all in one
একটি ছোট্ট শিশু শুধু জাঙ্গিয়া পরে মাঠে খেলছে। পাটনায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। এমন সময় এলেন এক নাগাসন্ন্যাসী। নানা রকম কথাবার্তার পর সন্ন্যাসীর নজর পড়ল ওই মেয়েটির দিকে। খালি গা মেয়েটিকে দেখে সন্ন্যাসী বললেন, মেয়েটি সুলক্ষণা।
বড় হলে ওর নাম হবে, অনেক টাকা হবে। ভবিষ্যদ্বাণী কাকতালীয় হলেও সত্যি সত্যিই সফল হলো। মেয়েটি বড় হয়ে এমন খ্যাতি অর্জন করল যে এখনো তার নাম বাঙালির মুখে মুখে। ওই মেয়েটির নামই রমা_অর্থাৎ সুচিত্রা সেন। ৬ এপ্রিল তাঁর ৮০ বছর পূর্ণ হলো
কলকাতা থেকে স্টকহোম কত দূর? কিংবা টালিউড থেকে হলিউড? দূরত্ব তো আছেই।
কিন্তু সে কথা ভুলেও যাওয়া যায়! বাঙালি আর সুইডিশ অথবা আরো ছড়িয়ে বললে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের তফাত কতটুকু? উন্নতির সোপানে হোক না নিচতলা-পাঁচতলা_সেই ফারাকও ভুলে থাকা যায়। প্রায় অভাবনীয় এমন তুলনাকে যৌক্তিক করে তোলে দুই অভিনেত্রীর ব্যক্তিত্বের অবিশ্বাস্য মিল। বাংলা আর হলিউডের ছবির তফাৎ সেখানে তুচ্ছ। পাবনার মেয়ে কলকাতায় গিয়ে বাঙালির আটপৌরে জীবনে এমনভাবে ঢুকে পড়েন যে ৩৩ বছর চোখের দেখা না দিয়েও হৃদয়ে তিনি তরতাজা। ওদিকে স্টকহোমের এক মেয়ে নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমিয়ে জয় করে নেন হলিউড।
ক্যারিয়ারের একটি পর্যায়ে তাঁরও মনে হলো_জীবনের জন্য 'লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন'-এর আকর্ষণ একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। চার দেয়ালের বাইরে পা রাখারও আর খুব একটা দরকার নেই। একান্ত প্রয়োজনে সাময়িকভাবে অন্তঃপুর ছাড়লেও ক্যামেরা আর মানুষের চোখ এড়িয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়াই সর্বোত্তম। রূপালি পর্দা ছাড়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন ওভাবেই কাটিয়েছেন তিনি। বলছিলাম হলিউড হার্টথ্রব গ্রেটা গার্বো আর 'বাঙালির গ্রেটা গার্বো' সুচিত্রা সেনের কথা!
এপার বাংলা ওপার বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এক্ষুনি একটা জরিপ চালানো যাক।
খোঁজ নিয়ে দেখা যাক সুচিত্রা সেনের নাম শোনেনি বা তাঁর ছবি দেখেনি এমন পরিবার আছে কি না। সম্ভবত এমন পরিবার একটাও পাওয়া যাবে না। অধিকাংশের মুখে সুচিত্রার সঙ্গে উত্তম কুমারের নামটাও আসবে। স্বাভাবিক। বাংলা ছবির ইতিহাসে উত্তম-সুচিত্রার মতো জনপ্রিয় জুটি যে আসেনি! সাদা-কালোর যুগে ৩০টি ছবিতে তাঁরা এমন জাদুর মায়া ছড়িয়ে গেছেন যে আজও তাঁদের নাম ঘরে ঘরে, মুখে মুখে।
মেয়ে হয়তো কোনো সিরিয়াল বা হিন্দি ছবির জন্য এই চ্যানেল ওই চ্যানেল করছে, পাশ থেকে হঠাৎ মা বলে উঠলেন_'সুচিত্রাকে দেখলাম মনে হলো, চ্যানেলটা ধর তো!' আবার কোথাও হয়তো কোনো তরুণ খেলার চ্যানেলে যেতে পারছে না বাবা-কাকা বা দাদুর বাড়াবাড়ি সুচিত্রাপ্রীতির জ্বালায় (!)। এই প্রীতিকে আজ যাঁদের জ্বালা মনে হচ্ছে, একসময় তাঁদের অনেকের পছন্দের তালিকাতেই ঢুকে পড়বে সুচিত্রা সেন অভিনীত 'দ্বীপ জ্বেলে যাই', 'উত্তর ফাল্গুনি', 'সাত পাকে বাঁধা', 'শাপমোচন', 'সাগরিকা', 'হারানো সুর', 'সপ্তপদী' বা 'গৃহদাহ'র মতো ছবি। বাঙালি পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এভাবেই স্থায়ী সুচিত্রা।
পুরুষের কাছে অনুকরণীয় আর মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ হয়ে জনপ্রিয়তায় সুচিত্রার চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে উত্তম। তাই বলে 'মহানায়ক' যে সুচিত্রার আবির্ভাবের পরেই সে অর্থে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন সে কথা ভুলে গেলে চলবে না।
পাবনার স্কুলশিক্ষকের মেয়ে রমা দাশগুপ্ত দিবানাথ সেনকে বিয়ে করে হলেন কলকাতাবাসী। ৫৯ বছর আগের কথা। হ্যাঁ, ভাষা আন্দোলনের বছরেই সুচিত্রা সেন নামে 'শেষ কোথায়' ছবি দিয়ে শুরু রমার অভিনয় জীবন। প্রথম ছবি মুক্তি পায়নি। পরের বছর মুক্তি পেল চারটি, এর মধ্যে 'সাড়ে চুয়াত্তর' সুপার হিট।
উত্তমের ক্যারিয়ারেরও প্রথম হিট ছবি এটা।
উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়জয়কার আর সেই সূত্রে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন যুগের সূচনাও 'সাড়ে চুয়াত্তর' দিয়েই।
পরের প্রায় ২০ বছরে 'হারানো সুর', 'সপ্তপদী', 'সাগরিকা', 'পথে হলো দেরি'সহ বেশ কিছু কালজয়ী ছবি উপহার দিয়েছে এই জুটি। একেক ছবিতে সুচিত্রার একেক রূপ। 'হারানো সুর' ছবিতে স্মৃতি হারিয়ে ফেলা অলক মুখার্জিকে (উত্তম) সারিয়ে তোলে ডা. রমা ব্যানার্জি (সুচিত্রা)।
বিয়ে হয় তাদের। কিন্তু আরেক দুর্ঘটনায় স্মৃতি ফিরে পেয়ে অলক ভুলে যায় রমাকে। হলিউডের 'র্যান্ডম হারভেস্ট' ছবির ছায়া অবলম্বনে নির্মিত 'হারানো সুর' ছবিতে অলক-রমার প্রেমের কথা উত্তম-সুচিত্রা ভক্তরা কোনো দিন ভুলতে পারবেন না। ভোলা সম্ভব নয় 'সপ্তপদী'তে ধর্মের দেয়াল ডিঙিয়ে দুজনের কাছে আসার কথাও। 'শিল্পী' ছবির সুচিত্রাকেই বা ভুলবেন কী করে! তাকে ভালোবেসে আঘাত পেয়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরে ধীমান।
শেষ দৃশ্যে নিজের হাতে প্রেমিকার মূর্তি গড়ে সেই মূর্তির পাশেই অন্তিম শয্যা নেয় সে!
তাদের জুটি তুমূল জনপ্রিয়তা পেলেও সুচিত্রা কখনোই উত্তম কুমার-নির্ভর হয়ে পড়েননি। অন্য নায়কদের সঙ্গেও তাই সুপারহিট ছবি আছে অনেক। বিকাশ রায়ের সঙ্গে 'উত্তর ফাল্গুনি'_যেখানে ছোটবেলাতেই মাকে হারানো দেবযানি বাবার ঋণ শোধ করতে বিয়ে করে এক মদ্যপ লম্পটকে। মেয়ে সুপর্ণাকে লেখাপড়া শেখাতে দেবযানি হয়ে যায় পান্না বাঈ। মা আর মেয়ের দ্বৈত ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন সুচিত্রা।
'দ্বীপ জ্বেলে যাই' ছবিতে অপ্রকৃতস্থ বসন্ত চৌধুরীকে প্রেমিকা সেজে সেবা আর ভালোবাসা দিয়ে সারিয়ে তুলতে গিয়ে নার্স রাধা নিজেই প্রেমে পড়ে যায়। তাপস সেরে ওঠে। কিন্তু তাকে হারানোর কষ্ট সইতে না পেরে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে রাধা। শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই হয় তাপসের ছেড়ে যাওয়া ২৩ নম্বর কেবিনে!
বাংলা জয় করে মুম্বাইয়েও গিয়েছিলেন সুচিত্রা। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ('৫৫) দিলীপ কুমারের সঙ্গে 'দেবদাস' ছবি করে জিতে নেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।
পরে আরো পাঁচটি ছবি করলেও 'আঁধি' ('৭৫) ছাড়া আর কোনো হিন্দি ছবিই আলোচনায় আসেনি। 'আঁধি'তে সুচিত্রা সাহসী রাজনৈতিক নেত্রী। সেই চরিত্রের সঙ্গে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবন কিছুটা মিলে যাওয়ায় ছবির প্রদর্শনী কিছু দিন বন্ধও রাখা হয়েছিল। সুচিত্রার বয়স তখন ৪৪। পরে আরো বছরতিনেক ছিলেন অভিনয়ে।
'৭৮-এ 'প্রণয় পাশা' দিয়ে শেষ। তারপর আর এক মুহূর্তের জন্যও জনসমক্ষে আসেননি। অসুস্থ হয়ে একবার হাসপাতালে গেলেন। এক টিভি সাংবাদিক রোগী সেজে ঢুকে পড়লেন হাসপাতালে। নকল রোগী আসল রোগীর ছবি-টবি তুলে বেরিয়ে এলেন।
'এঙ্ক্লুসিভ রিপোর্ট' প্রচারিত হবে রাতে। শুনে মুনমুন সেন ছুটে গেলেন। মায়ের পক্ষ থেকে তাঁর অনুরোধ,' দয়া করে রিপোর্টটা প্রচার করে গোপনীয়তা এবং ব্যক্তিজীবনের শান্তি বিঘি্নত করবেন না। ' ফোনে ভক্তরাও এ অনুরোধ করায় শেষ পর্যন্ত রিপোর্ট প্রচার করলেও সুচিত্রাকে দেখানো হয়নি।
ক্যামেরা খুঁজে বেড়ায় তাঁকে আর তিনি কিনা জোর করে খুঁজে নেন আড়াল।
এ যুগে! যখন কিনা একটু প্রচারের আশায় দেহ ছাড়া নিজেকে 'বাজারজাত' করার আর কিছু নেই_প্রকারান্তরে তা মেনে নিয়ে পুনম পাণ্ডেরা বিবস্ত্র হওয়ারও সুযোগ খোঁজেন। সাধারণ আর অসাধারণের ফারাকটা বুঝি এখানেই। পুনম পাণ্ডে, এমনকি নিজের সন্তান মুনমুনের পাশেও সুচিত্রা সেন তাই বড় বেশি বেমানান। বাঙালি, সুইডিশ, টালিউড, হলিউডের তফাৎ ভুলিয়ে তিনি তাই 'বাঙালির গ্রেটা গার্বো'। 'দ্য সিঙ্গেল স্ট্যান্ডার্ড' ছবিতে গার্বোকে বলতে শোনা যায়, 'আই অ্যাম ওয়াকিং অ্যালোন বিকজ আই ওয়ান্ট টু বি অ্যালোন।
' অভিনয়জীবন শেষে সে জীবনই বরণ করেছিলেন তিনি। প্রচারের আলোয় আসেননি একবারও। প্রচারের নিরন্তর হাতছানিকে তাচ্ছিল্য করে সুচিত্রা সেনও চার দেয়ালে বন্দি। প্রায় ৩৩ বছর ধরে!
জুটি উত্তম-সুচিত্রা
'সাড়ে চুয়াত্তর' দিয়ে উত্তম-সুচিত্রা জুটির 'প্রেম' শুরু। অথচ মজার ব্যাপার হলো, এ ছবিতে সুচিত্রা সেনের কাজ করারই কথা ছিল না।
রমলা চরিত্রের জন্য আগে থেকেই মালা সিনহাকে ঠিক করে রেখেছিলেন পরিচালক নির্মল দে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ান মালা সিনহা। বিপাকে পড়ে যান পরিচালক। কপাল খোলে উঠতি নায়িকা সুচিত্রা সেনের। ইন্ডাস্ট্রিতে তখন একেবারেই নতুন মুখ সুচিত্রা সেন।
ঝুলিতে মাত্র দুটি ছবি, প্রথমটি আবার মুক্তিই পায়নি। ছবির সংখ্যার বিচারে উত্তম কুমারের অবস্থা সুচিত্রার চেয়ে ভালো, তবে দর্শকের মন পায়নি। তখন পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ৯টি ছবির আটটিই সুপার-ডুপার ফ্লপ, একটির কাজ শেষই হয়নি, হিট মোটে একটি ছবি। ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে টিকবেন কি না তার অনেকটাই 'সাড়ে চুয়াত্তর'-এর সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। তবে ভরসার জায়গাও ছিল_তখন পর্যন্ত উত্তম কুমারের একমাত্র হিট ছবি 'বসু পরিবার'-এরও পরিচালক ছিলেন এই নির্মল দে।
আর ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনা দেবীর মতো অভিনেত্রী।
১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল 'সাড়ে চুয়াত্তর'। জন্ম নিল বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সফল ও স্থায়ী এক জুটি। পূর্ববর্তী ছবিগুলোর ব্যর্থতার দায় আমার না_নানাজনের কাছে বলা উত্তম কুমারের এই দাবির সত্যতাও প্রমাণ করল এ ছবির সাফল্য। উত্তম কুমার বরাবরই বলে আসছিলেন, নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নায়িকাও আনতে হবে নতুন।
কিন্তু তাঁর বিপরীতে দেওয়া হচ্ছিল পুরনো নায়িকাদের। তাই 'সাড়ে চুয়াত্তর' তাঁর জন্যও বড় ঘটনা। আসলেই ছবিটিতে সুচিত্রা সেনকে লুফে নিল দর্শক। তবে উত্তম-সুচিত্রার যে যুগল রূপ সাধারণ দর্শক সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হলো আরো দেড় বছর। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পেল 'অগি্নপরীক্ষা'।
জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দিল উত্তম-সুচিত্রার এই ছবি। তারপর আর পেছন ফেরার সময় মেলেনি। 'সপ্তপদী'র সেই বিখ্যাত গানের মতোই মনে হচ্ছিল আসলেই বুঝি কোনো দিন শেষ হবে না এই পথ। তবে সব ভালোরই শেষ আছে, নইলে ভালো যে আর ভালো থাকে না। '৫৩-তে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল '৭৫-এ 'প্রিয় বান্ধবী'র মাধ্যমে তা শেষ হলো।
পরে হয়তো আবার শুরু হতে পারত এ যাত্রা। কিন্তু তার আগেই চিরতরে বিদায় নিলেন উত্তম, অন্তরালে চলে গেলেন সুচিত্রা।
২২ বছরে মুক্তি পেয়েছে এ জুটির ২৯টি ছবি। তার মধ্যে আছে 'সাড়ে চুয়াত্তর', 'একটি রাত', 'হারানো সুর', 'সপ্তপদী', 'গৃহদাহ', 'কমললতা'র মতো ছবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।