আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনামগঞ্জের প্রথম শহীদ আবুল হোসেন ও তার পরিবার



হিমাদ্রি শেখর : ২৮ র্মাচ ১৯৭১। সম্মুখ যুদ্ধে পাকহায়নার গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল আবুল হোসনের দেহ । তিনি সুনামগঞ্জরে প্রথম শহীদ। সেদিন দুপুরে মুক্তিকামী উত্তেজিত ছাত্রজনতা ডাকবাংলায় অবস্থানরত পাকিদের লক্ষ্য করে সবাই অনবরত গুলি ছুঁড়েন । তাদের অন্য একটি অংশ জুবিলী স্কুলে অবস্থান করে।

স্কুলে অবস্থানরত সম্মেলিত ছাত্রজনতা ডাকবাংলা লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছুঁড়েন। একইভাবে ডাকবাংলা লক্ষ্য করে সম্মেলিত অবস্থান থেকে জুবিলী স্কুল,এস সি বালিকা বিদ্যালয় হতে একযুগে গুলি ছুঁড়া হয়। প্রচন্ডগুলি বিনিময়ের একর্পযায়ে অকুতভয় বীর আনসার কমাণ্ডার আবুল হোসনে শহীদ হন। সেদিন আবুল হোসেনের স্ত্রী রহিমা খাতুন দুপুররে রান্নার আয়োজনে ব্যাস্ত ছিলেন। তখন বলো ১২টা।

কোন এক অঘটনরে অজানা আশংকায় রহিমার মনটা কমেন করতছেলি। রহিমার মনের ধারনাই সঠিক এবং তাই ঘটল। পাড়া প্রতিবেশী ও গ্রামরে লোকজন কানাঘুষা করে বলতে লাগল আবুল হোসেনের গুলবিদ্ধি হওয়ার কথা। কথায় আছে দুঃসংবাদ বাতাসের আগে চলে। রহিমা খাতুনের কানেও সে দুঃসংবাদের বাতাস এসে লেগেছে।

স্বামীর খবর জানার জন্য তিনি রান্নাঘর ছেড়ে বাড়ির বাইরে চলে যান। এক কাপড়ে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে আশপাশরে মানুষরে কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা যাচ্ছেন রহিমা । কিন্তু কেউই আবুল হোসনের প্রকৃত খবর দিতে পারছেন না। এদিকে পাকসেনা ও স্থানীয় ছাত্রজনতার মধ্যে গুলি বিনিময়ের কারণে স্বজন থেকে শুরু করে আরশীপড়শী আবুল হোসনেরে খবর জানার জন্য শহরে আসতে চাইছে না। এভাবে অনেক সময় গড়িয়ে যায়।

এরই মধ্যে সুরমা নদী পেরিয়ে আবুল হোসেনর খবর নিয়ে তার এক ভাতিজা। সে বাড়িতে এসে চিৎকার করে বলে চাচী আম্মা কাকুমনি আর নাই। পাঞ্জাবীরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলছে। আবুল হোসনেরে মৃত্যুর খবর শুনে রহিমা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। খবর নিয়ে আসা ভাতিজার পরনের শার্টটি ছিল আবুল হোসনেরে রক্তে ভেজা।

২৮ মার্চ পাকসেনাদের সাথে সুনামগঞ্জের আনসার,কৃষক, ছাত্র-জনতার সরাসরি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে আবুল হোসনে ছিলেন ফ্রন্ট লাইনরে একজন অকুতভয় বীর সেনা। সুনামগঞ্জরে সাবেক ডাকবাংলো বর্তামান পুরাতন সার্কিট হাউজ এলাকায় সরাসরি শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে যেয়ে মাথায় গুলবিদ্ধি হয়ে মারা যান। এর আগে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জের শান্ত জনপদে বাঙ্গলী জাতির কুলাঙ্গার সন্তান পাকসনো ক্যাপ্টেন মাহবুব ১০মাত্র জন পাকসেনা নিয়ে শহরে প্রবশে করে সুনামগঞ্জরে কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। জাতে বাঙ্গালী হওয়ার কারণে স্থানীয় পুলশিকে খুব সহজে চাতুরী করে মিথ্যে কথা বলে তাদের নিয়ন্ত্রন করে ফলে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জে আসার পথে বাংলায় কথা বলে নিজেকে পাঞ্জাবী বিরোধী ইস্ট ব্ঙ্গেল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক পরিচয় দিয়ে লামাকাজি ও ডাবরঘাট ফেরী পারাপাররে অসহযোগী জনতাকে কুটকৌশলে সহযোগী জনতায় পরিণত করে, সংগ্রামী জনতাকে ফাঁকি দিয়ে খুব সহজই বেঈমান ক্যাপ্টেন মাহবুব তার গন্তব্যস্থল সুনামগঞ্জে চলে আসে।

এসেই ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে মাত্র ১০ জন পাকসৈন্য সুনামগঞ্জ দখল করে। মাহবুব থানা নিয়ন্ত্রন ভার হাতে নিয়ে পুরো শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। শহরে সামরকি কনভয়সহ বের হয়ে সাধারণ মানুষ কে এলোপাথারি মারধোর করে ত্রাসের সৃষ্টি কর। রাতে মাহবুব তার দলবল সহ ডাক বাংলায় (বর্তমান পুরাতন র্সাকিট হাউস) এ অবস্থান করে। মাহবুবের বাড়ি বৃহত্তর বরিশাল জেলায়।

সে পাকিস্থান বিমান বাহিনীতে চাকুরী নিয়ে কোয়টো ওকোহাটে চাকুরী সুত্রে অনেক দিন কাটায়। র্ববর বর্বর পাকিস্থানী পাঁ-চাটা কুকুর হওয়ায় সে ক্যাপ্টেন পদে দ্রুত উন্নীত হয়। সুদর্শন বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন মাহবুব তখন পাকহায়নাদের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিলে একজন গর্বিত সৈনিক হতে পরতো। কিন্তু সে তা না করে হাজার বছররে ঐতহ্যিবাহী বাঙ্গালী জাতির কলঙ্ক হিসেবে গণধিকৃত মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয় বাঙ্গালী জাতির কাছে তোলে ধরে। শহরে সান্ধ্যআইন জারীর পর শান্ত জনপদে প্রতিবাদের অগ্নি শিখাজ্জ্বলে ওঠে।

আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্জ্বলে ওঠে মানুষের মনে। প্রতিবাদের অগ্নি শিখা দাবানলের মতো র্সবত্র ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রাম গুলোতে। আগুনের আঁচ থেকে বাদ পড়েননি রহিমা খাতুনও। রাতে স্বামীর মুখে শহরে পাঞ্জাবী আসার খবর শুনছেনে। আবুল হোসনে ছিলেন টকবকে তরুণ ।

তার ওপর আবার একজন আনসার কমান্ডার। প্রতিবাদী উত্তাল জনতার সমুদ্রে দেশমাতৃকার টানে তিনি যোগদেন । আবুল হোসেনর ছিলো ক্ষুদ্রযুদ্ধাস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। যুদ্ধের প্রাথমিক কলাকৌশল ভালভাবে রপ্ত করেছিলেন তিনি। সুরমা নদীর তীর্রবতী গ্রাম আছিনপুর।

প্রাকৃতিক ভাবে নদী তীর্রবতী অঞ্চলের মানুষ অন্যান্যদরে তুলনায় অনকেটা সাহসী হয়। নদী তাকে জন্ম থেকে সাহসী হতে শিখিয়েছে। ছাত্র, কৃষক, শ্রমকি, জনতা একতাবদ্ধ হয়ে প্রতহিত দেশ স্বাধীনরে পর : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রহিমা খাতুনের ৩ ছেলেমেয়ে সহ ঠাঁই হয় শওকত মিয়া সাহেবের বাড়িতে স্থাপিত অস্থায়ী এতিমখানায়। তার পর সুনামগঞ্জ শহররে কালীবাড়ি স্কুলের এতিমখানায়। এভাবে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে কেটে যায় এক বছর।

সবার সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে দুই মেয়ে কে বিয়েদেন রহিমা। তার পর পা খুড়া ছেলে রেজাউল কে নিয়ে চলে আসেন স্বামীর ভিটে আছিনপুর গ্রামে । কিন্তু ততদিনে স্বামীর ভিটাবিলীন হয়ে যায় সুরমা নদীর কড়াল গ্রাসে । এসময় অনেকটা নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নেন বাবার বাড়ি ইব্রাহীমপুর গ্রাম। বাবা তাকে বসবাসের জন্য কোন মতে একটি ছোট্ট কুড়ে ঘর তোলে দেন।

স্বামী আবুল হোসেন তার পরিবারের জন্য তেমন কোন কিছুই রেখে যাননি। যা দিয়ে দিনযাপন করতে পারবেন রহিমা। বাবার তোলে দেয়া ঘর বারো বছর আগে প্রয়োজনীয় মেরমতের অভাবে ভেঙ্গে যায়। অর্থাভাবে আজ পর্যন্ত নতুন করে ঘর তোলতে পারেননি। বর্তমানে ৮ হাত বাই ১০ হাত আয়তনের একটি ছোট্ট ছাপটা ঘরে বসবাস করছেন পায়ে খুড়া রেজাউল কে নিয়ে।

সরকার এর দেয়া ভাতা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে মা ছেলের। রহিমার ঘরগেরস্থালী : ঘর গেরস্থালী বলতে আছে শুধু রাতে মা ছেলের ঘুমানোর দুটি চৌকি ,একটি বাঁশের আলনা,একটি লোহার টাংক,একটি চাউলের ড্রাম,দুটি বসার টুল, একটি চয়োর একটি টেবিল, পুরোনো কাপড়চোপড়। বসত ঘরের লাগোয়া বাথরুমটিও যথেষ্ট দারিদ্রতার চিহ্ন বহন করে আছে। শেষ বেলার বার্ধক্য: ষাটোর্ধ্ব রহিমা খাতুন দারিদ্রতার কাছে পরাজিত। নানান রোগশোকে বাসাবেঁধেছে তার ভেতর।

উচ্চরক্ত চাপ, মাথাব্যাথা, চোখরে ছানি, হাতে পায়ে পানি, স্নায়ুবিক র্দুবলতায় দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। প্রতিদিন তাকে ৫০/৬০ টাকার ঔষধ খেতে হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.