যশোর: প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে দেয়া দু’লাখ টাকার চেক নিতে এসেছিলেন উদীচী হত্যা মামলায় নিহত তপনের মা ছামসুন নাহার। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সামসুন নাহারের দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বইছিল নোনা জল।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে মঞ্চে দায়িত্ব পালন করছিলেন রজব উদ্দিন আহমেদ তপন। বোমা হামলায় তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।
সোমবার সকালে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অর্থ সহায়তার চেক নিতে আসেন নিহত বাবুল সূত্রধরের বাবা নিখিল রায় আর তার মা।
চেক নিতে এসে তারাও অশ্র“ সম্বরণ পারছিলেন না কিছুতেই। শাড়ির আঁচলে বারবার চোখের পানি মুছতে থাকেন বাবুলের মা।
এমনিভাবে এ অনুষ্ঠানে আসেন নিহত নূর ইসলামের স্ত্রী নূরজাহান বেগম। সরকারের আবাসন প্রকল্প ‘আশ্রয়ণে’ ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনওরকমে দিন গুজরান করছেন তিনি।
শহরের পোস্ট অফিস পাড়ার উদীচী কার্যালয়ে সোমবার দুপুরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আরো এসেছিলেন ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ রাতের ওই ভয়াবহ বোমাহামলায় যারা দু’পা কিংবা এক পা হারিয়েছেন।
হারিয়েছেন তাদের স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপনের উপায়।
ভয়াবহ ওই বোমা হামলায় নিহত ও আহত অস্বচ্ছল ১১ পরিবারের সদস্যদের মাঝে প্রায় এক যুগ পর ১৪ লাখ টাকার চেক বিতরণ করা হয়।
অর্থসহায়তার চেক গ্রহণ করেন এক পা হারানো যশোরের নীলগঞ্জ এলাকার সুকান্ত দাস। পা হারানোর পরও কঠোর অধ্যাবসায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিতে সম হয়েছেন তিনি। এখন চিকিৎসা করাতে হবে তার মারাত্মক তিগ্রস্থ হাতটিরও।
চেক গ্রহণ করেন দু’ পা হারানো নাহিদ, ৬মার্চ রাতের সেই অনুষ্ঠানে গান গাইতে আসা বাউলশিল্পী হরেন্দ্রনাথ অধিকারী এবং গানপাগল সমির কুমার সরকার।
শ্রোতাদের গান শোনাতে আসা বাউল হরেন্দর দু’পায়ে সেদিন বাঁধা ছিল ঘুঙুর। কিন্তু বোমা হামলায় সেদিন তিনি পা’ই হারানদু’টি।
চেক নিয়েছেন, বাউলদের গানে সঙ্গত দিতে আসা শহরের সেকেন্দার আলী, হারুন অর রশিদ আর মুক্তিযোদ্ধা ফটোসাংবাদিক এসএম শফির ছেলে মনোয়ার হোসেন মনু। মনু সম্মেলনের ফটো তুলছিলেন তার বাবার স্মৃতিমাখা ক্যামেরাটি দিয়ে।
কিন্তু তার কাছে অমূল্য সেই ক্যামেরাটিও সেদিন খোয়া যায়। বোমা হামলায় তিনি পেটে ও পায়ে মারাত্মক আঘাত পান।
চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাংসদ খালেদুর রহমান টিটো। এছাড়া বিশেষ অতিথি ছিলেন যশোরের জেলা প্রশাসক নূরুল আমীন ও বিশিষ্ট নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম। সভাপতিত্ব করেন উদীচী যশোর জেলা শাখার উপদেষ্টা অ্যাড. কাজী আব্দুস শহিদ লাল।
সংসদ সদস্য খালেদুর রহমান টিটো তার বক্তব্যে বলেন, ‘১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ জাতির জন্য একটি কলঙ্কের দিন। ’
তিনি জানান, এরকম মর্মান্তিক দৃশ্য যেন তাকে আর না দেখতে হয়- সেই কামনা করেন তিনি।
টিটো বলেন, ‘মুষ্টিমেয় কিছু লোক যারা বিভ্রান্তির পথে গেছে, তাদের প্রতিহত করতে আমাদের দৃঢ় মানসিকতা রয়েছে। সেই ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পরে শক্তি চিরদিনই লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ’
সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘যারা উদীচী, রমনার বটমূল, সিপিবি ও আওয়ামীলীগের সমাবেশে বোমাহামলা চালিয়েছে, তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের শত্র“।
যারা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্বাস করে না সেই অপশক্তিই শুভচেতনা বিনষ্টের কাজে লিপ্ত হয়েছে। তাদের সেই আকাঙ্খা কখনোই পূরণ হবে না। ’
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে হাসান ইমাম বলেন, ‘দীর্ঘ সাত বছর আমাকে দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে। বিএনপি আর জামায়াত-শিবিরের নেতারা বলেছে, আমিই নাকি বোমাহামলার সঙ্গে জড়িত। অথচ আমি জীবনে কখনো একটা পিঁপড়াও মারিনি।
’
তিনি জানান, দেশে অনেক বোমাহামলা হয়েছে- কোনও ঘটনাই সংশ্লিষ্টরা মনে রাখেনি। কেবল উদীচীই তার কর্মীদের স্মরণ করে। কেননা আমরা মনে করি, উদীচী হচ্ছে সাধারণ মানুষের সংগঠন। সবাই আমাদের লোক। ’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের ৬মার্চ রাতে যশোর টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের শেষদিনে ভয়াবহ বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও আহত হন প্রায় দু’শ নারী পুরুষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।