পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি
" শিক্ষিত মেয়েকে নিয়ে এমন বিপদে পড়বো জানলে ইন্টারের পরেই বিয়ে দিয়ে দিতাম" - আন্টির আক্ষেপ শুনে বুকে কাঁপন লাগলো । অনেক দিন পরে এসেছেন বেড়াতে । টুকিটাকি গল্প হচ্ছে , হচ্ছে সংসারের নানান আলাপ । কিন্তু আন্টি অন্যমনস্ক । ঈদের বাজার, নতুন সরকার , গরম কি ঠান্ডা , পুলিশের ডান্ডা - কিছুতেই তাঁর মন নেই ।
একটু এটা সেটা আলাপের পরেই মামণীকে আসল কথা পাড়লেন । "ভাবী, আপনার কাছে শুনি অনেক বায়োডাটা আছে , একটু যদি চেষ্টা করতেন !" মামণীও দেখলাম কোমর বেঁধে লেগে গেলো । যদিও মাও জানে আর আমিও জানি - এই প্রজেক্টের সফলতার ভাগ শূন্যেরও নিচে । আমার মামণী প্রচন্ড সৎ একটা মানুষ । এর পাশাপাশি খুব সরল সোজাও ।
ঘটকালির কাজে এই দুইটা হইলো নিষিদ্ধ এবং দন্ডনীয় অপরাধ । তার উপর নিজস্ব চিন্তাভাবনা , মানবিকতা , নৈতিকতা , ভারসাম্য, বৈষ্ম্যবিরোধীতা , মেয়েদের সম্মান রক্ষা ইত্যাদি নিয়ে এত মাথা ঘামায় বলেই যে জীবনে একটাও বিয়ে দিতে পারবে না , এইটা নিয়ে আমরা ও আব্বু অনেক হাসাহাসি করি । যদিও , সেই আপাত কৌতুকের পিছনে লুকানো থাকে সযতনে, ক্ষোভ আর বিবমিষা , কিছুটা বেদনাও ।
বিয়ের পাত্র পাত্রী দেখা , ঘটকালি করার সময় প্রত্যেক পরিবারের আসল চরিত্রটা বেরিয়ে আসে । সামাজিক আড্ডায় , অন্যের ছেলে মেয়ের ব্যাপারে, প্রেমিক প্রেমিকাদের ফুর্তি ফার্তায় , কিংবা লেখালেখির জগতে মানবিকতা , সাম্য, মুসলমানিত্ব , ধর্মীয় "মহানুভবতা" সব উপচে উপচে পড়ে ।
সেই তৈলাক্ত মাহাত্ম্য চাইনিজের প্লেট, চায়ের কাপ থেকে চুয়ে চুয়ে জামা কাপড়, ঘর বাড়ি, রাস্তা ঘাট পেরিয়ে পুরো পৃথিবীটাই চুপচুপে, তেলতেলে করে দেয়। কিন্তু যেই নিজের বিয়ের কথা ওঠে , তখন দেখা যায় কোন পরিবার কত্ত বড় কুতুব। চাহিদার লিস্টি দেখে বিশ্বাস করুন, পাঠক, এক দিকে হাসতে হাসতে মরবেন নয়ত ভিরমি খেয়ে জ্ঞান হারাবেন। কি এক এক জনের হাউস রে ভাই! ছেলের উচ্চতা ৫ ফিট ২ ইঞ্চি । ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবা মা চান, মেয়ে হবে অন্তত সাড়ে পাঁচ ফিট লম্বা, উচ্চিশিক্ষিত কিন্তু ঘরোয়া ( সোজা কথা চাকুরী করবে না) এবং সুন্দরী , ভালো ফ্যামিলি ইত্যাদি ইত্যাদি ।
তো আন্টিকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়েছিলো, এমন সর্বগুণে গুণান্বিতা মেয়েটি বেছে বেছে আপনার বাটকু , চলনসই ছেলেটাকেই কেন পছন্দ করবে বলতে পারেন? সেই রকম মেয়ের ফ্যামিলিও তো সেই রকম ছেলেই চাইবে ! আদব কায়দার সমস্যায় সে প্রশ্ন করা হয়নি । পরে দুইটা বছর ধরে বহুত ঘুরাঘুরির পরে শেষে বিয়ে করলো ৫ ফিট ছুঁই ছুঁই এক মিষ্টি মেয়েকে । মামণি , কপাল চাপড়ে একটু দুঃখ করলেন, " সেই তো ছাড় দিলেন সবই কিন্তু আমি যখন বলেছিলাম , তখন তেড়ে এসেছিলেন কেন? " আব্বু আর আমরা আরেক বার হাসলাম ।
এই সমস্যা প্রতিষ্ঠিত ছেলের পরিবারে প্রকট , অতিরিক্ত মাত্রায় , এইটা সর্বজন বিদিত । কিন্তু , মেয়েদের ফ্যামিলিতে এই হ্যাপা নেই? ভীষন ভাবে আছে ।
আজকে এই রকম কিছু সত্যি গল্প । ব্যক্তিগত পরিচয় ও তথ্য বদলে দেওয়া হয়েছে সঙ্গত কারনেই ।
১। রিমার সাথে পরিচয় বান্ধবীর বিয়েতে । উনি সম্পর্কে আত্মীয়।
অনেক গুলো ভাইবোন । বৃদ্ধা মায়ের সার্বক্ষণীক যত্ন নেওয়া , বাসা বাড়ি দেখে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ছোট বেলায়। বিনা বেতনে একজন নার্স কাম বুয়া পেয়ে বাকিরা যে যার মত পড়ালেখা , চাকুরী নিয়ে বেরিয়ে গেছেন পরিবার থেকে । মায়ের সেবা করতে করতে রিমাপু বাড়ির কাছেই একটা সাধারন বিষয় নিয়ে ডিগ্রী পড়েছেন। মা বেঁচে থাকতে থাকতে তাঁর বিয়ের জন্য সবাই উঠে পড়ে লেগেছিলো , এইটা বলা যাবে না ।
আমাদের এই সব স্বার্থপরতা , " যেমন চলছে চলুক না" , কিংবা " রিমা তো আছেই, ঐ দেখবে" ধরনের প্যাঁচে পড়ে বয়স পেরিয়ে গেলো । রিমাপুর পছন্দের মানুষটিকে "যোগ্যতা নেই" এর পলিটিক্সে বিদেয় করা হলো । তারপর গড়্গড়িয়ে সময় পেরিয়ে যখন ছোট ভাই বোনেরা বিয়ে করে ফেলতে শুরু করলো তখন একটু আধটু চেষ্টা হলো বটে কিন্তু তখনো , " ছেলে হেন হতে হবে, তেন হতে হবে"র উন্নাসিকতা কাটেনি। অনিন্দ্যসুন্দরী , ঘরকন্নায় নিপুনা রিমাপু একটু একটু করে মুষড়ে পড়লেন। অভিমানে নিরবেই ক্ষয়ে যেতে থাকলেন ।
তারপর একে একে প্রস্তাব কমে গেলো, চেহারায় বয়স ও বিষন্নতার ছাপ পড়ে গেলো আর নানা রকম রোগে আক্রান্ত রিমাপুর জন্য বাড়ির ভাড়া তুলে খাওয়া পরার ব্যবস্থা করতে তার সফল ভাই বোনেরা একটা বাড়ি তৈরী করা শুরু করলেন । গরু মারা শেষ , এবার চাই হাল ফ্যাশনের চকচকে জুতো দান ।
২। মলির পরিবার তেমন ধনী নয় কিন্তু পড়ালেখায় প্রচন্ড তুখোড়। বড় ভাই বোনের প্রেমের বিয়েতে পরিবারের অমত থাকায় মলির জীবনটা পড়ালেখার ভিতরেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো।
কলেজ বাসা, বাসা কলেজ- এই রকমই চলেছে । উঠতে-বসতে, আসতে -যেতে মায়ের আহাজারি," মারে, তুই কিন্তু প্রেম ট্রেম করিস না। " মলি ভীষন ভালো আর চাপা স্বভাবের মেয়ে। বাবা মাকে মানসিক শান্তি দিতে প্রেমের ধার কাছ দিয়েও গেলো না। পড়ালেখা শেষ করে চাকুরী জীবন এবং এক সময় স্কলারশীপ নিয়ে বাইরে উচ্চশিক্ষা ।
সবকিছুই ঠিক ঠাক মত চললো , কেবল নিজের পরিবার প্রতিষ্ঠায় মেয়েটা পিছিয়ে গেলো। গায়ের রঙ সামান্য কালো হলেও চিকন চাকন দেহবল্লরী , হাসলে গাল ভেঙে দুটো মিষ্টি টোল পড়ে । তবু, বয়স আর গায়ের রঙের কারনে বিয়ের বাজারে কঠিন থেকে কঠিন হয়ে গেলো মলির পাত্রস্থ হওয়া। তার সাথে এখন যোগ হয়েছে বিদেশে বসবাস । দেশের ছেলে বিদেশ যাওয়া সমস্যা, বিদেশের ছেলে নিজের ইউনি বা কাজের জায়গা ছেড়ে মলির ইউনিতে আসবে না আর মলিও পারবে না সব ছেড়ে ছুড়ে অন্য কোথাও যেতে ।
ইউনি শেষ হতে হতে বয়স গিয়ে ঠেকবে ৩৫ এর ঘরে ।
৩। রুবিনার বাবা মা বাংলাদেশের ডাকসাইটে ডাক্তার পরিবার । টাকায় ভেসে যাওয়া পরিবারের শখ হলো রুবিনাকে পাশ্চাত্যের ডাক্তারী পড়ানো চাই। সেখানে ডাক্তারী ১০ বছরের ।
শেষ হতে হতে মেয়ে তিরিশ এ পা দিতে চলেছে । আর বাবা মা তাঁদের নিজেদের সমান সমান পরিবার খুঁজে মরছেন। ডাক্তার হতে হবে। সেই রকম ধনী হতে হবে। ঢাকায় বাড়ি গাড়ি থাকতে হবে।
এফ সি পি এস থাকতে হবে। কিন্তু বয়স হবে তিরিশ বত্রিশ। এই রুপকথার রাজপুত্র বাংলাদেশে কি ভাবে পাওয়া সম্ভব আমি কিছুতেই বুঝিনি। শেষবার রুবিনা দেশে এলে দেখলাম পড়ার চাপে বেচারীর চুল পড়ে টাক হয়ে যাচ্ছে । আর আঙ্কেল আন্টি তখনো দেশে বিদেশে পাত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন ।
আমি জানি, আশে পাশে এই রকম অনেক কাহিনী আপনারা নিজেরাও জানেন। মেয়ে উচ্চশিক্ষিত , বয়স বেড়ে চলেছে কিন্তু বিয়ের যোগ্য পাত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । শিক্ষিত ছেলের অভাব? নাহ। অভাব সুচিন্তার মানুষের । বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিকালি তরুণ দেশ ।
মানে এইখানে অল্পবয়সী মেয়েদের ছড়াছড়ি । আর ছেলেদের বয়স কেউ দেখে না তেমন। ছেলের যোগ্যতা নিরুপিত হয় টাকা, প্রতিষ্ঠা, চাকুরী, শিক্ষা , তারপর চেহারা, তারপর বয়স । এই সর্বপ্রকার সুবিধা প্রাপ্ত পুরুষশাসিত সমাজে ৪০ বছরের বুড়ো ভাম হলেও ১৮ বছরের পরী পাওয়া কোন ব্যাপারই না। বৃদ্ধ বান্দরের গলায় কচি মুক্তো ঝুলিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বহু অভাবী পরিবার এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে ।
সেইটাই সমস্যা । একদিকে অভাব, অন্যদিকে সুন্দরী মেয়েকে নিরাপদ রাখার ঝামেলা । তাই সাত তাড়াতাড়ি বিদেয় করে জামাইয়ের গলায় ঝুলিয়ে দাও ।
আর ছেলে? কি আর বলবো ! বিয়ের বাজার নয় এটা । মাংসের বাজার ।
কচি পাঁঠা বলিদানের সবচে উপযুক্ত , নয় কি? প্রতিদিন হাজার হাজার ফ্রেশ মাংশ আসে বাজারে । দু'তিন দিনের পুরানো মাংশ কিনবে কেন ? মাথায় টুপি চাপিয়ে যে ব্যাটা পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে নামায পড়ে , সেও বিয়ের সময় ১৬/১৮ খুঁজে । বড়জোর অনার্স ফাইনাল ইয়ার। তেইশ পেরোলেই গায়ে এক্সপায়ারী ডেট। অথচ চেপে ধরে যদি প্রশ্ন করি , " আমাদের নবী তো ১৫ বছরের বড়, একবার বিয়ে হওয়া , ৪০ বছরের বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন।
তাহলে মেয়ের বয়স বেশি ধুয়া তুলেন কেন? " আর কোন উত্তর নেই । নিজের বিয়ের বেলায় বড় তো অনেক পরের কথা , সমবয়সী পর্যন্ত কেউ বিয়ে করতে রাজি নয় । (প্রেমের বিয়ের কথা বলছি না , এরেঞ্জ ম্যারেজ) তাহলে , এত নামায , কালাম, রোযা নিয়ে প্যান প্যান করার কি দরকার ?
তুখোড় এই মেয়েগুলোকে দেখে প্রচন্ড কষ্ট লাগে । সবার কি আর সময় আছে নিজের সঙ্গী নিজেই খুঁজে নেওয়ার? না বাংলাদেশে সেই পরিবেশ আছে ? আমরা আমেরিকা যা করে তার সবই করি , খারাপ অর্থে , কিন্তু বড় হয়ে ওঠা শিক্ষিত ছেলে বা মেয়েটি দু'চার দিন কারো সাথে কথা বলুক, মিশুক , নিজের জীবন সঙ্গী খুঁজে নিক, এটা আমরা কেউই চাই না । আমরাই বদনাম করে ভাসিয়ে দেই ।
পাশাপাশি যারা নিজেরা মুক্তমনা , তারাও সামাজিক চাপে পড়ে অনেক কিছুই করতে পারেন না । কারন , আমরা রোযা রমজানে মাথায় কাপড় দেওয়া নিয়ে সমালোচনা করি । নামায , রোযা না করলে পিটিয়ে ছাতু করতে চাই। চারটি বিয়ে জায়েজ বলে প্রচন্ড ইসলামী হয়ে উঠি। আমরা ভীষন ধর্মপ্রান বলে গর্ব করি , করতে পছন্দ করি।
কিন্তু মোহাম্মদ (সাঃ) এর দেখাদেখি খাদিজাকে বিয়ে করতে চাই না , সবাই খালি আয়েশা খুঁজি ।
বিশ্বাস করুন, পাঠক, আজকের খাদিজাকে বিয়ে করলে এই আমরাই আপনার প্রাণ অতিষ্ঠ করে দেব বদনাম করে , এক ঘরে করে দেব সমাজে আর না মরা পর্যন্ত আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেব মানসিক অত্যাচার করে। আপনি টিকতে পারবেন না বাংলাদেশে । যতই মুসল্মান হোন, আপনার কপালে শনি আর মুখে ঝাটা ।
[ যদি কোন তিরিশ ছুই ছুই বা তার বন্ধু এই লেখা পড়েন , তাহলে ক্ষমা চাইছি কোন ইতিবাচক কথা না লেখার জন্য।
বাংলাদেশের বাসিন্দা হলে বাপ, মা, আত্মীয় স্বজন শুদ্ধ নিজে উদ্যোগী হোন। লজ্জা পাবেন না । দ্বিধা করবেন না । এবং মরে গেলেও খারাপের সাথে আপোস করবেন না । ভুল মানুষকে বিয়ে করার চেয়ে ভুল সময়ে বিয়ে করা অনেক ভালো।
নিজের মেরুদন্ড আর পায়ের তলার মাটিটা ভীষন শক্ত করে নিন, তারপর নিজে বাছুন। খোলামেলা সব আলোচনা করে নিয়ে দ্বৈত জীবন শুরু করুন। বয়স যদি বেড়েই গিয়ে থাকে , ঘটক খুজবেন না । নিজের মেধা , রুচি, শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে মনের সাথে মানান সই কাউকে খুঁজে বের করুন। আর সবচেয়ে বড় কথা , নিজেকে ভালোবাসুন, নিজেকে নিয়ে সুখী হোন।
সুখী হওয়ার জন্য অন্য কারো উপর নির্ভর করবেন না । বিয়ে ও সংসারে এই মনভাব নিয়ে প্রবেশ করুন। কাজটা কঠিন, অসম্ভব না ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।