"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
দিনবদলের হাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিচ্ছে
দ্বিদলীয় সংঘাতে জনগণ জিম্মি, গণদাবি চাপা পড়ছে
। । ভ্যানগার্ড প্রতিবেদন । ।
ডিসেম্বর ২০১০
গত ১৪ ডিসেম্বর আগুনে পুড়ে মরার হাত থেকে বাঁচার জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকরা এগারতলা কারখানার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ দিয়েছে। কারণ বের হওয়ার পথ বন্ধ। টিভি পর্দায় এ দৃশ্য আমরা দেখেছি। আগুনে পুড়ে আর লাফিয়ে পড়ে অসহায় শ্রমিকদের মরতে দেখে আমরা যেন দ্বিদলীয় পাল্টাপাল্টির রাজনীতির কবলে জিম্মি বাংলাদেশের অসহায় জনগণের প্রকৃত চিত্রটাই দেখলাম - একটু ভিন্নভাবে, আরো মর্মান্তিকভাবে!
বাংলাদেশ যখন বিজয়ের ৪০তম বার্ষিকী উদ্যাপন করছে তখন মাত্র ২ দিনের ব্যবধানে ৩৫ জন শ্রমিক, ৪ জন পুলিশের গুলিতে এবং ৩১ জন আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এ ঘটনায় একটি পুরনো প্রশ্নই নতুনভাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে -- স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বাংলাদেশের গরিব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্তি কী? উত্তর হল, শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন আর তিলে তিলে মৃত্যু।
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস, আনন্দ আর উল্লাসের মাস। একই সাথে বেদনা ও শোকের মাসও। রক্তস্নাত ডিসেম্বর মানেই প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসাব মেলানোর মাস। দীর্ঘ পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি আর শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্যের অমানিশা ছিন্ন করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ১৯৭১ সালের এ মাসে বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল। স্বাধীনতার সূর্যকে সেদিন কিনতে হয়েছিল লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে।
এরপর একে একে ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা বারবার প্রতারিত ও বিবর্ণ হতে হতে আজ এক অসম্ভব বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। স্বাধীনতার সূর্য সব মানুষের ঘরে আলো দেয়নি, উত্তাপ ছড়ায়নি। মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল পরিবর্তনের, দিন বদলের -- একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ এবং রাষ্ট্রের। কিন্তু মানুষের সে আকাঙ্ক্ষা শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পূরণ হয়নি।
দিনবদলের কথাটা আমরা ২০০৮ সালেও শুনেছিলাম। দীর্ঘ দুই বছরের জরুরি অবস্থা শেষে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারকে ‘দিনবদলের সনদ’ নামক একটি গালভরা শিরোনাম দিয়ে আমাদের সামনে হাজির করেছিল। এ নিয়ে নির্বাচনের আগে প্রচারমাধ্যমে ভীষণ রকমের মাতামাতি হয়েছে। নতুন সরকারকেও অনেকে দিনবদলের সরকার হিসাবে আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু গত দুই বছরের দুঃশাসন এবং নীতিআদর্শহীন বুর্জোয়া রাজনীতির দ্বিদলীয় পাল্টাপাল্টি-সংঘাত-সহিংসতা বলছে, দিনবদলের হাওয়ায় এখন তীব্র শীতের প্রকোপ, মানুষ কাঁপছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস - ঘূর্ণিঝড় সমাগত।
গণতান্ত্রিক শাসন, আইনের শাসন, জনগণের অধিকার এসব বিষয় বাংলাদেশে কথার কথা হয়েই থেকে গিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন, বেসামরিক লেবাসে সামরিক শাসন ইত্যাদি পথ বেয়ে এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের অবসানের পর আশা করা হয়েছিল যে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রতিশ্রুত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রূপ নিয়েছে দ্বিদলীয় পাল্টাপাল্টির রাজনীতিতে। শাসকশ্রেণীর নিজেদের মধ্যকার বিরোধ -- জনগণের স্বার্থে নয়, ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা রক্ষা করার স্বার্থে -- কতটা হিংস্র ও উন্মত্ত হতে পারে তার নজির আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, বিশেষত ২০০৬ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে।
এর আগে থেকেই দ্বিদলীয় পাল্টাপাল্টি ও সংঘাতের রাজনীতির অবসানের কথা নানাভাবে শোনা যাচ্ছিল। ওই বিশেষ পরিস্থিতিতেই বুর্জোয়া শাসন-প্রশাসন টিকিয়ে রাখতে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল এবং দুই বছর ধরে রাজনীতির সংস্কার, শাসন-প্রশাসনের সংস্কার, দুর্নীতির অবসান ইত্যাদি কথা দেশবাসীকে শোনানো হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনে মহা বিজয় নিয়ে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শাসনের শুরু। ইতোমধ্যে মহাজোটের ক্ষমতার দুই বছর পার হয়েছে। দ্রব্যমূল্য, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, শ্রমিক নির্যাতন, দারোয়ান থেকে সর্বোচ্চ বিচারালয়ে দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি-দখলদারিত্ব, বিদ্যুৎ সংকট, জাতীয় সম্পদ গ্যাস-কয়লা লুট, ভারতসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন -- দুই বছরের শাসনের এই হল মূল প্রাপ্তি।
দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি কি বলছে? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকারের ৫টি বিষয়ের মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ছিল পয়লা নম্বরে। ওতে বলা হয়েছিল, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে ডাল, চাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। ’ দ্রব্যমূল্য, প্রধানত খাদ্যদ্রব্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার উপায় কী? টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ)-কে কার্যকর করা, গ্রাম-শহরে রেশনিং চালু করা, খাদ্যপণ্যের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া। একথা বিভিন্ন মহল থেকে, বিশেষত বাসদ ও অপরাপর বামপন্থী দলের পক্ষ থেকে বারবার জোর দিয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেছে কি? সরকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পায়ে আত্মাহুতি দিয়েছে।
চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে ঊর্ধ্বগামী। সরকারের হিসাবেই সম্প্রতি চালের দাম প্রতি কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে। গত নভেম্বর মাসে পেঁয়াজ, আটা, মরিচ, রসুন, আলুসহ সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ১০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। মসুর ডালের দাম এখন ১২০ টাকা। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে প্রতি মাসে অন্তত ১০ শতাংশ।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর হিসাব অনুযায়ী গত ২৭ বছরে (১৯৮২-২০০৯) দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ, গত ৫ বছরে বেড়েছে ৬১ শতাংশ। সবচেয়ে বেড়েছে চালের দাম, প্রায় ৯০ শতাংশ।
মূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় শিকার দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ। তাদের মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ শুধু খাদ্যসামগ্রী কিনতে ব্যয় হয়। ক্যাব-এর হিসাব মতে এই সময়ে দ্রব্যমূল্য, বাড়িভাড়া, যাতায়াত, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৯৪ শতাংশ।
শুধু ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল এই চার বছরে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৫৫ শতাংশ, বাড়িভাড়া ৭২ শতাংশ, যাতায়াত ৬০ শতাংশ, শিক্ষাখরচ ৫৫ শতাংশ, চিকিৎসা ব্যয় ৭০ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা'র এক হিসেবে জানা গেছে শুধু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বাংলাদেশে নতুন করে ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে। এখানে একটু বলে রাখা ভাল, আরেকটি হিসাব বলছে, গত দুই বছরে দারিদ্রের মাত্রা ১ শতাংশ বেড়েছে কিন্তু এই সময়ে নতুন করে ৮ হাজার জন কোটিপতির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। লক্ষকোটি মানুষকে নিঃস্ব করে কোটিপতি বানানোর এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে শুধু নয়, আওয়ামী সুশাসনে বিপুল বেগে বেড়ে চলছে।
সিন্ডিকেট নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।
আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় আসার আগে এবং পরে অনেক হুংকার ছেড়েছিল। মানুষ ভেবেছিল, মহাজোটের মহাহুংকারে বোধ হয় সিন্ডিকেটওলারা দেশ ছেড়ে পালাবে। কিন্তু সম্প্রতি সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে যা ঘটে গেল তাতে দেখা গেল, সিন্ডিকেটের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতাও সরকারের নেই। সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি এক লাফে ১৩/১৫ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকায় উঠেছিল। কোথাও ১২০ টাকায় এক লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছিল।
এর কারণ ছিল তেল-ব্যবসায়ী চক্রের কারসাজি। সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি রোধে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না -- এ মর্মে হাইকোর্ট সরকারের প্রতি একটি রুল জারি করেছিল। সরকার কী জবাব দিয়েছিল দেশবাসী তা জানেন কি? সিন্ডিকেট আসলে সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্র ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা ওই ডাকাতদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখলাম না।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সকল মন্ত্রী ও এমপি’র সম্পদের হিসাব দাখিল করার কথা বলা হয়েছিল।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই এ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আভাস দিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, ঘোষণার বাইরে মন্ত্রী-এমপিদের কোনো সম্পদ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে শুধু পদচ্যুতি নয়, আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরেকটা কঠিন হুঙ্কার ছেড়েছেন এই বলে যে দেশে কিছু ‘বিত্তশালী রাক্ষস’ সৃষ্টি হয়েছে, এদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। গত ১৯ মাসে এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো বাক্য উচ্চারণ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখা গেল না।
গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল গত জুলাই মাসে।
সরকার বা মালিকদের সদিচ্ছা থেকে নয়, শ্রমিকদের আন্দোলনের চাপে। বাজার পরিস্থিতির কথা তো আগেই বলা হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী গত ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ। আক্রার এ বাজারে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মূল মজুরি দেয়া হল ২০০০ টাকা, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা মিলে মোট ৩০০০ টাকা। এখানেও সেই আত্মসমর্পণ, মালিকগোষ্ঠীর পায়ে! ওই বেতনকাঠামো গত নভেম্বর থেকে কার্যকর করার কথা ছিল।
কিন্তু তা তো হয়ই নি বরং নানা তালবাহানা চলছে, শ্রমিকদের নানাভাবে প্রতারিত করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করার অপরাধে(!) গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, গ্রেফতার করে, পুলিশ-মাস্তান লেলিয়ে দিয়ে হয়রানি চলছে। সিন্ডিকেট ডাকাতদের ধরতে পুলিশ-রেব-গোয়েন্দাদের দৌড় কতটুকু সেটা দেশবাসী দেখতে পেলনা। কিন্তু শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করতে বাসদ-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এবং সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামানের বাসকক্ষে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া জোরপূর্বক প্রবেশ এবং নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে তাদের তৎপরতা অভূতপূর্ব।
কৃষকদের অবস্থা কী? সার, বীজ না পাওয়ায় বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে।
বাজারে বেশি দামে সরকারি সার ও বীজ বিক্রি হওয়ায় এমনটি ঘটেছে। ভেজাল সার, ভেজাল বীজে বাজার সয়লাব, কৃষকরা প্রতারিত হচ্ছে, কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। বিদ্যুতের অভাবে ডিজেল চালিত পাম্পের মাধ্যমে সেচ কাজ চালানোয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সরকার কৃষকদের কাছ থেকে আমন ধান কেনেনি। বাজারে চালের দাম বাড়লেও কৃষক সে দাম পায়নি, পেয়েছে মধ্যস্বত্তভোগী ফড়িয়া এবং বড় বড় মিল মালিক।
নারী নির্যাতন, ‘ইভটিজিং’সহ নারীর ওপর সহিংসতা এমন মাত্রায় বেড়েছে যে আজ আড়াই বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা কেউই এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। অথচ সরকার এই ভয়ংকর অপরাধের মূলোৎপাটন করতে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সরকারের নাকের ডগায় পর্নোগ্রাফির ব্যবসা চলছে পুরোদমে। ঢাকার নীলক্ষেতের চারপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, হোমইকনোমি গার্লস কলেজসহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু নীলক্ষেত এলাকায় বছরের পর বছর ধরে পর্নো বই, পত্র-পত্রিকা, সিডি বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে।
নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীদেহের উপস্থাপন বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেই। মাদক ব্যবসায় বন্ধ করার উদ্যোগ নেই, স্কুল-কলেজ, পাড়া-মহল্লায় সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড-খেলাধুলার কোনো আয়োজন নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে হাতে গোনা কিছু অপরাধীর শাস্তি দিয়ে কি এ অপরাধের বিস্তার রোধ কিংবা কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব? কিন্তু সরকার উদাসীন।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেশে কোনো সরকার আছে বলে মনে হয় না। হত্যা, খুন, ধর্ষণ আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে।
আনজুমান-এ-মফিদুল ইসলামের হিসাব অনুযায়ী গত ২০০৯ এর জানুয়ারি থেকে ২০১০ এর অক্টোবর পর্যন্ত শুধু রাজধানীতেই পাওয়া গেছে প্রায় ২০০০ বেওয়ারিশ লাশ। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী এই সময়ে খুন হয়েছে ৭৬৩৪ জন, নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৫৫৩৮ জন। বেসরকারি সংস্থা অধিকারের মতে গত ২০০৯ এর জানুয়ারি থেকে ২০১০ এর অক্টোবর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী রেব-পুলিশের হাতে ২৫৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। সরকার নিজেই যখন খুনের দায়িত্ব নিয়েছে তখন খুন বন্ধ হওয়াটা দুরাশা নয় কি?
বিদ্যুৎ সংকট নিরসনেও এই সরকার ব্যর্থ। সরকারি হিসেবেই প্রতিদিন বিদ্যুৎ ঘাটতি গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট।
সংস্কারের অভাবে খুলনা, কাপ্তাই, ঘোড়াশালসহ বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় খাতে ৫৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত ও সংরক্ষণে কোনো নজর নেই। কিন্তু তোতা পাখির মতো বুলি একটা আছে -- সব দায় অতীত সরকারের। কিন্তু নিজেরা কি করছেন? রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, কুইক রেন্টালের নামে কুইক মুনাফার ভাড়াভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ সরকার। এর পরিণতি কী হবে? সরকার নিজেই স্বীকার করেছে যে এরকম স্বল্পমেয়াদি ও বেসরকারি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে আগামী ২-৩ বছরে বিদ্যুতের দাম ২০-৩০ শতাংশ বাড়বে।
অর্থাৎ দায় ওদের কিন্তু ভুগবে জনগণ, মূল্যও দেবে জনগণ।
দেশের জাতীয় সম্পদ গ্যাস-কয়লা প্রভৃতি লুটপাটের আয়োজনে ভাটা পড়েনি। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সাগরবক্ষের ৩টি গ্যাস ব্লক আমেরিকান কোম্পানি কনোকো ফিলিপ্স ও আইরিশ কোম্পানি টাল্লোর কাছে ইজারা দেয়ার পাঁয়তারা করে। দেশের বামপন্থী, প্রগতিশীল শক্তির নেতৃত্বে তীব্র গণআন্দোলনের এক পর্যায়ে জাতীয় কমিটির ডাকে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়েছিল। জনগণ তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনও জানিয়েছিল।
পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে সরকার কিছুটা পিছিয়ে আসে। কিন্তু সম্প্রতি আবারও সেই অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত জোটের আমলে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। গত অক্টোবরে (২০১০) জাতীয় কমিটির ঢাকা- ফুলবাড়ী লংমার্চেও এ দাবির প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থন ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু এই মতামতকে অগ্রাহ্য করে সংসদীয় কমিটি ফুলবাড়ী, দিনাজপুরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট এর নামে ভারতকে করিডোর প্রদান এবং অসম শর্তে ঋণ চুক্তিতেও দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে।
সংক্ষেপে হলেও, দেশের চিত্রটা এরকমই। জনজীবনের সমস্যা এবং জাতীয় সমস্যা সমাধানের পথ হল রাজনীতি। কিন্তু আমাদের রাজনীতি, অর্থাৎ কথিত মূলধারার বুর্জোয়া রাজনীতিতে কি এসবের কোনো আলামত আছে? প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শুরু থেকেই সংসদে সামনের সারিতে আসন, খালেদা জিয়ার মামলা, দুর্নীতির পাহাড়-প্রমাণ অভিযোগে অভিযুক্ত ‘যুবরাজ’ তারেক জিয়ার মামলা, বিএনপি নেতা-কর্মীদের মামলা ইত্যাদি নিয়েই সরব। আর ইদানিং তাদের মাতম শুরু হয়েছে খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিয়ে।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে খালেদা জিয়া দেশবাসীর কাছে ‘গৃহহীন’ হওয়ার বিচার চেয়েছেন। বিচার হিসাবে দেশবাসী দুটি হরতালও উপহার পেয়েছে। দুই দল এখন যুদ্ধংদেহী মনোভাবে পরস্পরের মুখোমুখি। বুর্জোয়া প্রচার মাধ্যমগুলো এসব বিষয়কেই প্রচারে আনছে, জনগণের মূল সমস্যা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আগুন লাগা হামীম গার্মেন্টসের শ্রমিকদের অবস্থা ছিল হয় ভেতরে থেকে আগুনে পুড়ে মর, নয়ত বাঁচার আশায় ১০ তলার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা কর।
বাংলাদেশের জনগণের অবস্থাও কি তেমন নয় -- হয় তপ্ত কড়াইতে ভাজা হও, না হলে চুলার আগুনে পোড়?
জনগণের সমস্যার ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ওইসব সমস্যা নিয়ে কেন আন্দোলন করছে না? তার কারণ, জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলন করে ক্ষমতায় গেলে তাদের পক্ষেও জনগণের ওই দাবিগুলো পূরণ করা সম্ভব হবে না। শ্রেণীভিত্তি এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে তাদেরকেও সিন্ডিকেট-মালিকগোষ্ঠীর পায়ে আত্মসমপর্ণ করতে হবে, লুটপাটের দৌড়ে নামতে হবে। কারণ এরা শোষক-লুটেরাগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। দুই শিবিরে বিভক্ত হলেও ওরা একই জাত।
বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ-লুটপাট করে গত ৪০ বছরে ওরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। শাসন ক্ষমতায় থাকা মানে ওই লুটের নেতৃত্বে থাকা। এ নেতৃত্ব সহজে ছেড়ে দেবে এমন সাধুতা ওদের কাছ থেকে যারা আশা করেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পর ভ্যানগার্ড ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সংখ্যায় আমরা লিখেছিলাম, “এদের কাছে নির্বাচনে জেতা মানে দেশটাকে লিজ নেওয়া, লিজ নিয়ে সমস্ত কিছুর ওপর নিজের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর তা বজায় রাখার জন্য বুর্জোয়াদের অপর অংশের সাথে, কখনো নিজেদেরই মধ্যে, ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া।
তাদের এই ঝগড়া জনজীবনকে অতীষ্ঠ করলেও তা বন্ধ করতে তারা রাজী নয়। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, এ ঝগড়া ১১ জানুয়ারির জন্ম দিয়েছিল, যার পরিণামে জনগণকে প্রায় দু’বছর জরুরি আইনের নিগড়ে কাটাতে হয়েছে। এখনো, কিছুটা দূরবর্তী হলেও, আমরা কি একই পরিণতি বা আরো কঠিন কিছুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? রসিকজনের ধারণা, এমনটা হলে দিনবদলের বর্তমান হাওয়া দখিনা বাতাসের বদলে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিতে পারে। ” বর্তমান পরিস্থিতি, আমাদের ওই বিশ্লেষণকেই সত্য বলে প্রমাণ করছে না কি?
৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় এটা স্পষ্ট যে, যতদিন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ শাসক বুর্জোয়াশ্রেণী এবং ওই দলগুলোর হাতে থাকবে ততদিন সংঘাতের রাজনীতির অবসান ঘটবে না, জনগণের দিনবদলও হবে না। বরং প্রতীক্ষার প্রহর আরও দীর্ঘ হবে।
বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য চাই সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে বামপন্থী শক্তির উত্থান। অতীতে বহু আন্দোলনে জনগণের শক্তি হিসেবে বামপন্থী দলগুলো আস্থার পরিচয় দিয়েছে। এখন বামশক্তিকেই জোট-মহাজোটের বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার সর্বাত্নক সংগ্রাম জারি রাখতে হবে। বাসদ, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা সে লক্ষ্যেই রাজপথে ক্রিয়াশীল। সকল বামপন্থী দল ও শক্তির দায়িত্ব হল সর্বনিম্ন কর্মসূচিতে বৃহত্তর বামঐক্য গড়ে তুলে জনগণকে সাথে নিয়ে এ ধারাকে শক্তিশালী করা।
http://www.spb.org.bd/
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।