আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছেলেবেলা অথবা সোনালীবেলা, আর আমার মা

আমার ব্লগ আমি আমার ডায়েরীর মতো করে ব্যবহার করি। এখানে আমি একটা গল্প অথবা কবিতা লিখতে পারি, অথবা আজকে কিসের তরকারী দিয়ে ভাত খেলাম, সেইটাও লিখতে পারি। । ছোটবেলা অকাম-কুকাম করার পর মা আমাকে যেইসব শাস্তি দিতেন, তাঁর মধ্যে প্রধান শাস্তি হলো কান ধরে টেনে আমাকে একহাত উপরে তুলে ফেলার চেষ্টা আর পিঠের ওপর ধুরুম-ধারুম কিল। নাওয়া নাই খাওয়া নাই, সারাদিন ঘুড়ি আর লাটিম নিয়ে সারা গ্রাম ছুটে বেড়ানো, তারপর সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরা, এইটা ছিলো আমার সাপ্তাহিক অভ্যাস।

মানে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার, একদিনের জন্য হলেও উধাও হয়ে যেতাম আমার ঘুড়ি অথবা লাটিমকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর, সন্ধ্যায় লাফাতে লাফাতে বাড়িতে ফিরতাম। মা কিছু বলার আগেই হাত-পা ধুয়ে ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ভদ্র ছেলের মতো পড়তে বসে যেতাম। মা মাগরিবের নামাজ পড়ার পর আমার হাত ধরে টেনে আবারও টিইবওয়েলে নিয়ে যেতেন। তারপর, শরীরে সাবান মেখে এমন ডলা ডলতেন, যেন আর কোনোদিন আমাকে গোসল না করালেও চলবে।

ডলা খেয়ে আমি করতাম চিৎকার, আর আমার চিৎকারে টিউবওয়েলের পাশের পুরনো দেয়ালের পলেস্তরারাও যেন একটু একটু করে খসে খসে পড়তে চাইতো। আমার কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে, ঝিঝিপোকারাও ডেকে চলতো। কিন্তু আমার মার মুখ থেকে একটা টু-শব্দ বের হতোনা। গোসলের পর, টান মেরে পরনের ভেজা হাফপ্যান্টটা খুলে ফেলতো। তারপর, গামছা দিয়ে সারা শরীর মুছে দিতো।

তারপর, হাত ধরে টেনে নিয়ে আসতো ঘরে। তারপর, সরিষার তেল মাখানো হতো শরীরে। তারপর, সিঁথি কেটে মাথা আঁচড়ানো হতো চিরুনী দিয়ে। আর, আলনা থেকে শুকনো একটা হাফপ্যান্ট এনে পড়ানো হতো। শুকনো প্যান্টের মাঝে আমি একটা অন্যরকম গন্ধ পেতাম।

এইটা এখন পাইনা। তবে ছোটবেলায় খুব পেতাম। তারপর, আবার পড়তে বসতাম। এখনও মা কোনো কথাই বলবেনা। আমি আমার মতো করে দুলে দুলে, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে, মশা মারতে মারতে পড়তে থাকতাম।

একটু পরপর, মিনমিন করে ভাত খেতে চাইতাম। তারপর, মায়ের চোখের দিকে না তাকিয়েই আবার পড়া শুরু করতাম। আমার কাছে মনে হতো, যেন জন্মের পর থেকে পড়ছি তো পড়ছিই। আমাকে কোনোদিন খেতে দেয়া হয়নি। আমাকে কোনোদিন, আলিফ লায়লা অথবা থিফ অফ বাগদাদ দেখতে দেয়া হয়নি।

আমাকে আটকে রাখা হয়েছে, সুবিশাল টিনের চালার পুরনো এই ঘরে, হাজার বছর ধরে। হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মশা মারতে মারতে আর ঝিমুতে ঝিমুতে একসময় মুক্তি মিলতো। তারপর, কেন যেন আমার ভাত খেতে মন চাইতো না। একটু আগে ভাত ভাত করে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও, এখন মনে হচ্ছে, যদি কোনোদিন ভাত না খেতে হতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু আমার কপাল খারাপ, প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে গলা দিয়ে ভাত ভরে দিতেন মা।

চোখের জলে আমার ছোট্ট ভাতের প্লেটটা সয়লাব হয়ে যেতে চাইতো। তাতে কি? প্লেটে একটা ভাত অবশিষ্ট থাকলেও খাওয়া ছেড়ে উঠে যাবার পথ নেই। তারপর, খাওয়া-দাওয়া শেষে শুরু হতো প্রশ্ন-উত্তর আর প্যাদানী পর্ব। মা আমাকে জিজ্ঞেস করতো, সারাদিন কই ছিলাম, কেন ছিলাম, আমার মধ্যে কেন ডর-ভয় নেই, জীবনে যেই শাস্তি কল্পনাও করিনি, সেই শাস্তি ভোগ করার সাধ জেগেছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার জবাব ছিল অনেক কমন, মুখ বন্ধ করে মাথা চুলকানো।

আমার হাতটা, মাথা থেকে সরিয়ে নিয়ে শক্ত করে ধরা হতো। তারপর, আরেক হাত দিয়ে শুরু হতো কিলিং(কিল+ing)। ধুরুম-ধারুম কিলের আওয়াজে টিনের চালার পুরনো ঘরটাও যেন দাত কেলিয়ে হাসতো। আর, আমার কান্নার আওয়াজে, মশা-মাছিদের প্যানপ্যানানিও যেন বন্ধ হয়ে যেত নিমিষেই। মায়ের হাতের কিল-গুতা খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে, মায়ের গলা পেঁচিয়ে ধরেই যে কখন ঘুমিয়ে যেতাম, সে খবর কে রাখে? আমি ঘুমিয়ে যাবার পর, আমাকে মারার কথা মনে করে, অনেক রাতে আমার মা-ও কি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো নাকি? সে খবরই বা কে রাখে? আজকের এই “মা” দিবসে লিখাটা আমার মা-কে উৎসর্গ করলাম।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।