আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'স্বাভাবিক প্রসব কি ইতিহাস হতে যাচ্ছে'!

নিজেকে জান এবং প্রকাশ কর!!

এভাবে চলতে থাকলে একদিন স্বাভাবিক প্রসব জাদুঘরে ঠাঁই নেবে- এটি বৈজ্ঞানিক কোনো কল্পকাহিনীর চরিত্রের কথা নয়। দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এ উক্তি এ সময়েরই এক চিকিৎসকের। সরকারি একটি হাসপাতালের চিকিৎসক মো. জানিবুল হকের এ কথার পেছনে রয়েছে একটি জরিপের ফলাফল, যাতে দেখা যাচ্ছে- গত এক দশকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার হার পাঁচ গুণ হয়েছে। আর অস্ত্রোপচারের (সিজারিয়ান) মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া নারীদের ১৯ শতাংশের এভাবে মা হওয়ার প্রয়োজনই ছিলো না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য অনেকেই যেমন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ব্যথামুক্তভাবে সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী, তেমনি চিকিৎসকরাও আর্থিক লাভালাভের দিকটি দেখে এ কাজ করে থাকেন।

পুরানে আছে, খ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে প্রাচীন রোমের অধীশ্বর জুলিয়াস সিজারকে মা আউরেলিয়ার পেট কেটে বের করা হয়েছিলো। আর সে জন্যই স্বাভাবিক প্রসবের ব্যতিক্রম এই পদ্ধতিকে বলা হয় 'সিজারিয়ান', সেই সঙ্গে এ পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের বলা হয় 'সিজারিয়ান বেবি'। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপযুক্ত নির্দেশনা এবং পর্যবেক্ষণের অভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান ক্রমেই বাড়ছে। এ দিকে নজর দিতে সরকারের প্রতি পরামর্শ রেখেছেন তারা। বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু জরিপ-২০১০ এ দেখা যায়, সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে ২০০১ সালে যেখানে অস্ত্রোপচারের হার ছিলো ২ দশমিক ৬ শতাংশ, তা ২০১০ এ এসে ১২ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

আর এসব অস্ত্রোপচারের দুই-তৃতীয়াংশই হয়েছে বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালে, অনেক ক্ষেত্রেই যার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মো. ছিফায়েতউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করে অনেক সন্তান প্রসব করানো হচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। " তবে তিনি এ প্রবণতা কমানোর কোনো সঠিক রাস্তা দেখাতে পারেননি। "সব প্রসূতি মায়ের ক্ষেত্রে এটি পর্যবেক্ষণ করা কঠিন। কারণ কেবল চিকিৎসকরাই তার রোগীর ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেন", বলেন ছিফায়েত।

এদিকে প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যা বিশারদরা বলছেন, প্রয়োজন থেকেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হয়। আর এ হার ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে। বাংলাদেশ প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যা সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক নাসিমা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বাংলাদেশের গর্ভবতী মায়েরা অপুষ্টিতে ভোগে এবং অল্প বয়সে তারা গর্ভধারণ করে। এ কারণে গ্রামাঞ্চলে শতভাগ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার হতে পারে। " তবে এ বিষয়ে জরিপ চালানো আইসিডিডিআরবি,র গবেষক শামস উল আরেফিন বললেন, "অনেক সময় যে সব নারীর অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, তারা তা পাচ্ছে না; আবার যাদের প্রয়োজন নেই, তারা অপ্রয়োজনেই তা করছেন।

" সারাদেশে ১ লাখ ৭৬ হাজার নারীর সঙ্গে কথা বলে শামসরা দেখেছেন, গর্ভাবস্থায় কোনো ধরনের জটিলতা না থাকলেও ১৯ শতাংশ নারী অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। আর্থিক সচ্ছলতার ব্যথামুক্ত প্রসবের এ পদ্ধতি তারা বেছে নিয়েছেন বলে মনে করছে জরিপকারী দল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া। যারা প্রথমবার অস্ত্রোপচার করান, পরবর্তী কালে তারা আর স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টাই করেন না। জরিপের পর্যবেক্ষণ, কখনো কখনো নারীরা প্রসবের ব্যথা এড়াতে চান, আবার কখনো কখনো চিকিৎসকরাই লাভ বিবেচনা করে অস্ত্রোপচারে উৎসাহ জোগান।

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রথম সন্তান জন্মদানকারী নারায়ণগঞ্জের রেবেকা বেগম তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, "মাঝরাতে প্রসব বেদনা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পাশের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার জানায়, পেটের বাচ্চাটি নড়ছে না। বাচ্চা বাঁচাতে হলে দ্রুত সিজার করতে হবে। " ওই ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেন তাকে ২ হাজার টাকা এবং যিনি অচেতন করেন সেই চিকিৎসককে ১ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ চিত্র প্রায় সারাদেশের, তাই ক্লিনিকের নামটি প্রকাশ করা হলো না।

ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক জানান, তার ওখানে স্বাভাবিক কোনো প্রসবের ঘটনাই ঘটেনি। নারী স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান 'নারীপক্ষ'র জ্যেষ্ঠ প্রকল্প কর্মকর্তা সায়মা আফরিন বলেন, স্বাভাবিক প্রসবে সময় বেশি লাগে বলে চিকিৎসকরা সময় বাঁচাতে অস্ত্রোপচারকেই উৎসাহ জোগান। আফরিন তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, "গরিব মানুষের জন্য এসব ক্লিনিক বা চিকিৎসকের কোনো মায়া-দয়াই নেই। এ অস্ত্রোপচারের জন্যই অনেককে সুদখোরদের খপ্পরে পড়ে ঋণ নিতে দেখছি। " অস্ত্রোপচারকে বাণিজ্য হিসেবেই এখন দেখা হচ্ছে বলে আইসিডিডিআর,বির এ গবেষক মনে করেন।

বিষয়টি কিছুটা মেনে নিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও। ছিফায়েত বলেন, "শুধু আইন এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। যিনি বা যারা এ কাজটি করাচ্ছেন তাদের নৈতিকত মেনে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজটি করতে হবে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ অবশ্য নাকচ করলেন প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যা সোসাইটির মহাসচিব। নাসিমা বলেন, "কেবল এক অথবা দুই শতাংশ চিকিৎসক এ কাজে জড়িত থাকতে পারে।

বাকি সব গুজব। " "বাড়িতে হাতুড়ে ধাত্রী দিয়ে প্রসবের সময় জটিলতা দেখা দেয়, তখন অস্ত্রোপচার ছাড়া আর উপায় থাকে না", বলেন তিনি। সেইসঙ্গে জানান, দেশে ৭৫ শতাংশ প্রসব বাড়িতেই হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি অস্ত্রোপচারের হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশের বেশিও হয়, তাও কোনো সমস্যা নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক নাসিমা। তবে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তরুণ চিকিৎসক জানিবুল বলেন, "অস্ত্রোপচারের ফল সুদূরপ্রসারী।

যে নারীর অস্ত্রোপচার হয়, তার সুস্থ হতে এক মাসের মতো সময় লাগে। এতে নবজাতকের পরিচর্যা তিনি করতে পারেন না। " "যদি এ ধারা চলতে থাকে, তাহলে একদিন স্বাভাবিক প্রসবের ঘটনা জাদুঘরে স্থান পাবে", বলেন তিনি। View this link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.