আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রিকেট নৈর্বক্তিকতা ও ভারত বিরোধীতায় একটি পেটি বুর্জোয়া সুলভ রচনা

যমজজীবন

পাকিস্থান আমাদের পুরোনো শত্রু, আর আজকের দিনে ইণ্ডিয়া নয়া শত্রু। ক্রিকেট বিষয়ক ক্রেইজ সে শত্রুতার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কে কম বা কে বেশী এ তুল্যমুল্যের ঘোল পাকানোর দিকে নজর ঘুরিয়ে নেয় এবং শত্রুর প্রতি গ্রহনযোগ্য মানসিকতার আবদার তৈরী করে। রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পন্ন দেশপ্রেমিক সমাজ পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষীর, ন্যায্যতার জন্য লড়াকুর কাছে এ ক্রেইজ কাজ করলে চলে না। আমাদের দিক থেকে পুরোনো শত্রুর(পাকিস্থান) বিরোদ্ধে নয়া শত্রুকে(ইণ্ডিয়া) লড়তে দেখলে আজিকার ‘নয়া শত্রু ইণ্ডিয়া’কে বন্ধু ভাবার মধ্যবিত্তিয় রোগ আছে। সাপ আর বেজি মারামরি করে আর ব্যাঙের চরিত্র নিয়ে আমরা উভয়চর হয়ে পড়ি।

কিন্তু আমরা ব্যাঙেরা কার খাদ্য আমরা ভুলে যাই। এ রোগ নয়া শত্রুর বিরোদ্ধের রাজনৈতিকতাকে আরো হালকা করে দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতায় দেশপ্রেমিক বন্ধুদের কাছে- আসল কাজ হলো পুরোনো শত্রুকে পদানত করার মানসিক জোর নিয়ে নতুন শত্রুর দিকে ঘরে-বাইরে যুদ্ধ জারি রাখা ও সে অনুযায়ী কাজ করে যাওয়া। যখন আমরা বলতে চাচ্ছি- মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি তখন সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আধিপাত্যবাদি ভারত এর বিপক্ষে যায়। পুরোনো শত্রুকে ঘৃণা করা আর নয়া শত্রুকে ঘৃণা বা তার বিরোদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখবার জন্য ক্রিকেট অস্ত্র, ক্রিকেট উত্তেজনা অদরকারী এবং মারাত্মক হাস্যকর ও আত্মঘাতী।

এ যুগের রাজনৈতিক সচেতনতা অচেতন/প্রচ্ছন্ন থাকবার ফলে আমরা নয়া শত্রুকে অনেক সময় চিহূত করতে অমনোযোগি হয়ে পড়ি। অস্পষ্ট করার ক্ষেত্রে, অমনোযোগিতা বাড়াবার কলকাঠি হিসেবে এসব ক্রিকেট বা প্রতিযোগিতা বিষয়ক নানান ধরনের জুয়াবাজী হাজির থাকে। যেমন দেশপ্রেমের বিজ্ঞাপনী চেহারা নিয়ে করপোরেট চরিত্র নিজেকে আড়াল করে। বাজারে লটারির মাইক লক্ষ্য করা থাকে নিন্মশ্রেণী আর মধ্যশ্রেণীর মোহ-মনকে খপ করে ধরার তালে। এ লটারির মাইকের জুয়াবাজি ধরে ফেলতে হবে।

কানে তুলা দিয়ে এড়িয়ে যাবার রাস্তা নেই। এসমস্ত কথার নিরেট সারবস্তুটা হচ্ছে- বুর্জোয়াদের তৈরী এসব উপাদন পেটি বুর্জোয়ারা পুষ্টি ভেবে জিভে তুলে নেয়, অথচ পেটি বুর্জোয়ারা এসব উপাদন গ্রহন করলে সুদে-আসলে বুর্জোয়ারাই রিষ্টপুষ্ট হয়, এটা মনে রাখতে হবে। এসবের ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে- দরকারী জিনিষ হচ্ছে রাজনৈতিক সক্রিয়তা/পাল্টা প্রপাগাণ্ডা। ‘মেহেরজান’ বা ‘শর্মিলা বসু’কে প্রতিরোধ করার জন্য রাজনৈতিক সক্রিয়তাই আগে দরকার। পাকিস্থান ইণ্ডিয়ার হাতে হেস্তনেস্ত হচ্ছে এ সস্তাসুখ নিয়ে মেহেরজান/শর্মিলা বসু/পাকিস্থান-রাজাকার বধ হয়ে যায় না, বরং ফেলানীর খুনিকেই সমর্থন করার বেখাপ্পা হাততালি দেখা যায়।

ইতিহাসের ঠোঙ্গা/পুটলি/বাক্স ঠিকঠাক রক্ষা করতে না পারলে এমন মামুলি সুখে স্বপ্নদোষ ঘটে যেতে পারে। প্রায় মধ্যবিত্ত বলে ক্রিকেট ক্রেইজটা হয়ত আমাকেও ধরে বসে। আফিম-গাঞ্জা-ইণ্ডিয়ান ফেন্সিডেলের গন্ধে আমিও হয়ত যৎকিঞ্ছিত মাতাল হই। সে সুবাধে আমিও চাই পাকিস্থান হারুক, পাকিস্থান ধ্বংশ হোক, পরমানু ফেটে চিত হয়ে ভেটকাই পড়ুক। এটা চাই ৭১’র ঐতিহাসিক ঘৃণা থেকে, যেমনটা চাই ইণ্ডিয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান ভারতীয় পুঁজির আগ্রাসন থেকে বাঁচতে।

কিন্তু ইণ্ডিয়ার ক্ষেত্রে ইণ্ডিয়া খেলায় হারলে বিশেষ লাভ আছে বলে মনে হয় না। ওতে চকচকে সাদা ইণ্ডিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ে না। জুয়ায় একদিন হারলে আরেক দিন জিতে যাবে এটা তারা জানে। এ হার-জিতের মান-অপমানের সমস্যা টাকাওয়ালা জুয়াড়ীর, -কালো ইণ্ডিয়ার আধপেট খাওয়া না খাওয়া ন্যাংটি পরা গরিবেরও কিছু আসে যায় না। ওটা সোনিয়া গান্ধির, শারুখ খানের, ক্রিকেটের পেছন অকাতরে টাকা ঢালা ধনীর মান-ইজ্জত, তাদের বাজার রক্ষার সুবিধা-অসুবিধা।

যেমনঃ বাংলাদেশে উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে রিক্সা চড়ে সব দেশের ক্রিকেটার মাঠে প্রবেশ করেছে এতে কি রিক্সাওয়ালার মান-ইজ্জত-সুযোগ-সুবিধা-ন্যায্যতা বেড়েছে? ক্রিকেট পাগলা চ্যাংড়া মনের ভাইয়েরা আমার সে রিক্সাওয়ালাদের আজকের আন্দোলন সংগ্রামে কি সমর্থন ব্যক্ত করছেন? যে রিক্সাকে নান্দনিকতার চড়া রঙচঙ দিয়ে এত হুলুস্থুল ঘটালেন তার ফিকে মুখটার প্রতিও সমর্থন চাই। যে আধিবাসি গান-নাচকে নিছক সংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলে উদ্ভোধনী মাঠে চরালেন সে আধিবাসিদের এখন কি অবস্থান এ সম্পর্কে আপনি কি আপডেড না ঐশ্বরিয়া রাই কোন ইনজেকশন পাছায় মেরে শরীরের চামড়া টানটান রাখে তার খোঁজেই আপনি ব্যস্ত। এসব আমার মূল কথা নয়, আমার আসল মতলবটা হলো আপনাকে এটা জানানো যে- নীপিড়ক রাষ্ট্র তার নীপিড়নকে আড়াল করার জন্য ধনী-মধ্যবিত্ত-গরিবের পার্থক্য/দূরত্বের মধ্যে এমন কিছু ‘নৈবক্তিকতা’ হাজির রাখে যে নৈর্বক্তিকতা পার্থক্য/দূরত্বকে আপাত সহনীয় করে, পালিশ দেয়, ভুলিয়ে দেয়। যেমনঃ মুসলমানের ঈদ আর হিন্দুর পূজা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করে। একটা সময়ের জন্য এক দাগে এনে পার্থক্য/দূরত্বের মোটা দাগকে কিছুটা হালকা করা হয়।

ক্রিকেট বা এমন ধরণের জুয়াড়ী উৎসব সেই জাতিগত ভেল্কিবাজির একাত্বতা/নৈর্বক্তিকতাকেই প্রাকেপ্রকারে হাজিরনাজির রাখে। আড়ালে রাখে একে অন্যের উপর আধিপত্য। যদিও বাংলাদেশ হারলে আপনি মধ্যবিত্ত, আপনি ধনীর মতো রিক্সাওয়ালা ভাইয়েরও মন বেজার হয়। কিন্তু মন বেজারের মধ্যে কিছুটা হেরফের আছে বলে মনে হচ্ছে। গরিব রিক্সায়লার সমর্থনের মধ্যে দেশপ্রেম আছে কিন্তু রাষ্ট্রপ্রেম নাই।

কিন্তু আপনার সমর্থনে যতটা দেশপ্রেমের কাণ্ড আছে তারচেয়ে সারবস্তুতে বুর্জোয়া/ধনীর স্বার্থে তৈরী রাষ্ট্রপ্রেমের সপ্তকাণ্ডটাই ঘটে থাকে, হয়ত আপনি মধ্যবিত্ত ভাইয়ের অজান্তেই তা ঘটে, রক্ষা করে চলেন। পাকিস্থান হারলে নিজ দেশ জয়ী হবার মতোই আনন্দ পাই। যেমন আনন্দ লাগে বৃটিশ বধ হলে। কারো অযথা ভাবার দরকার নাই আমার পাকিবাদী প্রেম আছে। এ ব্যাপারে ঠ্যাং ধরে মাপ চাই হে মধ্যবিত্ত শ্রেণী সম্মন্ধীয় ‘জাত’ ভাইয়েরা আমার।

অযথা জল-পানি ঘোলা করবেন না। পেটে নাইকে হিন্দুয়ানী নাইকো মুসলমানি, যাহা জল তাহাই পানি। কিন্তু আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা একটু দযা করে বুঝে আনেন, আমাকে ভুল বুঝবেন না। -পাক-ভারত ক্রিকেট খেলা হবে আর তা নিয়ে উগ্রপন্থী উত্তেজনা ঘটবে না তা তো হয় না। আর উত্তেজনায় নাভিশ্বাস উঠানামায় হয়ত কারো কারো দম বন্ধেরও জোগার হবে।

এর ঐতিহাসিক/রাজনৈতিক কারণ যেমন আছে তেমনি অকারণের কারনও আছে। ভারতের কাছে পাকিস্থানকে হারাতে দেখলে আমরা বাংলাদেশ ভারী খুশি হই, বাংলাদেশ পাকিস্থানকে হারালে ভারত হয়ত আমাদের প্রতিও খুশি হয়, তেমনি হয়তবা ভারতকে বাংলাদেশ হারাতে পারলে পাকিস্থান অপেক্ষাকৃত ভাবে আমাদের প্রতি খোশ থাকে। হায় খোদা এ কোন গোপনে ‘মনস্তাত্ত্বিক বিচারে’ কে কার বন্ধু হয়ে পড়ি? মা দুর্গা এ কোন কোনাকাঞ্চি থেকে নৈর্বক্তিকতা হাজির রাখ? ঘৃণা হয়ে যদি প্রতিরোধের স্তর না ছুঁইতে পারি তবে ঘৃণা-পছন্দ ব্যাপক গোলমালে পাকানো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। ঠিক এমন ‘নৈর্বক্তিকতা’কে কাঠগড়ায় তুলে ভাবুন তো আখেরে কি লাভ হচ্ছে? কার লাভ হচ্ছে? –পাকিস্থান হারলো আর ভারত জয়ী হলো, এতে একদিক থেকে আমরা পাকিস্থান হারে জয়ের স্বাদ পাচ্ছি। আল্লা বাঁচাইছে পাকিস্থানী পতাকা পাকিবাদীদের মনে উড়লেও বাংলার আকাশে উড়ে নাই।

কিন্তু মনে যে উড়ছে সেটা ঠেকাবেন কি করে? আর যেসব তরুন ইতিহাস অচেতন হয়ে পাকিস্থানী ক্রিকেট দলের সমর্থন দিচ্ছে তাদের নির্বিচার গালিগালাজ করলেই কি তা উবে যাবে? (যে তরুন ইতিহাস জেনেও সচেতন ভাবে পাকিস্থান সমর্থন করে, আর যে তরুন ক্রিকেট ক্রেইজ বশতঃ ও ইতিহাস অচেতন থেকে সমর্থন দিচ্ছে দু'য়ের মধ্যে ফারাক আছে। ) এবার অন্যদিক থেকে মনে রাখতে হবে- যদি 'আত্মায় জারাজরাই পাকিস্থানের সমর্থন করে' তবে 'ইণ্ডিয়ার কাছে বর্তমানে আত্মবিক্রয়কারীরাই পদানত থাকে'। ভারতের জয়ে খুশিতে সীমান্তে বিএসএফ এলাপাতাড়ি গুলি করে দু’একটা বাঙালী পাখি মেরে ফেলতে পারাটা অবাস্তব কিছু নয়। রূপক অর্থে বললাম। গুলি তো নানা ভাবেই ছুটে আসবে, ফুটা হবে কলিজা।

সে বিচারে দেশপ্রেমিক সকল বিপ্লবী কমরেড আর দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল(অনেক ক্ষেত্রেই যারা অরাজনৈতিক) ও হরহামেশাই দ্বিধা-ধন্দে থাকা মধ্যবিত্ত বন্ধুদের কাছে এ প্রত্যাশা রইল- আসুন, সকলে জোর গলায় বলুন- আমরা যেমন পাকিস্থান প্রেমে কুরবান নয় তেমনি - ‘ভারত আমরা তোমাদের প্রেমেও কুরবান নয়’।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.