,,,কুয়াশার আড়ালে লুকানো ঘটনা কুয়াশার চাদরে জড়ানো সকালের মোহনীয় রূপের মত নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক, নির্মোহ নয়,,,
-বাবা, তুমি এখন কি করছো?
-আন্টি, আমি পড়ছি।
-ও, তা পড়া শেষ করে কি করবে ভেবেছো কিছু?
-না আন্টি, সবাই যেদিকে হাটে আমিও সেদিকেই হাটব, একটু হেসে বললাম আমি।
-জি.আর.ই. এর প্রিপারেশন কেমন? কানাডায় স্কলারশীপের জন্য এটলিস্ট ১২০০ তো পেতেই হবে।
-আন্টি আমি দেশেই থাকব। পারলে এম.বি.এ টা কম্পলিট করে ফেলব।
-এত ভাল একটা জায়গা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও দেশেই থাকবে! আন্টি হঠাত চমকে ওঠেন। এরপর তার কপালে বিরক্তির রেখা ভেসে ওঠে।
উপরের কথোপকথন হয়তো আপনি ধরতে পারেননি।
কথাগুলো হচ্ছিল আমার আর আমার ছোট ভাইয়ের ফ্রেন্ডের মায়ের সাথে। ভদ্রমহিলাকে আমি কোচিংয়ে আগেও দু’একবার দেখেছি।
কিন্তু কখনোই এত ডিটেইল কথা হয়নি যাতে করে উনি জানবেন যে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স প্রায় শেষের পথে। অবশ্য আম্মু বলে থাকতে পারে। আজকালকার মায়েরা তো কোচিংয়ে এসে দুই সেশনে তাদের গল্প চালান। অনেকটা টেস্ট ক্রিকেটের মত। প্রথম সেশনে থাকে ‘কাহানী ঘার ঘার কি’ সিরিয়ালের ‘আগলী এপিসোড মে’ তে যা হতে পারে তার প্রেডিকশন করা।
আর সেকেন্ড সেশনে থাকে কার মেয়ে কোথায় পড়ছে, কার ছেলে কোন কোম্পানীর জি.এম. হচ্ছে তার সবিস্তার বর্ণনা।
আমি আম্মুকে যে কতবার বুঝিয়েছি যে ফ্যন্টাসি ভাল কিন্তু ফ্যান্টাসি ওয়াল্ডে নিজের একটি চরিত্র এঁকে ‘দুনিয়া আমার হাতের মুঠোয়’ ভাবা মোটেও ঠিক না। আমার মা হয়তো সেটা কমই করে বা বলা যায় বাবা আর আমার কারণে তা পারে না। কিন্তু আজ বাড়ি ফেরার পথে কোচিং থেকে ভাইকে নিতে এসে এইসব কথা শুনে দশ মিনিটেই হাপিয়ে উঠেছি।
গেটের বাইরে এসে রিকশা খুজছি।
ভাইয়ের কোচিং ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে পনের টাকার ভাড়া বিশ টাকা চাওয়া সত্তেও উঠে পরি। দেখি আমাদের রিকশাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে অভিজাত ব্ল্যাক নিশান। ভেতরে বসা সেই আন্টি আর তার পাশে বসা অনিন্দ্য সুন্দরী একটা মেয়ে।
-তোর এই বান্ধবীর নাম কিরে? ভাইকে খোচা দিয়ে বলি আমি।
-অদ্রি
-হমম।
এই অদ্রির জন্যই হয়তো তার মা মনে মনে পাত্র খোজা শুরু করে দিয়েছে। পাত্র হতে হবে বিলেতী ডিগ্রীধারী, মাল্টি-ন্যাশনাল কোন কোম্পানীতে হায়ার পোস্ট হোল্ডার।
হায়রে! গাড়ি থাকা সত্তেও এক্সট্রা প্রোটেকশন দেবার জন্য মা চলে এসেছে মেয়ের কোচিংয়ে। এই মেয়ে যদি ৯৯% ভাল কোন ছেলের বউ হয় তবে ১% খারাপ হবার ঢেউয়ের তোড়ে এই মা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন কিনা আল্লাহই জানে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা বেজে যায়।
আম্মু দু’দিনের জন্য গেছে খালার বাসায়। আব্বুও ঢাকার বাইরে। বুয়ার তৈরী করে রেখে যাওয়া আধপোড়া ডিমের স্যান্ডউইচ আর টি-ফ্লাক্সে থাকা ঠান্ডা হয়ে আসা চা দিয়ে দু’ভাই মিলে বিকেলের নাস্তা সারি রাত সাড়ে আটটায়। এরপর আমি চলে আসি ছাদে। শেষ শীতের ঠান্ডা বাতাস হালকা কাপুনী দিয়ে গেলেও বিশাল আকাশের নীচে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্তের অনুভূতি আমার খারাপ লাগে না।
বেকার লাইফের এই তো মজা।
আমি স্টাডি লাইফের এমন একটা স্টেজ পার করছি যেখানে আমি বেকারও না আবার আমাকে ছাত্রও বলা চলে না। ফাইনাল টার্ম পরীক্ষা শেষে রেজাল্টের অশায় বসে থাকা সব ছাত্রই বুঝি এই ডিলেমার মধ্যে থাকে। আমি খুবই এনজয় করছি। ঘুরি-ফিরি-খাই টাইপ অবস্থা।
কিন্তু এই ভাল লাগা, ডায়েরী লেখা, ব্লগ পড়া, আর আড্ডাবাজী করে বেড়াতে ক’দিন যে ভাল লাগবে তা আমি জানি না।
আমার বন্ধুদের মাঝে অনেকেই জি.আর.ই করছে। কেউবা দেশেই মাস্টার্সের প্রিপারেশন নিচ্ছে। কেউবা ওয়েট করছে বড় কোন কোম্পানীর জব সার্কুলেশনের জন্য। আমিও যে ট্রাই করছি না তা নয়।
কিন্তু বাংলাদেশে জন্মে আমেরিকার বিলাসি জীবনে খাপ খাওয়ানোর সপ্ন আমার নেই। সবাই যখন সিভি’তে প্রেফারেবল জব লোকেশন হিসেবে সিলেক্ট করে ঢাকা তখন আমি দেই অ্যানিহোয়ার ইন বাংলাদেশ। ছোট-বড় কোন একটা কোম্পানীতে সম্মানজনক একটা পদ পেলেই আমি খুশি যেখানে আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারব। যেখানে বসে আমার দেশের ঘুণে ধরা পাওয়ার সিস্টেমের জঞ্জাল পরিস্কারের সময় দু-একটা ঘুণ পোকা মারতে পারব।
গত পরশু আমার এই ইচ্ছার কথা শুনে এক বন্ধু বলল-‘দোস্তো, তোর রেজাল্ট তো খারাপ না।
তুই ইচ্ছা করলেই বাইরের ভাল একটা ভার্সিটিতে স্কলারশীপের ব্যবস্থা করতে পারিস। কি করবি এই দেশে থেকে? এইসব জব করে হয়তো অনেক টাকা হবে। কিন্তু সৎ কি থাকতে পারবি?’
ওর এই কথাগুলো শুনে আমার প্ল্যানিংটা আবার রিক্যাল্কুলেশন করার চেষ্টা করি। হয়তোবা বাইরে থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসে ও হবে টীচার বা কাজ করবে কর্পোরেট ম্যানেজার হিসেবে। কিন্তু টিচার হওয়াই কি সৎভাবে বাঁচার গ্যারান্টী? বেসরকারী চাকরীই কি ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেয়?
যদি তাই হয় তবে যমুনা ব্রীজে ফাটল ধরে কিভাবে? আর কন্সট্রাকশন ফল্টের কারণে ফাটল যদি ধরে গিয়েই থাকে তবে কোন লিগ্যাল ফল্টের কারণে আমারা বিদেশী কোম্পানীটির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারছি না তা আমার জানা নেই।
এই সেতুটি আমাদের দেশের জন্য একটা ইউনিক স্ট্রাকচার। এটি তৈরীর সময় দেশ সেরা প্রকৌশলীরা জড়িত ছিলেন, ছিলেন বুয়েট শিক্ষক। লিগ্যাল এগ্রিমেন্টের ব্যাপারে জড়িত ছিলেন বাঘা বাঘা সব আইনঞ্জ। আর এদের সম্মিলিত চেষ্টার ফসল সাধারণ জনগণের হাজার কোটি টাকায় করা এই সেতু যার ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত।
কাজেই টীচার হলেই যে আমার কাছে ঘুষের অফার আসবে না আর বেসরকারী কোন কোম্পানীতে চাকরী করলেই যে ওয়ার্ক অর্ডার পেতে টাকা ভর্তি ব্রিফকেস নিয়ে আমি কোন মন্ত্রীর বাসায় যাব না তা কেউ বলতে পারে না।
দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা আসতে হবে নিজের মন থেকে। ঘুষের অর্থ চরম অশুচি একটা জিনিস। এর মাধ্যমে আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাই। স্ট্যাটাসের সিড়ি ভেঙ্গে তরতর করে উঠে যাই উপরে। চারিদিক থেকে পাই বাহবা।
কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি, দুর্নীতির টাকায় বাহ্যিক চাকচিক্য আনতে যেয়ে বিকিয়ে দিচ্ছি আপন আত্তার আলো। হায়ার স্ট্যাটাসের আশায় যতটা উপরে উঠছি বিবেকের কাঠগড়ায় আমরা ঠিক ততটাই নিচে নেমে যাচ্ছি।
আমার আত্তীয়-সজন, পাড়া-প্রতিবেশী’র মধ্যে অনেকেই ঘুষের টাকায় বড়লোক। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে তাদের বিত্ত বৈভবের প্রদর্শনী দেখে মাঝে মাঝে আমার পরিবারের দৈন্য দশার প্রতি হাহাকার জাগে। কিন্তু তাদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে এমনই অসুখী যা হাজার কোটি টাকাতেও কেনা সম্ভব না।
আমরা ক’দিনই বা আর বাঁচব। বড়জোর ৫০ বা ৬০ বছর খুব বেশী হলে ৭০। এই হিসেবে আমার মত যাদের ছাত্রত্ত প্রায় শেষের পথে তাদের হাতে সময় আছে আর ২৫, ৩৫ বড়জোর ৪৫ বছর। আমরা কি পারি না একটা অর্থপূর্ণ জীবন ধারণ করতে বাকি সময়টুকুতে পেশাগত জীবনে সত থাকতে? আমরা কি পারি না ঐশর্যের মায়ায় বন্দী না থেকে সত্যিকারের সুখের পেছন ছুটতে?
হয়তোবা হ্যাঁ, হয়তোবা না।
কিন্তু আমাকে পারতেই হবে।
নিজের পার্থিব বিলাসিতা কিনতে গিয়ে অসহায় মানুষের গলায় ছুরি আমি কখনোই ঠেকাতে পারব না। এই জীবনের সুখের হিসেব মেলাতে যেয়ে বিধাতার হিসেবের খাতায় গরমিল সৃষ্টি করতে আমি পারব না।
ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বাড়ে। কনকনে ঠান্ডা যেন মাংস চিরে হাড়ে গিয়ে আঁচড় কাটে। আজকে আম্মু বাসায় থাকলে আমার খবর ছিল।
এত রাত পর্যন্ত ছাদে থাকায় চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলত। আমি আম্মুর কথা ভেবে নেমে আসি ছাদ থেকে।
(সম্পূর্ণ কাল্পনিক ঘটনার আড়ালে চরিত্র গুলোর ভীড়ে নিজের ছায়া দেখতে পেয়ে কেউ মনে কষ্ট পেলে সেটার জন্য আমি দায়ী নই)
১০/২/১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।