তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে হাত ছুঁয়ে বলে বন্ধু; তুমি জেনেছিলে মানুষে মানুষে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, হাসি বিনিময় করে চলে যায় উত্তরে দক্ষিণে; তুমি যেই এসে দাঁড়ালে - কেউ চিনলো না, কেউ দেখলো না; সবাই সবার অচেনা।
জানালার ওপাশে গলার স্বর শুনেই তড়িঘড়ি করে জানালা বন্ধ করবার চেষ্টা। কাচটা তুলে দিতে দিতে তখনো পার্থ শুনে যাচ্ছে শীর্ণ বৃদ্ধার কাঁপা গলার আকুতি, "আল্লাহ সুখে রাখবো বাবা, দুইডা পয়সা দ্যান্ বাবা ..." কাচটা সম্পূর্ণ তুলে দিলো পার্থ; ড্রাইভারকে বললো এসিটা অন করে দিতে। বাবার গাড়িতে আয়েশ করে বসে আছে সে। ইচ্ছা না থাকলেও আয়েশী ভাবটা গায়ে লাগানোর প্রানান্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আজ তিন মাস হলো ব্যবসার দেখভাল করছে; বিরাট গার্মেন্টস মালিকের একমাত্র ছেলে। আর্টস্ এর উপর পড়াশোনা করে এখন ব্যবসাদার। স্যুট-প্যান্ট পড়ে আয়নার সামনে যখন দাঁড়ায়, তখন মনে হয় পৃথিবীটা টাইবন্দী হয়ে গেছে, আটকে আছে গলায়! ছেলে ব্যবসায় নেমেছে, বাড়িতে এখন ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এসবে বিশেষ কান দেয় না ও!
"এই জাম্ যে কবে ছাড়ে!", ড্রাইভারের কথায় চোখ খুলে সামনে দেখলো পার্থ। সারি সারি গাড়ির ভিড়ে আটকে পড়ে খুব একটা খারাপ লাগছে না।
একঘেয়ে জীবনটায় পৌঁছুতে আরো কিছু সময় লাগবে ভেবে ভালো লাগলো ওর। ক্যামেরাবন্দী করতে ইচ্ছে হলো জ্যামে আটকে পড়া অসহায় শহরটাকে! ক্যামেরার কথা মনে পড়তেই পাশ ফিরালো দৃষ্টি, মনে পড়লো ক্যামেরা হাতে ছুটে চলা কয়েকটি বছর, কিছু মনের মতো মুহুর্ত। ফুটপাথের ধার ঘেষে ওদের গাড়িটা জ্যামে আটকা। মাঝে মাঝে শামুকের গতিতে এগুচ্ছে সেটা।
এ গাড়ি- ও গাড়ির জানালায় আটকে পড়া কিছু মানুষের দুপুরের খাবার, ফুল হাতে ছোট্ট মেয়েটি দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে, কিছু ভবঘুরে ফুটপাথকে বিছানা- খোলা আকাশকে ছাদ আর ইটের টুকরাকে বালিশ বানিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে! "এলিয়ে দিয়েছে?! আমি যেমন এসিতে এলিয়ে আছি সেভাবে? নাকি জীবনের ব্যর্থ হিসাবের খাতা হারিয়ে রাস্তায় নেমেছে খুঁজতে?", জানালা দিয়ে বাইরের জগতটা দেখতে দেখতে ভাবলো পার্থ।
টঙের দোকানটার দিকে নজর গেলো; সিগারেট ফুঁকার সাথে সাথে চায়ের ব্যস্ততায় আড্ডা দিচ্ছে কিছু লোক! মনে পড়লো হুট করে চায়ের কাপ হাতে নেয়া, ধোঁয়ায় মুখরিত হওয়া, বন্ধুদের সাথে প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডা বা একা প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো; মানুষগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করা।
ক্যামেরার কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো, পারলো না। তিন মাস আগে, জীবনটা নিয়ে অন্যরকম স্বপ্ন দেখতো ও, ছিমছাম স্বপ্ন; কিন্তু এখন? কর্পোরেট যুগে পরিবারের কর্পোরেট চাহিদা জিঁইয়ে রাখতে নিজ হাতে গলা টিপে মেরেছে জীবনকে! টিশার্ট-জিন্স পরা ক্যামেরা হাতের সেই ছেলেটিকে এখন সে ভুলতে চায়, ভুলতে চায় চেনা-অচেনা প্রাণগুলোর সাথে ওঠাবসা; তাদের জীবনধারার মুহুর্তগুলোর সঙ্গী হওয়ার নেশা .....। জানালা দিয়ে উঁচু উঁচু দালান আর রাস্তায় ছুটে চলা মানুষগুলো দেখে ভীষণ কষ্ট হয় ওর; উঁচু দালানগুলোয় উঠতে মানুষ ক্রমশই প্রাণ হারাচ্ছে, নিচু হচ্ছে। কিচ্ছু যায় আসে না তাতে; প্রাণের তাগিদে নয়, প্রয়োজনের তাগিদে অনবরত এই ছুটে চলা, যাতে আজ নিজেই শামিল হতে চাইছে! ভাবতেই বিদ্রূপের সূক্ষ্ম রেখা ভেসে উঠলো ওর ঠোঁটে!
দৃষ্টিসীমার ভেতর এক অদ্ভুত কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত প্রতিচ্ছবি পেল পার্থ।
অদূরে এক ছেলে চোখে পড়লো; রাস্তার একপ্রান্তের দেয়ালে হেলান দিয়ে বাঁ হাতে ধরা খাতাটায় আঁকিবুকি করে চলেছে, মাঝে মাঝে চশমার ভিতর দিয়ে দেখে নিচ্ছে রাস্তার মানুষ আর তাদের ছুটে চলাকে ... ওর হার্টবিট বেড়ে গেলো; "সত্যি বলতে নিজের সাথে অভিনয় আর পারছি না", স্বগতোক্তিতে বিদ্ধ হতে হতে পিছনের দরজার লক খুলে নেমে পড়লো ও! পেট্রোলে পোড়া নোংরা ধূলোজমা বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নিল। তারপর গলাবন্ধনীর বন্ধন হালকা করে গাড়ির পিছনের ডালা খুলতে বললো ড্রাইভারকে! অবাক হয়ে ড্রাইভার আদেশ পালন করলো। সাধের ক্যামেরাটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ও! ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়লো মুখে; বিদ্রূপের নয়, ভালো লাগার খাঁটি অনুভূতির .....।
ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ফুটপাথে উঠলো ; লেন্সের ভিতর দিয়ে চারপাশ দেখতে চাওয়ার নেশাটাকে ফিরে পেয়ে, জ্যামে আটকে পড়া দুনিয়াকে পিছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করলো পার্থ। ভাবলো, প্রয়োজন নয়, প্রাণের তাগিদে বাঁচবো আমি ...........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।