নাই
ভারত আমাদের বন্ধু প্রতিম প্রতিবেশি দেশ। তাদের সুখ দুঃখ সমস্যা আমাদের সমাজে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বর্তমানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে মাওবাদীদের দ্বন্দ চরম আকার ধারন করেছে। ভারতের বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায় সরকার আর মাওবাদীদের নানা ভুমিকা নিয়ে যথারীতি খোলামেলা বক্তব্য দিয়েছেন। সাংবাদিক কারান থাপারকে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন।
কারান থাপার : আমি আপনার সঙ্গে মাওবাদীদের সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কথা বলতে চাই, বিশেষ করে বিহারে মাওবাদীদের দ্বারা চারজন পুলিশ সদস্য অপহরণ এবং তাদের মধ্যে একজন লুকাস টেটেকে হত্যার পর মাওবাদীদের প্রসঙ্গে আপনার মনোভাব কি?
অরুন্ধতী রায় : একজনকে জিন্মি করে হত্যা কোনো বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নয়। আমি এক বিবৃতিতে বলেছি, এটা অন্ধ্র প্রদেশে পুলিশ কর্তৃক এনকাউন্টারে আজাদ হত্যার মতোই জঘন্য ব্যাপার। কিন্তু আমি ওইদিন টিভির পর্দায় যে খুব খারাপ ধরনের বিশ্লেষণ দেখানো হয়েছে সে সম্পর্কে লজ্জিত। তাদের প্রচারে একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব ছিল। কিন্তু কে যুদ্ধ চায়? কার যুদ্ধ প্রয়োজন।
কারান থাপার : গত এক বছরে মাওবাদীরা ফ্রান্সিস ইন্দুয়ার ও সঞ্জয় ঘোষের শিরশ্ছেদ করেছে। তারা লুকাস টেটেকে হত্যা করল, তারা অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের অপহরণ করেছে, তারা দান্তেওয়াদায় ভয়ংকর আক্রমণ করেছে, তারা জ্ঞানেশ্বরী এঙ্প্রেসে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে এটা কি কোনো বৈধ কৌশল বা পদ্ধতি, অথবা এর ফলে কি মাওবাদীদের গণভিত্তি হ্রাস পাবে না?
অরুন্ধতী রায় : আপনি এসব কর্মকাণ্ডের দোষ তাদের ওপর চাপাতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ, ট্রেন দুর্ঘটনার কথা বলা যায়। আমি যতদূর জানি, কারা এটা ঘটিয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি।
কারান থাপার : কিন্তু দান্তেওয়াদা শিরশ্ছেদ ঘটনা আর অপহরণের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
অরুন্ধতী রায় : বর্তমানে সেখানে যে সংঘর্ষ চলছে, তা যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। তাই আপনাকে অবশ্যই এক পক্ষের সহিংস কর্মকাণ্ডের বিপরীতে অপর পক্ষের কর্মকাণ্ডকে উপলব্ধি করতে হবে। ওই দরিদ্র গ্রামগুলোতে হাজার হাজার আধাসামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড কি গ্রহণযোগ্য? বিশেষ করে জনগণকে যেভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সঠিক কর্মকাণ্ড। আমাদের সব কিছুই পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করা উচিত, খণ্ড খণ্ডভাবে নয়।
কারান থাপার : তাহলে আপনি কি দুইপক্ষকে সমানভাবে দেখার কথা বলছেন?
অরুন্ধতী রায় : না, আমি তা বলছি না, আমি দুইপক্ষকে সমানভাবে দেখি না।
আমি স্পষ্টভাবে দেখছি, সরকার স্পষ্টত সংবিধান লঙ্ঘন করছে, লাখ লাখ আদিবাসীকে সহিংসতার সঙ্গে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তার বিপরীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, বর্তমানে ঘটনা খুবই সহিংস পর্যায়ে পৌছেছে। এর মাঝে কেউ যদি নৈতিকতা খুঁজতে চায় তাহলে সে ভুল করবে।
কারান থাপার : তাহলে এটা পরিষ্কারভাবে বলা যায়, আপনি সরকারকেই প্রথম অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করতে চাচ্ছেন। প্রথম ভুলটি তারাই করেছে।
আর তার বিপরীতে মাওবাদীরা জনগণের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছে।
অরুন্ধতী রায় : আমি সম্পূর্ণভাবে বলতে পারি, সরকারই প্রথম আগ্রাসন কারী। মাওবাদীরা পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট হয়েছে। কেননা তাদের মতাদর্শই হলো সশস্ত্রভাবে বর্তমান ভারত রাষ্ট্রটিকে উৎখাত করা। এই রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের খুব অল্পই ন্যায়বিচার পায়।
সে ক্ষেত্রে মাওবাদীরা শুধু সেই জনগণকে সংগঠিত করছে।
কারান থাপার : এখন আমরা বর্তমানের সেসব ঘটনা নিয়ে আলোচনা করি। যা এই সপ্তাহে প্রতিদিন খবরের পাতায় ছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মাওবাদীরা দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি। সে ক্ষেত্রে আপনার মনোভাব সম্পূর্ণ বিপরীত।
আপনি কিভাবে মাওবাদীদের সম্পর্কে এই উপলদ্ধিতে এসেছেন?
অরুন্ধতী রায় : আমি এই উপলব্ধিতে এসেছি কেননা মাওবাদীরা যে প্রতিরোধ যুদ্ধ শহরে, গ্রামে ও অরণ্যে চালাচ্ছে, তা ন্যায়সঙ্গত।
কারান থাপার : কিন্তু তারা কি লক্ষ্যে এগোচ্ছে?
অরুন্ধতী রায় : তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো, তারা বক্তব্যে যা বলে তা হলো এই ভারত রাষ্ট্রটি উৎখাত করা এবং সর্বহারা জনগণের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
কারান থাপার : আপনি অরুন্ধতী রায় কি এই লক্ষ্যকে সমর্থন করেন?
অরুন্ধতী রায় : না, আমি সমর্থন করি না। কেননা আমি মনে করি বিশ্ব বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে তা থেকে উত্তরণ, কমিউনিস্ট কিংবা পুঁজিবাদ কোনো ব্যবস্থাতেই সম্ভব নয়।
কারান থাপার : আমি এবার একটা স্পষ্ট কথা বলতে চাই, এতক্ষণ আপনি যে বলেছেন মাওবাদীদের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাতের যে পথ তা সমর্থন করেন না।
এর মাধ্যমে আপনি আপনার অবস্থান পরিবর্তন করছেন না, কেননা আপনি কারাগারে যাওয়া থেকে রেহাই পেতে চান।
অরুন্ধতী রায় : যদি আমি মাওবাদীদের ভারত রাষ্ট্র উৎখাতের সঙ্গে একমত হতাম তাহলে নিজেকে মাওবাদী বলে পরিচয় দিতাম। কিন্তু আমি মাওবাদী নই।
কারান থাপার : কিন্তু আপনি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
অরুন্ধতী রায় : আমি তাদের সব আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল নই।
আমি শুধু তাদের পাশেই দাঁড়াতে চাই, যারা দরিদ্র জনগণকে দমনের নামে সেনা মোতায়েনে বিরোধিতা করে, আর এটা সমগ্র বিশ্বের জন্যও প্রযোজ্য।
কারান থাপার : আপনি মাওবাদীদের মূল কর্মকাণ্ডের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু মাওবাদীরা কী পথ অবলম্বন করছে? মূল সমস্যা হলো মাওবাদীরা কোন সংবিধানসম্মত নির্বাচনে জিতে তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। তারা সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে এটি অর্জন করতে চায়। এটাই অনেকের কাছে গৃহযুদ্ধ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। আপনি কি তাদের ওই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথক?
অরুন্ধতী রায় : ইতিমধ্যেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
আমি সেই মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না যে সহিংস পথেই একমাত্র নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। আবার অহিংস পথেই তা অর্জিত হবে, তাও মনে করি না। যখন আপনার গ্রাম ৮০০ সিআরপিএফ জওয়ান দ্বারা বেষ্টিত থাকবে, যারা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেবে, লুটপাট করবে, ধর্ষণ করবে_তখন আমি অনশনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করব। এটা হাস্যকর ঠিক তখনই জনতার প্রতিরোধকে আমি সমর্থন করি।
কারান থাপার : কিন্তু রাষ্ট্র যদি আক্রান্ত হয়, জনগণ যদি আক্রান্ত হয়?
অরুন্ধতী রায় : এখানে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। রাষ্ট্র আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, রাষ্ট্র নিজেদের সংবিধান লঙ্ঘন করে আক্রমণের প্রস্তুতি চালাচ্ছে। আপনি যদি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন পড়েন, যে প্রতিবেদনের এ অধ্যায়কে সেন্সর করা হয়েছে, সেখানে পঞ্চায়েত রাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তা অনুযায়ী রাষ্ট্র বর্তমান যে পদ্ধতি নিয়েছে তা অবৈধ। আপনি জনগণের প্রতি কী পরামর্শ দেবেন যখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী, বিমান বাহিনী সবাই মিলে যুদ্ধ করতে চায়।
আপনি কি পরামর্শ দেবেন যে তাদের উচ্ছেদ হতে হবে এবং ধনী ও বহুজাতিকের কাছে খনি তুলে দিতে হবে?
কারান থাপার : কিন্তু মাওবাদীরা তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছে তা সহিংস। এটাই সমস্যা। কেননা এটা সমাধানের পথ নয়।
অরুন্ধতী রায় : আপনি আমার কথা ভালোভাবে উপলদ্ধি করতে পারছেন না, আমি বলতে চাচ্ছি এখানে অন্যায় চলছে। লাখ লাখ জনগণকে উৎখাত করা হয়েছে।
আপনি কি করবেন যখন ৮৩৬ মিলিয়ন জনগণ প্রতিদিন ২০ রুপির কম উপার্জন করে? আমরা ৬০ মিলিয়ন উদ্বাস্তু জনতার জন্য কী করতে পেরেছি। সরকার এদের উপেক্ষা করছে। গত ২৫ বছর এই উপেক্ষায় অহিংস পদ্ধতিতে মোকাবিলা করা হয়েছে।
কারান থাপার : এখন আমি আজাদের ব্যাপারে প্রশ্ন করব, মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বামী অগি্নবেশকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনা করার। তিনি মাওবাদী নেতা আজাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।
কিন্তু জুলাইয়ে এক পুলিশ এনকাউন্টারে আজাদকে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমে কি সরকার স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে।
অবশ্যই।
কারান থাপার : কেন তারা এটি করলেন? কেন তারা একজনকে হত্যা করলেন আলোচনার প্রত্যাশাকে পাশ কাটিয়ে?
অরুন্ধতী রায় : আমি কয়েক মাস ধরে বলে আসছি, সরকারের এখন যুদ্ধ প্রয়োজন। ভূমিকে পরিষ্কার করতে এবং চুক্তিগুলোকে বাস্তবায়ন করতে তার এই যুদ্ধ প্রয়োজন।
আপনি যদি ব্যবস্থা পত্রগুলো পড়েন তাহলে দেখবেন তারা এ ব্যাপারে খুবই পরিষ্কার।
কারান থাপার : যদি সরকার যুদ্ধ চায়, তাহলে আপনি সরকারের আলোচনার ইচ্ছাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এটা তো পরস্পরবিরোধী।
অরুন্ধতী রায় : হ্যাঁ, তার যুদ্ধ প্রয়োজন। কিন্তু তাকে আবার গণতন্ত্রের মুখোশ পরে থাকতে হয়। তাই তাঁরা একদিকে আলোচনার কথা বলেন, অপরদিকে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন।
কারান থাপার : আলোচনায় সরকারের অবস্থানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
অরুন্ধতী রায় : আমি আপনাকে যদি জঙ্গলে যেতে বলি তাহলে দেখবেন হাজার হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য আদিবাসী জনগণের বাসস্থান পুড়িয়ে দিচ্ছে, সার্চ অপারেশনের নামে হত্যাযজ্ঞ চলছে। একদিকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হবে, আরেকদিকে সহিংসতা চলবে_এটা অবশ্যই দ্বিমুখী স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ।
কারান থাপার : সরকার আপনাদের মাওবাদীদের সহযোগী বা দোসর হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
অরুন্ধতী রায় : সরকার এখন মাওবাদীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে তাদেরও জড়িত করছে। যারা তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করছে না।
আমার মতো লোকদেরকে দৃশ্যপটে হাজির করা হচ্ছে। এটা সহজ ব্যাপার নয়, অবশ্যই এটা আমাকে দুঃখে ভারাক্রান্ত করে না, কেননা আমি যা ভাবি তা-ই বলতে পছন্দ করি। তাই আমি আমার নাম তালিকায় দেখে চিন্তিত নই।
কারান থাপার : সরকার আপনাকে সহযোগী বলেছে এই কারণে, আপনাকে নিয়ে তারা অস্বস্তিতে রয়েছে।
অরুন্ধতী রায় : সরকার যদি আমাকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকে তাহলে আমি গর্ববোধ করব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।