প্রিয় কিছু পঙ্কতি
সাহিত্যের রাজ্য বিচরণ সেই ছোটবেলা থেকেই। জন্মের পরের দীর্ঘ ঘুমন্ত অধ্যায়ের পর কিচ্ছা-কাহিনীর রাজ্য থেকেই শুরু। তারপরে অ-আ খেলা শিখে নিজে নিজে পথ চলা। পাঠশালার পাঠ- কৈশোরে বড়দার কিনে আনা সাহিত্যের মহারথীদের লেখায়- আমি সেই পথ ধরে চলেছি। আমি প্রথমেই বঙ্কিম চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের সৃষ্টি পড়েছি।
তারপরে বেরিয়ে আসতে পারিনি সেই ভাল লাগা থেকে। বঙ্কিমচন্দ্রজী আমার ভাললাগার রক্তস্রোতে মিশে আছেন। বাংলার বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম মিশে আছেন আমার মনের বুলবুল হয়ে। আজ কিছু প্রিয় পঙ্কতি এখানে লিখে যাব। সবার লেখার মাঝে কত প্রিয় জায়গা ছিল- আজ অনেক বছর সেই জগৎ থেকে দূরে থেকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছু।
শুধু অস্পষ্ট ছবির মত কোথায় কি ছিল তা মনে আছে। কিন্তু সেই ছবি আর ভাসে না। আবার ফিরে গেলে আবার ফিরে পাব তবু সে মাহেন্দ্রলগন তো যেন আমাকে এড়িয়ে চলে। শুধু বাংলার বুলবুলের অনেক সৃষ্টিই আমার মনে ভাস্বর হয়ে আছে।
"তোমারই গেহে পালিছ স্নেহে
তুমি ধন্য ধন্য ধন্য হে।
----------------------------
পিতার বক্ষে রেখেছ মোরে
জনম দিয়েছ জননী ক্রোড়ে
বেঁধেছ সখারো প্রণয় ডোরে
তুমি ধন্য ধন্য ধন্য হে। "
-আমার মায়ের কাছে গুরুদেবের এই গান দিয়েই আমি হারমোনিয়ামে গান গাওয়া শুরু করেছিলাম। আরও অনেক গান শিখেছিলাম মায়ের কাছে। রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল্গীতি, পল্লীগীতি। এবং এইসব ক্যাটাগরীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম সেই ছোট্টবেলায়।
আমার মা-ই আমার সংগীতের প্রথম ওস্তাধ। এখন আমিও গান থেকে বলতে গেলে কিছুটা দূরে- আমার মাও এখন দায়িত্বের দায়ভারে গান থেকে দূরে।
"আমার সকল দুঃখের প্রদীপ
জ্বেলে দিবস গেলে করবো নিবেদন
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন। "
-এই গানের প্রতিটি কথায় যে আত্মপ্লাবী স্রোত আছে তা নিমিষেই মনকে নিয়ে যায় অবগাহনে। এই গানটিও আমার মায়ের কাছেই শেখা।
"এ জীবনে মিটিবে না সাধ-
আমি জলের কুমুদিনী ঝরিব জলে
তুমি দূর গগনে থাকি কাঁদিবে চাঁদ। "
- কাজী নজরুলের এই গানটি আমার অসম্ভব প্রিয়। আমার ওস্তাদজী সুদর্শন রবিদাসের কাছ থেকে গানিটি শেখার সময় কি যেন এক ভাল লাগা মনে ভর করেছিল। সেই ভাল লাগা এখনও আছে।
"ফোঁটে যে ফুল আঁধার রাতে
ঝরে ধূলায় ভোর বেলাতে।
আমায় তারা ডাকে শাঁখে
আয় রে আয়।
---------------
অন্ধকারে এসেছিলেম
থাকতে আঁধার যাই চলে।
ক্ষণিক ভালবেসেছিলেম
চিরকালের নাই হলে। "
-বাংলার বুলবুলের এই গজলের কথাগুলো সহসাই মন কাড়ে।
"সই ভাল বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে
মোর বঁধূ বাঁধা থাকে বিননী ফাঁদে।
।
সই চপল পুরুষ সে, তাই কুরুশ কাঁটায়
রাখিবে খোপার সাথে বিঁধিয়া লো তায়।
তাহে রেশমী জাল বিছায়ে দে ধরিতে চাঁদে। । "
-প্রিয়তমকে বাঁধনে ঝড়িয়ে রাখতে প্রিয়ার এই বেণীর সাজ মনে ঊর্মি জাগায়।
আমার কাছে- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কলার একটি কলা হচ্ছে নারীর চুল বাঁধা-কবরীর সাজ। কলেজের ছাত্রাবাসে থাকতে মাঝে মাঝে রাতে একজনের চুলের সাজ দেখতাম। আমাদের ছাত্রাবাসের সামনে ছিল টিচারদের আবাস। স্যারদের প্রতিটি বাসাই তো দেখা যেত। একদিন দেখলাম স্যারের এক বোন চুল বাঁধছে।
তার চুলও ছিল খুব সুন্দর। আমি তখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এমনিতে জানালা বন্ধ থাকে- সেদিন কেন জানি খোলা হয়েছিল, আর ওদিকে আমার নজর এড়াতে পারেনি। আমি সুন্দরতম আরেকটি কলা দেখে গেছি। সে আমার সহপাঠিনী ছিল।
পরে একদিন তাকে বললাম। সে বলল- তোমার চোখ তো শকুনের চেয়েও প্রখর। সে অবশ্য মজা করে বলেছিল। পরে রাতে সে নিজে থেকেই আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে চুলের কারুকাজ করত তবে জানালা খোলে নয়। জানালা খোলা না থাকলেও ওর বারান্দায় আসার দরজা দিয়ে দেখা যেত।
তখন অবশ্য আমার রুম থেকে দেখা যেত না। রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দার একপাশে যেতে হত। সেখান থেকে কোণাকোনিভাবে দেখা যেত। সে জানত- আমি দেখছি কিন্তু সে আমাকে দেখত না। হা হা হা হা।
অবশ্য তার চুল খুব খুব খুব সুন্দর ছিল- আর খুব লম্বা। আমার সাথের ছেলেরা বা জুনিয়ররা বলত- দাদা, মন খারাপ নাকি- বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন একা একা। আমি বলতাম- না একটু বাতাস সেবন করছি। আহাম্মকের দল কি আর জানত যে আমি নারীর কুন্তল-কলা দর্শন করছি।
"আজো মধুর বাঁশরী বাজে
গোধূলী লগনে বুকের মাঝে।
আজো মনে হয় সহসা কখন
জলে ভরা দুটি ডাগর নয়ন
ক্ষনিকের ভুলে সেই চাঁপা ফুলে
ফেলে ছুটে যাওয়া লাজে।
হারানো দিন বুঝি আসিবে না ফিরে
মন কাঁদে তাই স্মৃতির তীরে।
তবু মাঝে মাঝে আশা জাগে কেন
আমি ভুলিয়াছি ভোলেনি সে যেন
গোমতির তীরে পাতার কুঠিরে
সে আজো পথ চাহে সাঁঝে। "
-বিরহ প্রহর, মান-অভিমান, প্রেম, অনুশোচনা, আশা-নিরাশার দোলাচল, প্রতীক্ষা- সবকিছুই রয়েছে এই দ্বাদশ পঙ্কতিতে।
"চোখ মুছিলে জল মোছে না
বল সখি এ কোন জ্বালা।
শুকনো বনে মিছেই কেন
একলা কাঁদে ফুলবালা। ।
হায় যে বাহুলতার বাঁধন
হেলায় খুলে যায় চলি
বাঁধবে কি তায় নয়নের
জল ভেজা এই ফুলমালা। ।
------------------------------
গাইতে যে গান আপন মনে
সকাল হতে সুর সাধা
আর কেন সই এই অবেলায়
শেষ করে দাও তার পালা।
। "
-কী মধুর গজলের প্রতিটি পঙ্কতি!
"মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা
আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এ পারে-
তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা। "
-কেন জানি এই গানের সাথে নিজের অজান্তেই মনের পাতায় এক ছায়াচিত্র জেগে উঠে। এই গানের অবয়বে আমি এঁকেছিলাম আমার মনের ছায়াচিত্রের এক কাব্যচিত্র। কাজী নজরুলের এই গানটি আমার প্রিয় তালিকায় উপরে তুলে রাখা।
"আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই তুমি তাই গো........."
-গুরুদেবের এই গানের কথা তো কাউকে বলতেই হবে না। নিজেকে নিবেদনের এমন কথা আর কোথায় আছে- কোথায় আছে নিজেকে বঞ্চিত রেখে প্রিয়কে সুখী করার এমন প্রেম কথা!
"হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে
কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি।
তুমি কেন হায় আসিলে হেথায়
সুখের স্বরগ হইতে নামি। ।
চারিপাশে মোর উড়িছে কেবল
শুকনো পাতা মলিন ফুল দল।
বৃথাই কেন হায় তব আঁখিজল
ছিটাও অবিরল দিবসযামী। ।
এলে অবেলায় পথিক বেভুল
বিঁধিঁছে কাঁটা নাহি যবে ফুল।
কি দিয়ে বরণ করি ও চরণ
নিভিছে জীবন জীবনস্বামী। ।
"
-আমার প্রিয় আরেকটি গান। সব ভাল লাগা, ব্যথার সকল সৌন্দর্য যেন প্রতিটি কথায়। নিকুঞ্জ পথ যেন আমাকে ডেকে যায়। আমার বাড়ির অদূরের চা বাগানের পথে বেড়াতে গেলে বুনো ফুল ঝরা পথে হেঁটে হেঁটে আমার মনে হয়- এ পথ যেন কত আপন। আর ঝরা পাতার মর্মর যখন পায়ে বাজে- প্রকৃতি যেন বিরহী গজল গায়।
হাতে উঠে আসতে চায় পেয়ালা। খোদা- দোষ আমার নয়- আমি কি করব। তুমি শরাব দিয়েছ, গজল দিয়েছ- আমি আশিক হলে যদি গুণাহ্ হয় তবুও সেই সুন্দর গুণাহ আমি করে যাব, শুধু তুমি দিয়েছ বলে।
"নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখিজল
মলিন হয়েছে ঘুমে চোখের কাজল। "
-ব্যথার আঁখিজলকে ঢেকে রাখতে প্রিয়ার এই মিথ্যে অভিনয়- পাষাণ পুরুষের হৃদয়েও জাগাবে প্রেমের স্পন্দন।
হয়তো পতির বিদায় বেলায় পত্নীর চোখে এভাবেই ঝরে জল- পতি যাতে কষ্ট না পায় বা না ভাবে তাই দোষ হয় কাজলের। নারীর এই ছলনা আমার ভাল লাগে।
"যাবার বেলায় ফেলে যেও একটি খোঁপার ফুল
আমার চোখে চেয়ে যেও একটু চোখের ভুল।
অধর কোলে ঈষত হাসি ক্ষণিক আলোকে
রাঙ্গিয়ে যেও আমার মনে গহন কালোকেশ
যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে দুলিয়ে যেও দোল।
একটি কথা কয়ে যেও একটি নমস্কার
সেই কথাটি গানের সুরে গাইবো বারেবার
হাত ধরে মোর বন্ধু ভুলো একটু মনের ভুল।
"
-এমন প্রেমিক হতে আমি হাজারবার দেবদাস হতে রাজি আছি। এখন পর্যন্ত আটবার হয়ে গেছি। আর কেউ সফল বলুক না বলুক- বাংলার বুলবুল আজ বেঁচে থাকলে আমার ব্যথায় ব্যতিত হবার পাশাপাশি খুশীও হতেন এই ভেবে যে তাঁর গানের কথা জীবনে মিলে যায়।
"সন্ধ্যা গোধূলী লগনে কে
রাঙ্গিয়া উঠিলে তুমি কারে দেখে।
হাতের আলতা পড়ে গেল পায়ে
অস্ত দিগন্ত বনান্ত রাঙ্গায়ে
আঁখিতে লজ্জা অধরে হাসি
কেন অঞ্চলে মালা রাখিলে ঢেকে।
চির নির্বিনোদ বিননীতে বাঁধে
দেখিলে সেখন সুন্দর ছাঁদে
হৃদয়ে ভীরু প্রদীপ শিখা
যেন কাঁপে আনন্দে কেঁপে কেঁপে। "
-সন্ধ্যা গোধূলী লগনে প্রিয়ার লাজ অবনত চোখের খেলা দেখতে- তার দুরুদুরু বুকের আনন্দে কেঁপে উঠা অনুভব করতে বারবার প্রেমিকার প্রেমে নতুন করে প্রেমে পড়তে মন চায়। আফসোস- মাঝে মাঝে সন্ন্যাসী হয়ে যেতে হয়।
"বুলবুলি নিরব নার্গিস বনে
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে।
সিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধি পাশে
তরুন ইরানী কবি কাঁদে নিরজনে।
উদাসীন আকাশ থির হয়ে আছে
জলভরা মেঘ লয়ে বুকের মাঝে
সাকির শরাবের পিয়ালার পরে
সকরুণ অশ্রুর বেলফুল ঝরে
চেয়ে আছে ভাঙ্গা চাঁদ মলিন আননে। "
-আমার বাসায় পেয়ালা খালি পড়ে আছে। কিন্তু এই গান যে আমাকে শুধু পান করতে বলে। তোমরা কি বুঝবে বন্ধু হিয়ার উচাটন- তোমাদের দুনিয়ায় আমি তো বদনাম।
"মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দুলাবো তৃতীয়া তিথীর চৈতী চাঁদের দোল।
কণ্ঠে তোমার পরাবো বালিকা
হংস সারির দুলানো মালিকা
বিজলী জরিণ ফিতায় বাঁধিবো
মেঘ রঙ এলো চুল।
জোছনার সাথে চন্দন দিয়া মাখাবো তোমার গায়
রামধনু হতে লাল রঙ ছানি আলতা পরাবো পায়।
আমার গানের সাত সুর দিয়া তোমার বাঁসর রচিব গো প্রিয়া
তোমারে ঘিরিয়া গাহিবে আমার কবিতার বুলবুল। "
-কথাগুলো এখনও জীবনে আফসোস হয়ে আছে।
বিঃদ্রঃ যতি চিহ্নের ব্যবহারে মূল লেখার সাথে হেরফের আছে।
অনেক আগের দেখা- যতি চিহ্ন তো আর মনে থাকেনি। কোথাও কোথাও লেখার মাঝেও ভুল থাকতে পারে।
এই লিখাটি আমার নয় । ভালো লাগলে মূল লেখককে ধন্যবাদ জানান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।