MAD-E IN BANGLADESH
বছরের প্রথম দিনেই হাতে হাতে পাঠ্যপুস্তক মোশতাক আহমেদ
নতুন বইয়ের গন্ধটা কেমন? ভাবতেই যেন এক লহমায় ফিরে আসে সেই দুরন্ত শৈশব। সেই সব স্মৃতিময় দিন, যখন নতুন বইয়ের রোমাঞ্চ ঘিরে থাকত বছরের শুরুর দিনগুলো। নতুন ক্লাসের নতুন বই বুকে চেপে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ হারিয়ে যায়নি আজও। বরং এবার তা রীতিমতো উৎসবে পরিণত হয়েছে। গতকাল শনিবার ছিল সেই উৎসবের দিন-‘পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস’।
সকাল থেকেই সারা দেশের স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় জমে যায় সরকারিভাবে বিতরণ করা নতুন বই হাতে তুলে নিতে। প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় পাঠ্য বই।
গতকাল সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দেখা গেল শত শত শিক্ষার্থী বসে আছে খেলার মাঠে। তারা সবাই পাঠ্য বইয়ের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ অন্য অতিথিরা শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন।
‘হিপ হিপ হুররে’ ধ্বনিতে চারপাশ মুখর করে তোলে শিক্ষার্থীরা। মন্ত্রী মাঠে গিয়ে মিশে যান শিক্ষার্থীদের মাঝে।
এ রকম আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে নতুন বছর ও শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিন প্রথম থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্য বই তুলে দিয়ে দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবসের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী। শুধু মোহাম্মপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজই নয়, দেশব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পালিত হয়েছে এই উৎসব। কোথাও কোথাও নতুন বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা আনন্দ শোভাযাত্রাও করেছে।
তবে প্রথম দিনে বেসরকারি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই বিতরণ না করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার কোথাও কোথাও পুরো সেট বই না দিয়ে কয়েকটি বই দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই সব শিক্ষার্থী বই পেয়ে যাবে। কোথাও কোথাও বই বিতরণের সময় টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উৎসবের উদ্বোধন করতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘কারো কারো সন্দেহ হতে পারে যে সারা দেশে বই গেল কি না।
আমি সবাইকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই পৌঁছেছে। ১ বা ২ শতাংশ কম থাকলে সেটা আমরা বাফার স্টক (সরকারি গুদাম) থেকে দিতে পারব। ’
সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়ার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, জগৎজুড়ে আর কোথাও একসঙ্গে ২৩ কোটিরও বেশি বই ছাপার ইতিহাস নেই। আমরাই সেটা করছি। ’
শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, ‘কেউ কেউ আছেন যখন ক্লাসে পড়ান, তখন শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে না।
কিন্তু যখন প্রাইভেট পড়ান, তখন বুঝতে পারে। দয়া করে শিক্ষকদের মর্যাদা নষ্ট করবেন না। ’ তিনি শ্রেণীকক্ষে সমস্ত সিলেবাস পড়ানোর ওপর জোর দেন। একই সঙ্গে শিক্ষকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর আশ্বাস দেন।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশীদ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তফা কামাল উদ্দিন, মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত প্রমুখ।
পরে মন্ত্রী টিকাটুলী সরকারি কামরুননেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের মাঝে বই বিতরণ করেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীন চট্টগ্রামের লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও প্রতিমন্ত্রী মো. মোতাহার হোসেন রাজধানীর মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই বিতরণ করেন। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন। ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিরা পাঠ্য বই উৎসবের খবর পাঠিয়েছেন।
এবার দ্বিতীয়বারের মতো সরকার প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে পাঠ্য বই দিচ্ছে।
এ জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এবতেদায়ি, দাখিল, দাখিল (ভোকেশনাল) এবং এসএসসি (ভোকেশনাল) স্তরের জন্য প্রায় তিন কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২৩ কোটি ২০ লাখের মতো বই বিতরণের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। গতকালের উৎসবের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বৃহস্পতিবার কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষের বই বিতরণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
কালের কণ্ঠের সিলেট অফিস জানায়, সারা দেশের মতো সিলেটেও উৎসবমুখর পরিবেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও দাখিল স্তরের পাঠ্য বই বিতরণ শুরু হয়েছে। বরিশাল অফিস জানায়, বরিশালে দুপুর ১টায় বরিশাল জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে জেলা প্রশাসক এস এম আরিফ-উর-রহমান বই বিতরণের কাজ উদ্বোধন করেন।
পিরোজপুর থেকে আঞ্চলিক প্রতিনিধি জানান, পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন পাঠ্য বই বিতরণ করা হয়েছে।
নতুন বই পেয়ে ভাণ্ডারিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহরে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। তবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা বই পেলেও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা গতকাল পর্যন্ত বিনা মূল্যের বই পায়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, সকালে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে বই বিতরণের কাজ উদ্বোধন করেন। শেরপুর প্রতিনিধি জানান, শেরপুরে আড়ম্বরে বিভিন্ন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও মাদ্রাসায় পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে। সদর উপজেলার কোহাকান্দা এস হক উচ্চ বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক।
তবে গতকাল কিন্ডারগার্টেনগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বই বিতরণ করা হয়নি।
জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, আর বি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বই বিতরণের কাজ উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক অশোক কুমার বিশ্বাস। পরে সেখান থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, সেখানে বই বিতরণ উদ্বোধন করেন শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। পাবনা থেকে আঞ্চলিক প্রতিনিধি জানান, বেড়া বি বি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু।
এ ছাড়া যশোর, গাইবান্ধা, চাঁদপুর, নীলফামারী, মাগুরা, কুড়িগ্রাম, কক্সবাজারের উখিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় উৎসবমুখর পরিবেশে পাঠ্যপুস্তক দিবস পালনের খবর পাঠিয়েছেন কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।
বই বিতরণের সময় টাকা গ্রহণ!
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) থেকে প্রতিনিধি জানান, জেলার রাজীবপুর উপজেলায় বিনা মূল্যের পাঠ্য বই বিতরণের সময় নানা অজুহাতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে গ্রহণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নয়াচর ফাজিল মাদ্রাসা, চর নেওয়াজী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও নয়াচর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানরা অবৈধভাবে এই টাকা গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
নয়াচর গ্রামের শিক্ষার্থীর অভিভাবক বাহার আলী, শাহার আলী, ও সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁদের ছেলেমেয়ে চর নেওয়াজী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ওই স্কুলের অফিস সহকারী আজহার আলী ছাত্রছাত্রী প্রতি ২০০ টাকা করে নিয়ে বই বিতরণ করছেন।
যারা টাকা দিচ্ছে না তাদের বই দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে অফিস সহকারী আজহার আলী বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক আমাকে ছাত্রছাত্রী প্রতি ক্রীড়া ফি ও সেশন ফি বাবদ ২০০ টাকা নিতে বলেছেন। ’ প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি বলেন, ‘ওই টাকা সেশন, ভর্তি ও ক্রীড়া ফির টাকা। ’
নয়াচর বাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এক হাতে ৫০ টাকা অন্য হাতে বই বিতরণ করা হয়েছেÑবই উৎসবের দিনে এ কথা বললেন অভিভাবক সুরুজ্জামান। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রুহুল ইসলাম বকুল ৫০ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি ৫০ টাকার ভর্তি ফির রসিদ দিয়ে দিচ্ছি।
এখানে কোনো কারচুপি নেই। ’
এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বই বিতরণের সময় টাকা গ্রহণের কোনো নিয়ম নেই। টাকা গ্রহণের বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল কাদের বলেন, ‘টাকা গ্রহণের বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে আমি খোঁজ নিচ্ছি।
যদি প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।