আরো একটি পহেলা বোশেখকে স্বাগত জানাবো বলে আমরা প্রস্তুত। প্রতি বছরই একবার করে প্রস্তুতি নিই। বাংলা সন তারিখের জন্মদাতা মোগল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবরের শুরু করা দিন গননা’র এই আয়োজনে মেতে উঠি আমরা ভয়াবহ রকমে। পহেলা বোশেখের ভোরে লালপাড় সাদাশাড়ি এবং পা’জামা পাঞ্জাবি পরে আমরা, অতি আধুনিক বাঙালিরা সমবেত কন্ঠে কোরাস তুলি-
এসো হে বৈশাখ এসো এসো।
কিছুক্ষণের জন্য পাশে বসো...
আমি দু:খিত, দ্বিতীয় লাইনটি আমার বানানো।
অটা সুর করে গাওয়া হয় না। লাইনটির ধারণা কোথ্যেকে পেলাম, সেটা বলি।
যখন এই চরণগুলো গাওয়া হয়, তখন অবচেতন মনের অবস্থা থাকে এমন, এসো হে বৈশাখ এসো এসো। সারাদিন থাকো আমাদের সাথে। খাতির-যত্নের কমতি হবে না।
সন্ধ্যেবেলা আবার চলে যাও! আমরাও ফিরে যাবো আমাদের অতি প্রিয় পশ্চিমা সংস্কৃতিতে। তোমাকে দিয়ে আমাদের পোষাবে না। কেনো বুঝতে পারছো না যুগ পাল্টেছে। একুশের এই আমরা মেতে থাকবো জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি নিয়ে। তবে বছরে একবার তোমাকে ঠিকই স্বরণ করবো।
চিন্তা করো না।
তুমি কিছু মনে করোনা প্রিয় বৈশাখ। তুমি তো আমাদের আপনজন। তোমাকে আমরা আমাদের চেতনার বন্ধ কুটিরে যত্ন করেই রাখবো। সযত্নে তুলে রাখবো আমাদের অস্তিত্বের পাণ্ডুলিপিতে।
এক সময়, কোনো এক সময় আগামী প্রজন্মের কৌতূহলি কেউ জমে থাকা ধূলো-ময়লা ঝেড়ে বের করবে পাণ্ডুলিপিটি। ততক্ষণে আমরা হারিয়ে যাবো কালের গহীনে। সেখান থেকে দেখবো, চেতনার বৈশাখকে তারা বাস্তবতার বৈশাখে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। সে পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষায় থাকতে হবে প্রিয়। আমাদের ক্ষমা করো।
বুঝতেই পারছো সব কাজ সকলের দ্বারা হয় না।
দুই
বৈশাখকে কেন্দ্রকরেই আমাদের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতি। অথবা বাংলাদেশি। আচ্ছা আমরা কি বাঙালি? নাকি বাংলাদেশি? নাকি দু’টোই?
বাঙালি হই আমরা, কিংবা বাংলাদেশি, কী আসে যায়! আমাদের হাড্ডিসার শরীরে বাঙালির পোশাক পরানো হোক অথবা বাংলাদেশির, যেমন আছি তেমনই তো থাকতে লাগবে।
অনেকটা লোহার মতো। লোহাকে যত বড় হাতুড়ি দিয়েই পেটানো হোক, লোহা লোহাই থাকে, স্বর্ণ হয়ে যায় না।
আমাদের অবস্থাও তাই। ৫ বছর আমাদের ঘাড়ে পড়বে বাঙালি হাতুড়ির বাড়ি, পরের ৫ বছর বাংলাদেশি হাতুড়ির। যে হাতুড়ির মাথায় লাগানো থাকে হরতাল,অসহযোগ,জ্বালাও, পোড়াও কিংবা ঘেরাও।
আমরা জ্বলতে থাকি। আমরা পুড়তে থাকি। হাতুড়ির আঘাত আমরা সহ্য করতে থাকি। সহ্য আমাদের করতেই হয়। চিৎকার করে কাঁদতেও পারিনা আমরা।
সেই অধিকার আমাদের নেই। আমরা আমাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও সুখ-দু:খের ৫ বছর মেয়াদি কণ্টাক দিয়ে দিই গুটি কতেক লোকের হাতে। তারা দয়া করে আমাদের হাসতে বললে আমরা হাসবো, কাঁদতে বললে কাঁদবো, ব্যস। তাহলে অহেতুক বিতর্কের পেছনে ছুটে দরকার কি!
থাকুক অসব কথা। বাঙালি-বাংলাদেশি নিয়ে মাথা আমরা না ঘামালেও চলবে।
আমরা বরং ওয়ানটাইম বাঙালিদের নিয়ে কথা বলতে পারি।
যে কোনো দিন, টিএসসি মোড়, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফ্যান্টাসি কিংডম অথবা দেশের বিশ্ববিদ্যালযগুলোর সোনালি বিকেল। ঘুরে আসুন একবার। রং উঠা ছেড়াফাড়া জিন্স টি শার্টে আবিস্কার করবেন শতশত মানুষ। কপাল কিংবা মাথায় সানগ্লাস, গলায় চেইন, হাতে ব্রেসলেট, কানে দুল।
মানুষ বললাম কারণ, আমি বাজি রেখে বলতে পারি বাহ্যিক দৃষ্টিতে আপনি চিনতে পার্েন না এদের মধ্যে কারা তরুণ আর কারা তরুণী! আলো-আঁধারির নীলাভ মিলনমেলা চায়ানজ যাদের লাঞ্চ কিংবা ডিনারের ঠিকানা। ড্যাঢি-মাম্মিতে অভ্যস্ত এই প্রজন্ম কখনো যদি-বাবা-মা কারে কয়, এই প্রশ্নও করে বসে, অবাক হবার কিছু থাকবে না।
তাই বলে এরা যে পশ্চিমা মোহে পড়ে বাঙালি সংস্কৃতি একেবারেই ভুলে গেছে, এটা ভাবলে ভুল হবে। এটা প্রমাণ করবার জন্যে পহেলা বৈশাখ তো রয়েছেই। পহেলা বৈশাখে আমাদের তরুণ-তরুণীরা প্রচন্ড আবেগ নিয়ে এসে জড়ো হয় রমনা বঠমূলে।
হিন্দি ছবির অর্ধেকটা দেখে বাকি অংশ গিয়ে দেখবার নিয়ত করে চলে আসে বাঙালিত্বেরই টানে! যে টান হৃদয়ে লালিত হবার কথা, অতি আবেগে সেটা কখনো কখনো চলে আসে হাতে। মাঝেমধ্যে কিছু হাত আবার চলে যায় কোনো ওড়নার সন্ধানে! অতি বাঙালিত্বের উন্মাদনায় ওরা ভুলে যায় এমনি এক নিউ ইয়ার সেলিব্রেটের রাতের সাথেই জড়িয়ে আছে বাধন’েদর আর্তচিৎকার। সাথে বিকারদের পেশাচিক হাসি। এতো ভুলো মন কেনো আমাদের!
পহেলা বৈশাখের ভোরে বর্ষবরণের আঙিনায় স্বাগত আপনাকে। কিছুক্ষণের জন্য চোখ জুড়িয়ে যাবে আপনার।
অতি আধুনিক মানুষগুলোকে আবিস্কার করবেন খাটি বাঙালি পোশাকে। লাল পাড় সাদা শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি-পা’জামা পরা মানুষ। স্যান্ডউইচ বা বার্গার না, তাদের সামনে দেখবেন আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহি মাটির সানকিতে পান্তার ফাঁকে চিকচিক করছে পদ্মার ইলিশের ঝোল। পিঁয়াজ ও কাঁচামরিচে তৃপ্তির কামড় দিয়ে চোখে মুখে এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে, যেনো অমৃতের ঝরনায় সবেমাত্র গোসল করে উঠলো তারা! যদিও অনভ্যাসের কারণে সন্ধ্যেবেলা তাদেরকে আবার ভিড় জমাতে দেখা যায় পাশের ফার্মেসিগুলোতে, ওরস্যালাইনের খুঁজে। সেটা ভিন্ন ব্যপার।
আমরা মনে করি সারা বছর যারা ডুবে থাকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে। বাংলা নববর্ষের আঙিনায় জড়ো হবার কোনো অধিকারই তাদের নেই। এদেশের অসহায় মানুষ ঘরের চালের ছিদ্র এবং তাদের চোখ দিয়ে একই সাথে টপ টপ করে পড়তে থাকা পানিতে ভিজে স্যাঁতসেত মেঝেয় বসে পান্তা খায় লবন ও মরিচ মাখিয়ে। ইলিশের গন্ধ তাদের কল্পণাতেই তাকে শুধু। ওরা পান্তার আশ্রয় নেয় বেঁচে থাকবার জন্যে।
অসহায় মানুষের কষ্টের অংশিদার না হতে পারি, সেই গরিবের খাদ্য নিয়ে এক ধরনের উপহাস করবার কোনো অধিকারই কারো নেই।
সারা বছর চায়নিজ-থাই খাবার খেয়ে আপ মডেলের মার্সিটিজ-বিএমডব্লিউ হাঁকিয়ে পহেলা বৈশাখ চলে আসবেন বঠমূলে! বাঙালি হতে! এটা তো মানবিক অপরাধের পর্যয়ে পড়ার কথা। যেমন আছেন, যেভাবে আছেন, তাই থাকুন। একদিনের বাঙালি হবার দরকার কি??
আমরা আশা করতে চাই, ৩০মে চৈত্র ১৪১৭’র সাথে সাথে আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিক আমাদের মনের ভেতরের যত আবর্জনা। বিদায় নিক যত শঠতা।
বিদায় নিক বর্তমান নিয়ে, আগামী নিয়ে যত সংশয়।
পহেলা বৈশাখ আসুক। থাকুক আমাদের সঙ্গে, আমাদের স্বরণ করিয়ে দিতে, আমরা বাঙালি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।