তিরিশ বছর পরও বাংলাদেশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়নি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার পর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কারবারে বাংলার ব্যবহার চালু হয়নি। এর জন্য মূলত দায়ী কারা ছিল আমরা জানি। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাধ্য হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী বাংলা চালুর ব্যাপারে একেবারেই উত্সাহিত ছিল না। না থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে সে সময় এ অঞ্চলের বাঙালিদের মধ্যে বাংলা চর্চার একটা চেষ্টা ছিল।
সে চেষ্টা সম্পর্কিত ছিল বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনের সঙ্গে। আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর ব্যাপার এই, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রধানত বাঙালিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলা চর্চা যেভাবে এখানে হওয়ার কথা ছিল তার কিছুই এখন হচ্ছে না। স্বাধীনতার তিরিশ বছর পরও না। পাকিস্তান আমলে এ দেশের অধিবাসীদের শত্রুদের শাসনে বাংলা প্রচলন সম্ভব হয়নি। স্বাধীন বাংলার শাসকশ্রেণীর অধীনেও তা হয়নি।
উপরন্তু পরিস্থিতি এদিক দিয়ে অনেকাংশে আরও খারাপ হয়েছে। তাহলে যে শাসকশ্রেণীর অধীনে বাংলা ভাষার প্রচলন বাংলাদেশে তিরিশ বছরেও হয়নি, তারা কারা? পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী জনগণের শত্রু, বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধী হওয়ার কারণে যে কাজ হয়নি, সেই কাজ যে স্বাধীন বাংলাদেশেও হচ্ছে না এ বিষয়টি লঘুভাবে দেখার অবকাশ নেই। কারণ মাতৃভাষার ব্যবহার দেশপ্রেম, ভাষা প্রেম এবং জনগণের অনেক রকম স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাজেই যাদের আমলে বা যাদের সামনে রাষ্ট্রীয় কারবারে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে না, তাদের বাংলা ভাষা প্রেমিক, দেশপ্রেমিক ও জনস্বার্থের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা যাবে কীভাবে? এর কারণ ব্যাখ্যার দায়িত্ব শাসকশ্রেণীর লোকদের, তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের, তাদের একের পর এক সরকারের, সর্বোপরি তাদের বুদ্ধিজীবীদের।
কিন্তু দায়িত্ব তাদের হলেও তারা এ দায়িত্ব পালন করে না।
বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় কারবারে প্রচলনের দায়িত্ব যে কারণে তারা পালন করে না, ঠিক সে কারণেই এর ব্যাখ্যা জনগণের সামনে উপস্থিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে কে চায়? তবে তারা নিজেদেরকে নিজেরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না চাইলেও জনগণ তাদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
বাংলাদেশে অফিস-আদালতের কাজে বাংলার ব্যবহার হয় না। অথবা ক্ষেত্রবিশেষে হলেও সামান্য। কাজেই বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে থাকলেও কার্য ক্ষেত্রে তার কোনো প্রয়োগ নেই।
এদিক দিয়ে অবশ্য বাংলা ভাষা কোনো ব্যতিক্রম নয়। সংবিধানে এমন বহু জিনিস আছে, যার কোনো কার্যকারিতা ঘোষণার বাইরে নেই। একে প্রতারণা ছাড়া কিছু বলা যায় না। বর্তমানে সংবিধান নিয়ে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়া নিয়ে যেসব কথা ও চেষ্টা হচ্ছে তার মূল কারণ সংবিধানটি প্রণীত হওয়ার পর থেকে এর অনেক কিছুকেই শিকেয় তুলে সেগুলোকে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাত্ সংবিধানের অনেক কিছুরই কার্যকারিতা বলতে কিছু থাকেনি। নিজেদের প্রণীত সংবিধান পদদলিত করেই স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী এ দেশ শাসন করে এসেছে।
এ কথায় আবার ফেরার আগে উল্লেখ করা দরকার, রাষ্ট্রীয় কারবারে বাংলার ব্যবহার না হলেও এর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন অংশে মাঝে মাঝে কথা শোনা যায়।
এরপরও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। হাইকোর্টে বিচারকদের রায় বাংলায় লেখার কথা এবার আদালত মহল থেকেই কেউ কেউ বলেছেন। অফিসেও যে ফাইলের কাজ বাংলায় হওয়া দরকার এটুকুও শোনা যাচ্ছে। স্বাধীনতার তিরিশ বছর পর যে এ ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে বা শুনতে হচ্ছে—এটা জাতীয় কেলেঙ্কারি ছাড়া আর কি? বাংলাদেশে এমন অনেক কাজ-কারবার আছে, যার দিকে তাকিয়ে মনে হয় মাতৃভাষা, স্বদেশ প্রেম ইত্যাদি নিয়ে বাঙালিদের উচ্ছ্বাস ও কথাবার্তা ন্যাকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আবার এই ন্যাকামি হলো প্রতারণারই এক কৌশল। এ কৌশল রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কর্মকর্তা থেকে নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন।
একে যদি স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর অভ্যাস ও আচরণ বলে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে এর কারণ অবশ্যই সন্ধান করতে হবে এদের শ্রেণী চরিত্রের মধ্যে—এই শাসকশ্রেণী গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে। দেখা যাবে যে, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী লুটতরাজ, চুরি, ঘুষখোরি, কমিশনখোরি, প্রতারণাসহ হরেকরকম দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। এভাবে গঠিত একটি শ্রেণীর চরিত্র যে কেমন হবে, জনগণের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ধরনের হবে—এটা বোঝা কঠিন ব্যাপার নয়।
বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী নিজের কাজ-কারবারের মাধ্যমেই নিজের চরিত্র জনগণের সামনে উন্মোচন করেছে। এর ফলে এদেরকে নিজেদের বন্ধু বলে বিবেচনার কারণ এ দেশের জনগণের নেই। এদিক থেকে বিষয়টি দেখলে পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা মিল ও সাদৃশ্য সহজেই দেখা যাবে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি আমলের মতো বাংলাদেশ আমলেও বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেন আজ পর্যন্ত প্রচলিত হয়নি তার কারণও এই মিল ও সাদৃশ্যের মধ্যেই পাওয়া যাবে।
ফেব্রুয়ারি মাস এলে বুদ্ধিজীবী মহলে অনেক আবেগপূর্ণ কথা শোনা যায়।
স্মৃতিচারণের নামে তাঁদের অনেকের মধ্যে নিজেদের ‘ভাষাসৈনিক’ হিসেবে প্রচার করার কুিসত চেষ্টা দেখা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষা প্রচলন ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো নিয়ে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো বিশ্লেষণ ও কথাবার্তা শোনা যায় না, শোনা গেলেও সেটা এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। বাংলা ভাষা উচিতমতভাবে প্রচলিত হচ্ছে না, এ নিয়ে অনেকে বিলাপ করলেও এ অবস্থা কীভাবে ও কেন তৈরি হয়েছে এ নিয়ে তাঁদের কোনো বক্তব্য শোনা যায় না। এ নিয়ে কেউ কেউ হায় হায় করে থাকেন। কিন্তু হায় হায়-এর মধ্যে হাহাকার থাকলেও কোনো প্রতিজ্ঞা থাকে না।
ফেব্রুয়ারি মাসে বুদ্ধিজীবীদের উচ্ছ্বাসপূর্ণ কথাবার্তার মধ্যে ন্যাকামির দিক প্রবল হলেও তার মধ্যে প্রতিজ্ঞার এ অভাব এক বিপজ্জনক ব্যাপার।
বাংলা ভাষায় লিখিত বইরের সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাওয়া দেখে কেউ যদি মনে করেন এর মধ্যে বাংলা ভাষার ও বাঙালি সংস্কৃতির সমৃদ্ধির পরিচয় আছে, তাহলে ভুল হবে। বাংলা একাডেমীর মেলায় বাংলা ভাষা চর্চার যে নিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে বাংলা ভাষার উত্কর্ষতার পরিচয়ের থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দারিদ্র্যের দিকটিই চোখে পড়ে বেশি। যে হাজার হাজার বই ফেব্রুয়ারির মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয়ে আসে, তার মধ্যে শতকরা ৯০টি বই-ই পাঠযোগ্য নয়। ছাপার অক্ষরে সেগুলো এক ধরনের আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রকৃতপক্ষে বাংলা বানান ও বাংলা ভাষার অনেক রকম বিকৃতি আজ সরকারি ও বেসরকারিভাবে ঘটানো হচ্ছে। বানানের অবস্থা এমন জায়গায় এনে দাঁড় করানো হয়েছে, যাতে যার যা ইচ্ছে লেখার সুযোগ আছে এবং বানান ভুল বলে কিছু নেই। সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের এক উপায় হিসেবে যে দেশে বই লেখা হয় সেখানে ভাষা ও সাহিত্যচর্চার যে বিশ্রি বাণিজ্যিকীকরণ ঘটবে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে?
ব দ রু দ্দী ন উ ম র রচিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।