আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতায় সামাজিক দায়



সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক দায় ফকির ইলিয়াস 'একাডেমী অব আমেরিকান পয়েটস্' যখন মার্কিন কবি টরি ডেন্ট-এর কাব্যগ্রন্থ 'এইচআইভি, মন আমোর' (HIV, MON AMOUR) কে ১৯৯৯ সালের জেমস লাফলিন এ্যাওয়ার্ডটি প্রদান করে তখন কিছু বিতর্ক দেখা দিয়েছিল৷ কোন কোন পাঠক-সমালোচক বলেছিলেন, এই বিচার মোটেই সঠিক হয় নি৷ তাঁদের বক্তব্য ছিল, এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো নিরীক্ষাধমর্ী হলেও এর চেয়ে ভালো, ঋদ্ধ সমসাময়িক কবিতার বই ছিল যা এই এ্যাওয়ার্ড পেতে পারতো৷ ১৯৯৯ সালের এই এ্যাওয়ার্ড নির্বাচনী কমিটিতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন বিশিষ্ট কবি ও লেখক_লীন ইমানুয়েল, ইউসেফ কমুনিয়াকা এবং মেরিলিন নেলসন৷ জেমস লাফলিন (১৯১৪-৯৭) ছিলেন একজন বিশিষ্ট কবি এবং প্রকাশক৷ এরিক মাথিউ কিং ফাউন্ডেশন কবি জেমস লাফলিনের স্মৃতির সম্মানে এই পদকের অর্থমূল্য সরবরাহ করে৷ ফাউন্ডেশন তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তে জানায়, কবি জেমস লাফলিন ১৯৩৬ এবং এর পরবতর্ী সময়ে মার্কিন কবিতায় নতুন ধারার প্রবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন৷ এ্যাওয়ার্ডটি প্রদান যথার্থ হয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে৷ এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান যখন কোন পদক দেয় তখন তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে৷ তবে সে-দৃষ্টিভঙ্গি কতোটা সাধারণ পাঠকের মতামতকে প্রতিফলিত করে তাও বিবেচনায় রাখতে হয়৷ বিশেষ করে যাঁরা বিচার কার্যটির দায়িত্ব পেলেন, তাঁরা পক্ষপাতদুষ্ট কিনা, কিংবা পরিশুদ্ধ রূপে বিচারটি করলেন কিনা, তাও ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে৷ ইউরোপ-আমেরিকায় একটি নিশ্চয়তা আছে, তা হচ্ছে সাহিত্য পুরস্কারগুলোকে রাষ্ট্র বা সরকার প্রভাবিত করে না৷ সাহিত্য তার নিজ ব্যাপ্তির বলয়ে থেকেই সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে৷ কোন নেপথ্য শক্তি বিচারকদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে না৷ তারপরও যে দ্বিমত পোষিত হয় না, তা নয়৷ গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকতেই পারে৷ কিন্তু মূল লক্ষ্য হচ্ছে আধুনিক, মননশীল সমাজ নির্মাণে সাহিত্যের ভূমিকা৷ এপ্রিল মাসটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কবিতার মাস৷ বিভিন্ন সংগঠন কবিতাপাঠ তো বটেই, কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধ, আলোচনার ভিতর দিয়ে মেতে ওঠে গোটা যুক্তরাষ্ট্র৷ লেখক সংগঠন 'পেন'-এর আয়োজনে গত এপ্রিলে (২০০৬) নিউইয়র্কে বেশ ক'টি সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়ে গেল৷ 'পেন'-এর এবারের হোস্ট ছিলের ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক সালমান রুশদী৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট ৩৬ জন লেখক অংশ নেন 'পেন' আয়োজিত এই 'নিউইয়র্ক ফেস্টিভেল অব ইন্টারন্যাশনাল লিটারেচার'-এ৷ ২৫ এপ্রিল ২০০৬ থেকে ৩০ এপ্রিল এ ছয়দিন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন ভেনু্যতে অনুষ্ঠিত হয় এই ফেস্টিভেল৷ এই উত্‍সবে প্রবীণ কবি-লেখকদের পাশাপাশি অনেক তরুণ কবি-লেখকও অংশ নিয়েছেন৷ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের পাশাপাশি ভারত থেকে এসেছিলেন রীতু মেনন ও সুকেতু মেহতার মতো নবীন লেখকরাও৷ সিরিয়ার আমর আব্দুল-হামিদ ও পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া অভিবাসী লেখক আজহার আবিদী খোলামেলা বক্তব্য রেখেছেন সাহিত্যবিষয়ে৷ ম্যানহাটানের ক'টি ভেনু্যতে এসব লেখকদের বক্তব্য শোনার, আড্ডায় অংশ নেয়ার সুযোগ আমার হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের লেখক রাসেল ব্যাংকস অত্যন্ত চমত্‍কার কিছু কথা বলেছেন সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ে৷ তিনি বলেছেন, সাহিত্য হচ্ছে সমাজের মাতৃতুল্য৷ মা যেমন সন্তানকে লালন করে, সাহিত্যও তেমনি সমাজকে লালন করে৷ তিনি বলেন, সমাজে কল্যাণকর প্রথা চালু এবং সমাজের পরিশুদ্ধ বিবর্তন-সাধনই হচ্ছে সাহিত্য রচনার প্রকৃত লক্ষ্য৷ শুনেছি ব্রিটেনের লেখক মার্টিন আমিসের কথা৷ তিনি বলেছেন, বৃক্ষ আছে বলেই প্রকৃতি এমন সবুজ-সুন্দর, ঠিক তেমনি সাহিত্যও হচ্ছে মানব হৃদয়ের সেই ক্লোরোফিল, যা কিনা মানব হৃদয় ও ভালোবাসার বহমান চেতনাকে চিরসজীব করে রাখে৷ তিনি আরো বলেন, সজীবতা কে না চায়? সাহিত্যের কোলে মাথা রেখে মানুষ সেই সজীবতার প্রকৃত আস্বাদনই পেতে পারে৷ দুই নিউ ইয়র্কে বাংলা নাট্যদলের আয়োজনে 'প্রেম ও বিদ্রোহের কবিতা' শীর্ষক একটি ছোট্ট অনুষ্ঠান হয়ে গেল এপ্রিলেই৷ এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অভিবাসী কবি শহীদ কাদরী৷ তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আজকাল কবিতা পড়ে কেউ বিদ্রোহী হয় না, প্রেমও করে না৷ তিনি আরো বলেন, প্রবাসে আমার অনেকের সাথে কথা হয়৷ সবাই বলেন, কবিতা পড়ার সময় কোথায়? শহীদ কাদরী বললেন, কবিতা মোটেই গানের বিষয় নয়৷ গানের মাঝে কবিতার কবিত্ব হারিয়ে যায়৷ তিনি বলেন, সুর করে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে, বাংলা গানেরও অধঃপতন হয়েছে চরম ভাবে৷ আজকাল কবিতা পড়ে কেউ বিদ্রোহী হয় না কিংবা প্রেমিক হয় না, শহীদ কাদরীর এই বক্তব্যের সাথে পাঠক, কবিতাপ্রেমী, বোদ্ধা সমাজ হয়তো একমত হবেন না৷ কারণ আমরা ইরাক যুদ্ধ শুরুর সময়েই দেখেছি, এই যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক লাইব্রেরী, সাহিত্য সংগঠন, বড় বড় সাহিত্য প্রতিষ্ঠানগুলো যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে৷ তাঁরা বিদ্রোহী হয়েছেন আণবিক বোমার বিরুদ্ধে, শান্তির সপক্ষে৷ ডোনাল্ড হাল কিংবা লরেন গুডম্যান-এর মতো কবিরা মুক্ত কণ্ঠে বলেছেন_শেষ হোক যুদ্ধের নগ্ন পরিভ্রমণ৷ আর কবিতা পড়ে কেউ প্রেমিক হয় না, কিংবা প্রেম করে না, তা মেনে নেয়া তো কষ্টকর৷ হাঁ, হয়তো বদলেছে প্রেমের ভাববাচ্য৷ প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, ই-মেল, মুঠোফোনের যুগে কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে সাদা কাগজ-কালো কালির প্রেমাক্ষর৷ কিন্তু হৃদয় তো বদলে যায় নি৷ আর বদলে নি বলেই এখনো জীবনানন্দ হয়ে ওঠেন বাংলায় শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতার লেখক৷ বহুল পঠিত হয় তাঁরই কবিতা৷ কবি শহীদ কাদরী এই প্রবাসে থেকেও শূন্য দশকের কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে ওঠেন_'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা৷' তিন সমাজের জন্য সাহিত্য খুব জরুরী৷ কিন্তু তার আগে তো সাহিত্যকে বাঁচাতে হবে৷ বাঁচাতে হবে সাহিত্যিককেও৷ এবছর ২০০৬ সালে 'পেন' আমেরিকান সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন দু'জন লেখক, কবি৷ পেন-নাভোকাভ পুরস্কারটি পেয়েছেন ফিলিপ রথ৷ এই পদকটি স্পন্সর করেছে নাভোকাভ ফাউন্ডেশন৷ বিশেষভাবে কবিতায় পেন_ভয়েলকার পুরস্কারটি পেয়েছেন লিন্ডা গ্রেগ৷ ১ মে এ পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে৷ ২২ মে একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার লেখকদ্বয়ের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে৷ লিন্ডা গ্রেগ-এর পুরস্কারটি স্পন্সর করেছে ভয়েলকার ফাউন্ডেশন৷ এখানে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট, বিশ্বের বিভিন্ন সৃজনশীল পদকগুলো কোন না কোন ফাউন্ডেশন বা সংস্থা স্পনসর করে থাকে, তারাই অর্থের যোগান দেয়৷ সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ইউরোপ আমেরিকার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজ নিজ নামে ফাউন্ডেশন গড়ে 'উইল' করে গেছেন৷ সেসব সঞ্চিত অর্থের লভ্যাংশ সাহিত্যের জন্য, সমাজের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে৷ সাহিত্যের নান্দনিক উত্‍কর্ষ সাধনে এই যে প্রত্যয়, তা আমার কাছে খুবই উল্লেখযোগ্য মনে হয়৷ কেউ ক্যাসিনোতে জুয়া খেলেও মিলিয়ন ডলার হারছে৷ আর কেউ যদি সাহিত্যের জন্য এমন অর্থমূল্য দান করে যান তাহলে প্রমাণ করা চলে, মানুষের প্রতি তাঁদের দরদ আছে৷ মানুষ কিন্তু জ্ঞান, বিচার বিবেচনা-শক্তি কিংবা আচরণের পরিপূর্ণতা নিয়ে জন্মে না৷ বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার প্রতিটি সৃজনশীল শক্তি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে৷ এই ভাবনাটি আমাকে সবসময়ই তাড়া করে বেড়ায়৷ চার সামপ্রতিককালে আরেকটি বিতর্ক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে৷ তা হচ্ছে, সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সৃজনশীল সাহিত্য; কিন্তু সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে মিডিয়াগুলো কি খুবই তত্‍পর নয়? প্রতি রোববার বহুল-প্রচারিত মার্কিনী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ বুক রিভিউ সেকশন বের হয়৷ এই রিভিউতে দেখা যায় নিউ ইয়র্ক টাইমস বিভিন্ন বই-কে 'বেস্ট সেলার' কিংবা 'টাইমস ফার্স্ট চয়েস' বলে অভিধা দিচ্ছে৷ এখানে লক্ষণীয়, নিউ ইয়র্ক টাইমস কিন্তু সরাসরি উক্ত বইটি কেনার জন্য পাঠককে বলছে না৷ কিন্তু একটি পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করছে পাঠকের মনে৷ ফলে লক্ষ লক্ষ পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বইটি কেনার জন্য৷ এমন বিতর্ক বাংলা সাহিত্যেও হচ্ছে৷ বাংলা কোন জাতীয় দৈনিকের 'সৃজনশীল' কিংবা 'মননশীল' লেখক নির্বাচন, অথবা জাতীয় দৈনিক-প্রবর্তিত পুরস্কার নিয়েও দ্বিমত থাকছে৷ পার্থক্যটা হচ্ছে এই, নিউ ইয়র্ক টাইমস যে দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা যে যোগ্যতাসম্পন্ন লেখকদ্বারা কোন বুক রিভিউ লেখাচ্ছে, বাংলা কোন জাতীয় দৈনিক তা করতে পারছে না৷ কখনো কখনো পক্ষপাতেও আক্রান্ত হচ্ছে৷ গোষ্ঠীবদ্ধ লেখক বলয়ে বন্দী থেকে যাচ্ছে তাদের প্রচেষ্টা৷ সাহিত্যে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি খুবই জরুরী৷ আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ কিংবা পোয়েট্রি ম্যাগাজিনে একজন কবি স্থান পাবার পর তাঁকে আর পেছনে পড়ে থাকতে হয় না৷ প্রকাশকরাই তাঁর পিছনে ছোটেন৷ সমালোচকরা তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়ে আলোচনা করেন এ কবি-লেখকের লেখার৷ সাহিত্যে সৃজনশীল পৃষ্ঠপোষকতা এভাবেই লালিত হয়৷ এভাবেই প্রতিষ্ঠা পান সৃষ্টির পক্ষে একজন লেখক৷ আসলে একজন প্রকৃত পাঠক সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ কখনো কখনো একজন মননশীল পাঠকও হয়ে উঠতে পারেন ভালো লেখক৷ কয়েক দশক ধরে পোয়েট্রি ম্যাগাজিনের সম্পাদকের কাছে লিখিত পাঠকের পত্র 'লেটারস টু দ্যা এডিটর' সম্পাদনা করে বেরিয়েছে একটি চমত্‍কার সমকালীন সাহিত্যচিত্র, 'ডিয়ার এডিটর'৷ মানুষের জীবনের গল্পটা হচ্ছে প্রতি দিনই একটি ইতিহাসের দিকে ধাবিত হওয়া৷ একটি স্মৃতিতে ডুবে যেতে থাকা৷ কেউ স্বচ্ছ আকাশে ভাসমান মেঘ দেখে মাটিতে দাঁড়িয়ে৷ আবার কেউ প্রতিটি ভোরের সূর্যস্নান করে বেদনায়, নিষ্পেষণে৷ সাহিত্য জীবনকে তো সেই বাস্তবতার পরশই দেয়৷ যে সাহিত্য যতো বেশী স্বচ্ছ রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পায়, সেই সাহিত্যই ততো বেশী মানব কল্যাণে ব্যাপৃতি আনতে পারে৷

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।