তো দেখি| তবে হ্যা, আপনি যেটা করার চেষ্টা করতে পারেন, তা হলো একটা পিপড়াকে ধরে তাকে অনেক সময় ধরে আপনার কথা বুঝাতে পারেন, যাতে সে তার প্রজাতিকে আপনার কথা পৌঁছে দিতে পারে| আর এটা একটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার| এবার মনে করেন, আপনার কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে| আপনি চাইলে পিপড়ার (কিংবা সেই দ্বিমাত্রিক প্রাণীটির) বুদ্ধিমত্তাকে বাড়িয়ে দিতে পারেন, যাতে আপনার কথা তারা বুঝতে পারে| আপনার তখন ইচ্ছা হলো যে আপনি তা করবেন না| বরং একটি মাত্র পিপড়ার বুদ্ধি বাড়িয়ে তাকে কথাগুলো বুঝাবেন, যাতে সে সেই কথাগুলো অন্য পিপড়ার মাঝে বলতে পারে| কারণ আপনি দেখতে চান যে বাকিরা তার কথা মেনে নেয় কিনা| আপনি তাকে বুঝালেন এবং বললেন, অন্যদের মাঝে আপনার কথাগুলো গিয়ে বলতে| সে তাই করলো| অন্য পিপড়াগুলো তখন কী করবে? এক বাক্যে তার কথা মানে নিবে? অবশ্যই না| কারণ বাকি পিপড়াগুলোর বুদ্ধি তো আপনি বাড়িয়ে দেননি| আপনি দেখতে চাইছেন, বাকিরা তার তথা আপনার কথা মেনে নেয় কিনা| কেউ মানবে কেন? কাজেই আপনি তখন কী করবেন? কিছু Indication রাখবেন| প্রমাণ না| যদি প্রমাণই রেখে দেন যে আপনার কথাগুলো সত্য, তাহলে তো আপনার মূল ইচ্ছাটাই মাটি হবে| যদি পিপড়াদের উপযোগী করে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিয়েই দেন, তাহলে তো তারা সবাই আপনার কথা মেনে নিবে, আর আপনি তাদের আর পরীক্ষা করতে পারবেন না| যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন, তাহলে তিনিও ঠিক একই কাজটা করেছেন| তিনি চান আমাদের পরীক্ষা করতে, যে তাঁকে না দেখেই, তিনি আছেন এটার সুস্পষ্ট প্রমাণ না পেয়েই মানুষ তাঁকে ‘বিশ্বাস’ করতে পারে কিনা| খেয়াল করুন, (সব ধর্মেই) তাঁকে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে| কারণ তিনি আছেন এটার সপক্ষে অত্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ (যেমন ২ + ২ = ৪ কিংবা সূর্য পূর্বদিকে উঠে) তিনি নিজেই দেননি| যা দিয়েছেন, তা কিছু তত্ত্ব, কিছু ধারণা, কিছু Indication, কিছু যুক্তি| কার বা কাদের মাধ্যমে দিয়েছেন? কয়েকজন মানুষের মাধ্যমে, যাদের আমরা নবী, অবতার ইত্যাদি বিভিন্ন নামে চিনি| তাদের বুদ্ধিমত্তাকে তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন, যাতে তাঁরা ঈশ্বরের কথা বুঝতে পারেন| আর যখন তাঁরা আমাদের বুঝিয়েছেন, তখন আমরা শুনিনি| তাই ঈশ্বর তাঁদের দিয়েছেন কিছু অলৌকিক ক্ষমতা, যা তাঁদের সাহায্য করেছে, মানুষকে ঈশ্বরের পক্ষে ডাকতে| ব্যাপারটা এরকম, ঈশ্বর (যদি থেকে থাকেন) তিনি সকল মাত্রার উর্ধ্বে (তাঁর নিজের ভাষ্য অনুযায়ী)| তিনি মাত্রাহীন (সীমাহীন তথা অসীম), তিনি সময়ের বন্ধনে আবদ্ধ নন| তাঁর কাছে সব দৃশ্যমান, সব বর্তমান| তিনি মানুষের কাছে যুগে যুগে মানুষেরই মধ্য থেকে কাউকে নির্বাচন করে তাঁর কথা প্রচারের জন্য নিয়োজিত করেছেন, যাতে মানুষ তাঁর সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে| কারণ তিনি জানতে চান, মানুষ তাঁর স্রষ্টাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া, কিছু তত্ত্ব বা ধারণা বা Indication থেকে মেনে নিতে পারে কিনা, বা ‘বিশ্বাস’ করতে পারে কিনা| যদি তিনি সব প্রমাণ দিয়েই দিতেন, তাহলে তিনি তো আর এটা দেখতেই চাইতেন না যে মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করে কিনা, তাইনা? এজন্য অবশ্য তিনি কিছু ভালো জিনিসের লোভ আর খারাপ জিনিসের ভয় দেখিয়েছেন, যাতে মানুষ এসব লোভ বা ভয়ের কারণে হলেও তাঁকে বিশ্বাস করে আর তাঁর কথা মেনে চলে| আমার কথা শেষ| আবারও বলছি, এগুলো সবই আমার নিজের চিন্তাভাবনা| মেনে নেয়া বা দ্বিমত পোষণ করা একান্তই পাঠকের উপর| তবে যদি কেউ মন্তব্য করেন, তাঁকে অনুরোধ করবো, দয়া করে শালীনতা বজায় রাখতে| পরিশেষে কথা রাখছি| নিজের বিশ্বাসের ব্যাপারটা দিয়েই শেষ করি| আমি আস্তিক| কিন্তু কোন ধর্মে বিশ্বাস করি, তা বলছিনা| কারণ আমার এই পোস্টটা কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম নিয়ে না, তা আগেই বলেছি| এটা ছিলো ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা| যদি কখনো সময় পাই, তাহলে বিভিন্ন ধর্ম নিয়েও আলোচনা করবো| অবশ্য তার আগে অনেক পড়াশোনা করে নিতে হবে, কারণ সাম্যুর ব্লগাররা (যারা এই জাতীয় ব্লগ লিখেন বা পড়েন) মনে হয় আমার চেয়ে ধর্ম সম্পর্কে অনেক বেশি গবেষণা করেছেন| এবার আসি কেন আমি আস্তিক, এই প্রসঙ্গে| ছোট একটা যুক্তি| পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আমি এমন কিছুই পাইনি, দেখিনি, শুনিনি যা নিজে নিজে তৈরি হয়ে গেছে| কাজেই এই বিশাল সৃষ্টিজগৎ নিজে নিজে তৈরি হয়ে গেছে, এমনটা আমার মনে হয় না| আর হ্যা, প্রমাণ কোথায় পেলাম যে ঈশ্বর আছেন? অত্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ পাইনি, পেয়েছি কিছু Indication, যা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে স্রষ্টার উপর বিশ্বাস আনার জন্য যথেষ্ট| নাস্তিকতার পক্ষের যুক্তিগুলো এসব Indication এর কাছে বড়ই ঠুনকো মনে হয়| তার একটা উদাহরণ এই মাত্রই দিলাম| আমি সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ জানার চেষ্টাও করিনা, কারণ সেটা আমি পাবো না বলেই মনে হয়| আমার ক্ষুদ্র ত্রিমাত্রিক জ্ঞান দিয়ে আমি সীমাহীন ঈশ্বরের প্রমাণ বের করতে পারবো না, এটাই কি স্বাভাবিক না? ব্যাপারটা একটা প্যারাডক্সের মতো| আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন, স্রষ্টা বা ঈশ্বর আছেন? অনেকেই সেটা করেন বা করতে চান ধর্মগ্রন্থের সাহায্যে, যেটা আসলে প্রমাণের মূল শর্তকেই ব্যাহত করে, কারণ আপনি যদি ঈশ্বরেই বিশ্বাস না করেন, তাহলে ধর্মগ্রন্থ আসলো কোত্থেকে? আবার অন্য কোনোভাবে প্রমাণ করাও প্রায় অসম্ভব, তার কারণ একটু আগেই বলেছি| যদি ঈশ্বর প্রমাণ দিয়েই দিতেন, তাহলে (তাঁর মতে) তিনি আমাদের পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে মানতে বলতেন না| আর যদি আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই করেন, তাহলে সৃষ্টিজগতের ব্যাখ্যা কিভাবে দিবেন? বিবর্তনবাদ, বিগ ব্যাং থিওরি কোনো কিছুই এত সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ একটা সিস্টেম ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট না (আমার মতে)| কাজেই, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদুর|” সেটা অবশ্য আরেক বিশাল আলোচনা হতে পারে| আরেকদিন করবো না হয়... ধৈর্য্য ধরে যারা পরেছেন বা যারা পড়েননি বা যারা মাঝখানে ধৈর্য্য হারিয়ে পড়া বাদ দিয়েছেন, তাদের সবাইকেই ধন্যবাদ| ভালো থাকবেন|

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।