'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।
সিলেট এবং নেত্রকোণা বেল্টের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে যতবারই গিয়েছি, অদ্ভুত ভালো লেগেছে। অসম্ভব রকম শান্ত নিরিবিলি এক পরিবেশ। অধিকাংশ জায়গাতেই প্রায় একই দৃশ্য।
মাঠ কিংবা গ্রামের ভেতরে কিছু দূর পর পর সাদা পাথরের পিলার। পিলারের বাংলাদেশ প্রান্তে খোদাই করে লেখা 'বাংলা', অপর প্রান্তে লেখা রয়েছে 'IND' এবং উভয় প্রান্তেই কিছু সংখ্যা লেখা রয়েছে।
সীমান্তে সাদা পাথরের পিলার
পিলার থেকে দেড়শ গজ দূরে ভারতের কালো রঙের কাঁটা তারের বেড়া। দুই মানুষ উঁচু সমানতো হবেই। ওই বেড়ার ও পাশে পাকা রাস্তা করে দেয়া আছে।
ভারতীয় বিএসএফ ওই রাস্তা ধরেই টহল দেয়। পাথরের পিলার এবং কাঁটা তারের বেড়ার মধ্যবর্তী স্থানটি 'নো ম্যানস ল্যান্ড' -এর জন্যে ভারতের ছেড়ে দেয়া জমি হলেও ওখানে বাংলাদেশের গরু-ছাগলদের বিচরণ করতে কোন সমস্যা নেই। লেখার মাঝখানে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি। কারণ, মানুষকে আমরা বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় -এ ভাবে জাতীয়তা নির্ধারণ করলেও গরু বা ছাগলদের ক্ষেত্রে জাতীয়তা নিরূপণের প্রশ্নটি প্রযোজ্য কিনা, আমার জানা নেই।
ভারতীয় সীমান্তে গরু চড়ে বেড়াচ্ছে।
কাঁটা তারের ওপারেই ভারত
সুনামগঞ্জের নারায়ণতলা এবং কুমারভিটা নামের যে জায়গা দুটিতে সম্প্রতি ঘুরে এলাম, সে গল্প আপনাদের শোনাবো আজ । তার আগে বিধাতাকে ধন্যবাদ। তিনি আমাকে বাংলাদেশের এত সুন্দর দুটি স্থান দেখার সুযোগ দিয়েছেন।
অফিসের কাজে গেলেও ঘোরাঘুরির নেশাটা আমার বরাবরের মতই এবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তাই দিনের কাজ একটু আগে ভাগেই শেষ করে হাতে পানির বোতল আর ব্যাক প্যাক পিঠে ঝুলিয়ে বের হয়ে পড়লাম নতুন জায়গা দেখার উদ্দেশ্যে।
সঙ্গে হালিম ভাই, যিনি 'ওয়ার্ল্ড ফিশ' নামের একটি এন জি ও তে কর্মরত আছেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখছি, সুনামগঞ্জে এলে আমি সাধারণত হোটেল প্যালেস বা 'সানক্রেড' (একটি এন জি ও) এর গেস্ট হাউজে উঠি। এবার উঠেছিলাম ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর গেস্ট হাউজে। ৮০০ টাকার এ.সি. রুম। নন এসি ৪০০ এবং ৬০০ টাকা করে।
মনে হবে যেন বাড়িতেই আছেন। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাটাও এখানেই করে নিতে পারেন। দুপুর বা রাতের খাওয়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা করে। তবে নিজস্ব যানবাহন সাথে থাকলে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড কিংবা ট্রাফিক পয়েন্ট-এর হোটেল গুলোতেও খাওয়া দাওয়াটা সেরে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে হোটেল আহনাফের কথা একটু বাড়িয়ে বলবো, কারণ এখানেই একমাত্র তৃপ্তি করে মুরগির ডিম ভাজি খেতে পেরেছি পরোটা দিয়ে।
একটা কথা কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, সুনামগঞ্জে খালি রিক্সা পাওয়াটা যেন অনেকটা আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো অবস্থা। আর সানক্রেড এবং ওয়ার্ল্ড ফিশ- এর গেস্ট হাউজ দুটি শহরের একটু নির্জন এলাকাতে অবস্থিত, যেখানে সন্ধ্যার পর রিক্সা বা টমটম কিংবা অন্যান্য ভাড়ার বাহন পাওয়াটা আসলেই দুষ্কর।
ফিরে আসি ঘোরাঘুরি প্রসঙ্গে। হালিম ভাইকে সাথে নিয়ে দুপুরের খাওয়ার পর রওনা হলাম। সুনামগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্ট থেকে ৫০ টাকায় রিজার্ভ টমটমে পনের মিনিটে দু'জন পৌঁছে গেলাম হলদিয়া ঘাটে।
হলদিয়া ঘাটে ট্রলারে উঠছি আমরা
সেখান থেকে ট্রলারে ওপারের বাজারে নেমে দেখি সারি সারি মোটরসাইকেল। দরদাম করে সেলিমের বাজাজ প্লাটিনা মোটরসাইকেলটাই আমাদের পছন্দ হলো। গন্তব্য নারায়ণতলা শহীদমিনার। এক মোটরসাইকেলে চালকসহ তিনজন। আপ-ডাউন ভাড়া ১৬০ টাকা।
সময় লাগবে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট।
তিনজন মিলে রওনা হলাম। গ্রামের সরু আঁকা-বাঁকা পাকা রাস্তায় দু'পাশের বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে দক্ষ হাতে সেলিম চালিয়ে যাচ্ছে। দূরের পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে কাছে এগুচ্ছে।
একটা সময় পৌঁছে গেলাম নারায়ণতলা শহীদ মিনারে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ জন শহীদের কবর আছে এখানে। পাশেই রয়েছে একজন মুক্তিযোদ্ধার বিশালাকৃতির একটি মূর্তি।
শহীদমিনারে শহীদদের কবর
নারায়ণতলা শহীদমিনার
মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি
শহীদমিনার থেকে দেখা দূরের পাহাড়
শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে খুব কাছেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের দিকে এগুলাম দুরুদুরু বুকে।
দূরে ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়া
দূরের পাহাড়
মেঘে ঢাকা পাহাড়
সীমান্ত এলাকায় আমি একটু বেশিই সতর্ক এবং ভীত-সন্ত্রস্ত থাকি, কেননা ভারতীয় বিএসএফ -দের কোন বিশ্বাস নেই। আমার ধারণা, বাংলাদেশিদেরকে হাতের কাছে যে কোন সময় পেলে এরা নির্বিচারে গুলি চালাতে দ্বিধা করবেনা।
তবে মোটরসাইকেল চালক সেলিম আমাকে আশ্বস্ত করলেন। জানালেন যে, এই এলাকায় ভারতীয় বিএসএফদের এরকম অত্যাচার এখনও শুরু হয়নি।
দূরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া
সাদা রঙের পিলার থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে আমরা ধীরে ধীরে নদীর দিকে এগুলাম, যেটি ভারতের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। অসম্ভব রকম স্বচ্ছ টলটলে পানি। এখন খুব বেশি হলে হাঁটু পানি।
তাই চারিদিকে শুধু বালু আর বালু। কিন্তু বর্ষার সময় পাহাড়ী ঢল নামে।
চারিদিকে বালু আর বালু
যে দিকে তাকাই শুধু বালু
পাহাড়ী ঝিরি
চারিদিকে ঠাণ্ডা বাতাস আর নিরবতা। হঠাৎ করেই সূর্য যেন মেঘের আড়ালে চলে গেল। নদীর পানিতে মুখ ধুলাম আমি।
পাড় ধরে হাঁটলাম কিছুক্ষণ।
স্বচ্ছ টলটলে পানির পাহাড়ী ঝিরি
ফেরার পথে লক্ষ করলাম, দূরে কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে বেশ ক’জন বিএসএফ ঠিক আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমরা আর বেশি দেরি না করে দ্রুত পা চালালাম।
আবার মোটরসাইকেলে আমরা। এবারের গন্তব্য কুমারভিটা।
নারায়ণতলার কাছেই একটা জায়গা। গ্রামের পাকা রাস্তা ধরে যেতে যেতে একটা সময় থামলাম। আর যাবেনা আমাদের বাহন। কারণ সামনে একটা হাঁটুপানির খাল পার হতে হবে।
কুমারভিটার পথে খাল পেরোতে হবে এবার
খাল পার হয়ে মেঠো পথ ধরে আমরা এগুলাম পাহাড়ের দিকে।
এখানের সামান্য কিছু পাহাড় বাংলাদেশের অংশে পড়েছে।
কুমারভিটার পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা
আমরা অভিযাত্রীরা পাহাড়ের কোল ঘেঁষা রাস্তা ধরে উপরের দিকে উঠলাম। কিন্তু বেশি দূর যাবার সাহস হলোনা দু'টি কারণে। প্রথমত পাহাড়ের ভেতরে ভেতরে সেই সীমান্ত পিলার বসানো। ভুলক্রমে কোনভাবে যদি ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়ি এবং বিএসএফ দাদারা আমাদের ধরে ফেলেন।
... থাক। বাকীটুকু আর বলতে চাইছিনা। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, পাহাড়ের জঙ্গলের ভেতরে বিষাক্ত সাপের ভয়। তবে যে পাহাড়টিতে আমরা উঠলাম, সেখানে বিশালাকৃতির কালো রঙের পাথরগুলো চোখে পড়ার মতো।
পাহাড়ের উপর থেকে তোলা ছবি
পাহাড়ের আরও উপরে উঠছি আমরা
পাহাড়ের উপর থেকে দেখা দূরের ভারতীয় সীমান্ত
ওই পাহাড়গুলো ভারতের
দূর পাহাড়ের ফাঁকে সূর্য ডোবার দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে পা বাড়ালাম ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য:
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ কিভাবে যাবেন: শ্যামলী নন এ.সি বাসে সরাসরি ঢাকা টু সুনামগঞ্জ যেতে পারেন। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত শ্যামলীতে ৩৩০ টাকা নেবে। অথবা ভালো হয়, যদি ঢাকা থেকে গ্রীন লাইন বা সোহাগ (ঢাকা-সিলেট রুটে সোহাগের সার্ভিস চরম হতাশাজনক) এসি বাসে ৫৮০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে আনুমানিক ৫ ঘন্টায় সিলেট হুমায়ূন রশিদ চত্ত্বরে নামবেন। সেখান থেকে বিশ টাকা দিয়ে একটা রিক্সা ভাড়া করে কীন ব্রীজ পার হবেন। তারপর শেয়ার/রিজার্ভ সিএনজিতে কুমারগাঁও বাস স্ট্যাণ্ড।
সেখান থেকে ৭০ টাকা দিয়ে 'বিরতিহীন' বাসের টিকেট কেটে বাসে উঠে হালকা ঝাঁকি খেতে খেতে ২ ঘন্টায় সুনামগঞ্জ। ফেরার পথেও একইভাবে ফিরতে পারেন। আর নন এ.সি নাইট কোচ শ্যামলীতে ঢাকা ফিরতে ৩০০ টাকা নেবে।
কোথায় থাকবেন:
হোটেল প্যালেস: নাই মামার থেকে কানা মামা টাইপ একটাই মোটামুটি মানের হোটেল সুনামগঞ্জ-এ রয়েছে। এখানে আবার একটি এ.সি. রুম-ও আছে, যার এ.সি. অনেক আগে আমি যখন ছিলাম, কোনভাবেই কাজ করেনি।
ফোন নম্বর: ০৮৭১-৫৫৩৪১ (ল্যাণ্ড লাইন), ০১৭১-৯০৪৮২৮২ (জনাব মনোজ কান্তি, ম্যানেজার)।
সানক্রেড (এন জি ও): ঠিকানা: হাছন নগর, সুনামগঞ্জ। ফোন: জনাব রেমা: ০১৭১৮৫২৩২০৪
ওয়ার্ল্ড ফিশ: ঠিকানা: ষোলঘর, আলীপাড়া, সুনামগঞ্জ। সরাসরি হালিম ভাইয়ের সাথে রুম এর ব্যাপারে কথা বলতে পারেন (তার অনুমতি সাপেক্ষে ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি): ০১৯১৮-২৭৩৪৮৫। আর ০৮৭১ ৫৬২০১ নম্বরে ওয়ার্ল্ড ফিশ, সুনামগঞ্জ-তেও কথা বলতে পারেন।
যারা সরকারী অফিসার, তারা সার্কিট হাউজে ম্যানেজ করতে পারেন থাকার ব্যাপারটা। সময় পেলে হাছন রাজার বাড়িটা দেখে আসতে পারেন।
আমার ভ্রমণ বিষয়ক অন্য লেখাগুলো:
গজনী-লাউচাপড়া: অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের আধার
ট্যুর টু কাপ্তাই: একটি ছবি ব্লগ প্রযোজনা
আলীকদমে অ্যাডভেঞ্চার
রূপসী দাসিয়ার ছড়া: বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে ভারতীয় এক ছিটমহল
চলুন, ঘুরে আসি মুম্বাই
বারিক্কা টিলা: বাংলাদেশের মানচিত্রে যেন ছোট্ট একটি ভূ-স্বর্গ
টাঙ্গুয়ার হাওড়: যার সৌন্দর্যের তুলনা সে নিজেই
কালিমপং-লাভা-লোলেগাঁও: যেন পৃথিবীর বুকে একটুকরো স্বর্গ
সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি বিজড়িত মসূয়া
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।