ভিজুয়াল মিডিয়ায় অভিনেতা, অভিনেত্রী সংকট!! পড়ে হয়ত অনেকে অবাক হচ্ছেন কারন টিভি খুললেই এক ঘন্টা,ধারাবাহিক, মেগা ধারাবাহিক নাটকের অভাব নেই। অভিনয় শিল্পির ও ছড়াছড়ি!! তবে হ্যা সু-অভিনয় শিল্পির বড়ই অভাব আমাদের বর্তমান নাটকে। এই সব তথাকথিত শিল্পিদের অভিনয় জ্ঞান, প্রপস, বডি ল্যাংগুয়েজ এতটাই আনকোরা যা আমাদের ভিনদেশী চ্যানেল দেখতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। নাটকে দু' একজন পুরাতন অভিনেতা,অভিনেত্রী আর বাকিরা সব নতুন। দেখা যাচ্ছে ঐ দু একজনের জন্যই নাটক চলে যাচ্ছে।
কিন্তু দর্শক বিরক্ত হচ্ছে। আর দু একজন যারা অভিনয় করছে নাটকটিতে তাদের অভিনয় যোগ্যতা ঈর্শ্বনিয় কারন একটাই তারা অভিনয় শিখে এসছে। তাদের প্রায় সবারই রয়েছে মঞ্চে কাজ করার অভিজ্ঞতা । আলি যাকের থেকে শুরু করে হালের চঞ্চল বা মিলনরা মঞ্চ কাপিয়েছেন এবং এখনো কাপাচ্ছেন। অনেকে মিডিয়া ব্যবসা বা নাটকের শিডিউল মেইনটেইন করতে গিয়ে মঞ্চে সময় দিতে পারেন না।
এর বিপরীতেও দেখা গেছে অনেকে মঞ্চকে ভালোবেসে মিডিয়ায় (নাটক বা বিজ্ঞাপনে) সময় দেন না। আমি মঞ্চ নাটকে এমন অভিনেতা,অভিনেত্রীও দেখেছি যারা আমাদের ভিজুয়াল মিডিয়ায় সময় দিলে আমাদের নাটক, বিজ্ঞাপন এর ব্যপক উন্নতি হতো। দর্শক ও মুখ ফিরিয়ে নিত না। আমারা সাধারনত দেখি প্রোডাক্ট এর বিজ্ঞাপনের জন্য সু-শ্রী মডেল নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে সেই মডেলই টিভি নাটকের অভিনেতা বা অভিনেত্রী হয়ে যায় এবং অভিনয় যা হওয়ার তাই হয়। অনেক মডেল আবার সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেন অমুক আংকেল আমাকে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে অফার করে বসল উনি আবার বড় মাপের নির্মাতা কিনা না করতে পারলম না! নিজের অনিচ্ছাই.... তাহলে বুঝুন।
অবশ্য দু' একজন মডেল ভালো অভিনেতা বা অভিনেত্রী হতে পারে নি তা কিন্তু বলতে চাচ্ছিনা, দু'একজন হয়েছেন তবে সেই গাইতে গাইতে গায়েন প্রবাদের মত। তাও নির্দিষ্ট কিছু চরিত্রের বাহিরে অভিনয় করতে গেলেই বিপত্তি। এই তো গেলো অভিনেতা অভিনেত্রীদের কথা এখন আসি মঞ্চ প্রসংগে। ছোটবেলা থেকেই স্কুল নাটকে অভিনয় করতাম সপ্ন ছিলো বড় অভিনেতা হবো। অপেক্ষা করতাম কবে ঢাকা আসবো আর মিডিয়ায় অভিনেতা হওয়ার সপ্ন পূরণ হবে।
ঢাকায় আসলাম ১৯৯৯ এর শেষ দিকে এসেই লোকনাট্যদল ( সিদ্ধেশ্বরী) তে নতুন ছেলে মেয়ে নিবে সার্কুলার পেলাম। ইন্টারভিউতে টিকে গেলাম, শুরু হলো সপ্ন দেখা। সন্ধ্যার পরে কার্জন হলে রির্হাসেল। বন্দুকের গুলি মিস আছে আমার রির্হাসেলে মিস নাই। টুক টাক কটু কথাও সিনিয়র ভাইয়েরা শুনিয়েছে,দমে যাইনি।
হল রুম ঝাড়ু দেয়া, চা, সিংগারা আনা কত কাজ খুব আনন্দে আনন্দে করতাম। কাজ না দিলে মনে হত সিনিয়রদের নজরে নেই। আমাদের ব্যাচে মডেল অলি ভর্তি হয়েছে, সব নতুনদের নজর ওর দিকে। কয়েকদিনে ওর সাথেও খাতির হয়ে গেল। ওর তখন লাইফবয় বদলে গেছে যানেন তো এই এ্যাডটা যেতো।
ওকে দেখে নিজের মডেল হওয়ার খায়েস জাগলো। আকাশ নামে আমাদের গ্রুপের আরেক মডেল বন্ধু বলল দোস্ত তুই একটা ফটোশেসন করে ছবি জমা দে, আমি শিউর তুই ডাক পাবি। যেই কথা সেই কাজ ছবি তুলে জমা দিতেই ইউনিট্রেন্ড থেকে ডাক এলো। বার্জার পেইন্ট এর বিজ্ঞাপন করলাম। প্রচার হতে থাকলো ততদিনে পেটের দায়ে পার্টটাইম জব করি একটা প্রাইভেট হসপিটালে।
এরপর নাটক, বিজ্ঞাপন, চাকুরী একসাথে করতে গিয়ে মঞ্চে নিয়মিত হতে পারলাম না। কঞ্জুস এর ৪০০তম শো শেষ করলাম। বনানীতে চলে গেল আমাদের রির্হাসেল অফিস। আমিও অতদূর গিয়ে রির্হাসেল করতে পারলাম না। মনটা খারাপ থাকতো, দলের সদস্যদের মিস করতাম।
চাকুরী করার কারনে মিডিয়া থিয়েটার থেকে দূরে ছিলাম। ৩ বছর বিরতী দিয়ে আবার শুরু করলাম, যোগ দিলাম থিয়েটার (আরামবাগে)। চাকুরী করার কারনে প্রায়ই লেট করতাম অতপর সিনিয়র ভাইদের কথার ফুলঝুড়ি। কাজ করলাম থিয়েটারের প্রোযজনা "বলদ"এ। আসলে চাকুরী করে থিয়েটার করা খুব টাফ।
মনে পড়ে কোন এক প্রশিক্ষন কর্মশলায় প্রশিক্ষক বলেছিলেন "থিয়েটার করা মানে নিজের খেয়ে বনের মেষ তারানো"। তারপরও আমি মনে করি যারা বনের মেষ ভালোভাবে তারিয়েছেন মিডিয়ায় তারা সু-উচ্চ অবস্থানে আছেন। জাহিদ হাসান বা সহিদুজ্জামান সেলিম প্রমুখরা কিন্তু মঞ্চে অনেক সময় দিয়েছেন এবং অনেক কষ্ট করেছেন। গ্রুপ এর পিকনিক, কোন সদস্যের জন্মদিন, টিকেট পুসিং সেল, সেল না হলে নিজের পকেট থেকে টাকা , চাদাঁ তুলে মুড়ি বানিয়ে খাওয়া আরো কত কি? পান থেকে চুন খসলে সিনিয়রদের কথা শুনিয়ে দেয়া। সহ্যের সিমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছিলো।
তিন বছর অনেক সময়!! আর নয় যাওয়া বন্ধ করলাম । বুকের ভিতরটায় কেন যেন মঞ্চ নাটকের ছায়া অনুভব করতে লাগলাম। নিজেরাই গঠন করলাম নতুন নাটকের গ্রুপ, বেশ কয়েকজন মিলে শুরু করলাম। যে যেমন পারলাম টাকা খরচ করতে লাগলাম। রির্হাসেল ব্রেকে সিংগারা,চা, পুরি, কেক,পিঠা।
নিজেই রির্হাসেল এর ফাকে নিয়ে আসি। নতুনদের দিয়ে কোন কাজ করাই না । ওরা যদি মন থেকে বলে ভাইয়া আপনি কেন? আমি নিয়ে আসি সে অপেক্ষায় আছি। আমরা যে ব্যবহার পেয়েছি সেটা এভয়ড করছি। ওদের মঞ্চ উপযোগী করে তোলার জন্য চেষ্টা করছি, বড় গ্রুপ গুলোতে দু'একজন বন্ধুরা কাজ করে ওদের দিয়ে ট্রেনআপ করাই মাঝে মাঝে।
তাছাড়া ভালো কয়েকজন ভিজুয়াল মিডিয়ার পরিচালক আমার পরিচিত আছেন তাদের রির্হাসেলে নিয়ে আসি এখান থেকে যদি ওনার নতুন মূখ কাজে আসে। গত ১৮ই জানুয়ারী বেইলি রোডে মহিলা সমিতি মিলনায়তনে আমাদের নাটকের শো হয়ে গেল। নাটক "ক্রস রোডে ক্রস ফায়ার" হল মোটামুটি পরিপূর্ণ ছিল। ১৮ জন অভিনেতা,অভিনেত্রী এ নাটকে অভিনয় করেছে। সবাই অনেক ভালো অভিনয় করেছে।
গ্রুপটির সভাপতি হিসেবে আমি তৃপ্ত। কিন্তু শো শেষে পকেট ফাকা, আমরা কমিটির কয়েকজনের টাকা আর স্পনসর কোম্পানীর দেয়া যতসামন্য টাকা সেট,লাইট, সাউন্ড আর মেয়ে আর্টিস্ট পেমেন্ট করতে গিয়ে শেষ। আলআমিনের চায়ের দোকানে ১০ টাকা বাকী। পায়ে হেটে বেইলীরোড থেকে বাসায় আসব ভাবছি এমন সময় এক বন্ধু বলল আমিতো মগ বাজার হয়ে বাসায় যাবো তোকে নামিয়ে দিয়ে যাব, আমি আর কোনদিকে না চেয়ে হিসেব কসতে কসতে বাসায় চলে গেলাম। মনে পরে গেল কেন আগের গ্রুপের ভাইয়ারা এমন চাঁদা তুলত, সত্যি আমাদের মঞ্চ নাটকে টাকা কড়ির বড়ই সংকট।
যতদূর জানি আমাদের দেশে দু'একটা দল আছে যারা মঞ্চ শিল্পীদের সন্মানী দেয়। বিদেশী শিল্পীদের কেউ এদেশে আনলে তখন স্পনসর দেয়ার কোম্পানীর অভাব থাকে না। শিল্পী গড়ার স্থান মঞ্চ এভাবে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চললে আমাদের টিভি নাটক ও অনুষ্ঠানে ভালো শিল্পী সংকট দেখো দিবে। অনুষ্ঠান দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে দর্শক, বেকার হয়ে পরবে এত গুলো চ্যানেলের বিভিন্ন শাখার কর্মর্কতা কর্মচারী। এখনই সময় মঞ্চ নাটক নিয়ে কিছু ভালো উদ্যেগ নেয়ার!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।