বৃথা হয়রানি
১ .
সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটি বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণিকক্ষ সমস্যা সমাধানে জেলা শহরে ছয়তলা, উপজেলা শহরে পাঁচতলা এবং গ্রামীণ পর্যায়ে চারতলা ভবন নির্মাণের সুপারিশ করেছে। ব্যাপক ও উচ্চাভিলাষী একটি পরিকল্পনা। তবে অভিনব কিছু নয়। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কেন যেন শিক্ষার উন্নয়ন বলতে ভবন নির্মাণকেই বুঝেন; ভুবন নির্মাণকে নয়। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হলো শিক্ষক, শিক্ষক যদি মেধাবী ও কর্মযোগী না হয়, সুন্দর সুন্দর ভবন বানিয়েই বা লাভ কী? এ নিয়ে আক্ষেপ করে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু - সায়ীদ বলেছেন, ‘ আগে স্কুলগুলো ছিল কাঁচা কিন্তু শিক্ষক ছিল পাকা; এখন স্কুলগুলো পাকা হয়েছে কিন্তু শিক্ষক হয়েছে কাঁচা’।
এই অদল - বদল শিক্ষাকে কতটা সমৃদ্ধ করেছে তা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে।
২ .
সম্প্রতি ‘নিউজ উইকে’ একটি প্রতিবেদন পড়লাম। যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা সংস্কারে একটি বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। কেন এই বিপুল বিনিয়োগ? তাদের বক্তব্য, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো আশানুরূপ উন্নত করা যায়নি।
এর আগে জেনে নেই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র। সেখানে ১৫ জন ছাত্রের জন্য আছেন ১ জন শিক্ষক।
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষকদের বার্ষিক গড় বেতন ছিল ৩৭ লক্ষ ২৬ হাজার টাকা। যে পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই পূর্ণকালীন শিক্ষক তাদের স্বচ্ছলতা অকল্পনীয়। পৃথিবীর ২০ % অতি - স্বচ্ছল পরিবারের একটি তারা।
তারপরও সরকার ভাবছে সুযোগ - সুবিধার অভাবে ছাত্র - শিক্ষকদের লেখাপড়ায় সঠিকভাবে অনুপ্রাণিত করা যাচ্ছে না। তাই ‘এডুকেশন রিফর্মের’ এই নতুন উদ্যোগ।
৩ .
ব্যাপারটা বাহুল্য জেনেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরছি। শিক্ষায় মাথাপিছু বরাদ্দের দিকে অন্য রাষ্ট্রগুলো তো দূরে, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য মাথাপিছু ব্যয় ২৩ ডলার।
যা ভারতে ৪৮, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় ৪২ এবং চীনে ৪৩ ডলার। আবার এ ব্যয়ের একটা বড়ো অংশ চলে যায় অবকাঠামো খাতে। ফলে আমাদের দেশের শিক্ষকরা এ অঞ্চলের সবচেয়ে কম বেতনভোগী শিক্ষক। ‘আর টিভির’ এক টক শো - তে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো - চেয়ারম্যান অধ্যাপক খালেকুজ্জামান ব্যাপারটা স্বীকার করে জানান, ‘ প্রতিবেশী ভারতে একজন মাধ্যমিক শাখার শিক্ষক বেতন ভাতা মিলে প্রায় ৩২ হাজার রুপি পান। ’ আমাদের মাধ্যমিক শাখার সরকারি শিক্ষক পান ১২ হাজার ৪০০ টাকা আর বেসরকারিরা পান হাজার সাতেক টাকার মতো।
আমি সচেতনভাবেই প্রাথমিক শাখার শিক্ষকদের বেতনটা উল্লেখ করতে অনিচ্ছুক। কারণ তাঁদের বেতন কাঠামো এতোই খারাপ যা উল্লেখ করাই তাঁদের জন্য গ্লানিকর। অথচ কাজের বেলায় তাঁরা সবাইকে ছাড়িয়ে। গড়ে ৬০ জন শিক্ষার্থীকে সামলাতে হয় ১ জন শিক্ষককে। শুধু পড়িয়েই খালাস নয়, পায়খানার জরিপ থেকে শুরু করে নির্বাচনের দায়িত্ব সবই তাঁদের করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে।
বাংলাদেশে সম্ভবত এই একমাত্র পেশা যাতে অতিরিক্ত যোগ্যতা বা তৎপরতা প্রদর্শনে কোন ফায়দা নেই। পদোন্নতির তো বালাই নেই, নেই অতিরিক্ত আর্থিক সুযোগ সুবিধার বিধান। উচ্চ মাধ্যমিক পাস একজন মহিলার এখানে যে মূল্যায়ন, সম্মানসহ স্নাতকোত্তরের একই। উপরন্তু ১ ঘণ্টা আগে কর্মে যোগদান করে প্রথম জনই হয়ে যেতে পারেন জ্যেষ্ঠ। ছাত্রদের মূল্যায়নের জন্য বছরে ৩টি পরীক্ষা হয়, অথচ শিক্ষকদের মূল্যায়নের জন্য জীবনেও কোন পরীক্ষা হয় না।
সব মিলিয়ে এ দেশে শিক্ষকতা পেশা হচ্ছে এক অনাকর্ষণীয় ও অবহেলার পেশা। মেধাবীরা আর আসছে না এ পেশায়।
৪ .
শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতার যে অভাব নেই তা কিন্তু নয়। তবে মাঝে মাঝে এসব আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। যেমন সম্প্রতি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির কর্মকর্তা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
তাহলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় তাঁরা কী এতোদিন ৩য় শ্রেণির ছিলেন? বাস্তবে এটা একটা ভাঁওতাবাজি। এ শিক্ষকরা দীর্ঘদিন যাবত ২য় শ্রেণির গ্রেড ( অর্থাৎ ১০ম গ্রেড ) পেয়ে আসছেন। এখন রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য কর্মকর্তার তকমা লাগানো হয়েছে। কিন্তু এ কর্মকর্তা হয়ে শিক্ষকদের বা লাভ কী, শিক্ষা ব্যবস্থারও বা কী লাভ। শিক্ষকরা তো অন্য কোথাও গিয়ে কাজ করবেন না।
লাভ হয়েছে যা সরকারের। কর্মকর্তা ঘোষণার কারণে তাদের আর টিফিন ভাতা দেয়া লাগবে না। বেঁচে যাবে কিছু টাকা।
৫ .
গাছের তলায় পড়িয়েও শান্তি নিকেতন আজ ভুবন বিখ্যাত। ভবন অপ্রতুল হলেও গুণবান শিক্ষকের অভাব নেই সেখানে।
তাই ভবনের চেয়ে শিক্ষার ভুবনে এখন প্রতিভাবান শিক্ষকের প্রয়োজনটা বেশি তীব্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।