দিনবদলের যাত্রা : সতর্কতা চাই ঘরে-বাইরে
ফকির ইলিয়াস
=======================================
দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। গঠিত হয়েছে ৩২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রীপরিষদও। বেশ চমক দেখালেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। নতুন এই মন্ত্রীপরিষদে বাদ পড়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা। বাদ পড়েছেন বেশকিছু সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।
দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেছিলেন আর রাজনীতি করবেন না। পরে তিনি তার কথা পাল্টান। বলেন, চাপের মুখে এমনটি বলেছিলেন। কিন্তু তিনি দলে বেশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কাজ চালিয়ে যান ‘মুখপাত্র’ বলে পরিচিত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
নতুন গঠিত মন্ত্রীসভায় বাদ পড়েছেন আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বেগম সাজেদা চৌধুরী, মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ আরো কিছু নেতা। দেশবাসী মনে করেছিলেন, কিছু সিনিয়র নেতার মন্ত্রীভাগ্য বোধহয় প্রসল্পু হতে পারে। না, তা হয়নি। অন্তত প্রথম দফার ৩২ জনের মধ্যে এদের কারোরই স্থান হয়নি।
ওয়ান-ইলেভেনের পর পাল্টে যায় বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ।
শুরু হয় নতুন প্রেক্ষাপট। এ সময় কঠোর হাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জিল্লুর রহমান। অভিযোগ আছে, ওয়ান-ইলেভেনের প্রণেতা সংস্কারবাদীরা আওয়ামী লীগে একটা ভাঙন ধরিয়ে ‘সংস্কার’ করতে আগ্রহী হয়ে পড়েন। এ সময় রাজ্জাক-আমু-তোফায়েল-সুরঞ্জিত (কিছু মিডিয়ার ভাষায় র্যাটস) সংস্কারবাদী বলে পরিচিতি পেয়ে লাইমলাইটে চলে আসেন। জিল্লুর রহমানের বিশেষ কৃতিত্ব এখানে, তিনি এই সংকটকে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে দলে ঐক্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন।
ওয়ান-ইলেভেনের প্রণেতাদের ‘সংস্কার’ বাস্তবায়নে ড. মুহাম্মদ ইউনুস, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, ড. কামাল হোসেন কিংবা কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমরা ব্যর্থ হওয়ার পর দুই নেত্রীই মুখ্য হয়ে ওঠেন। এর পরের ঘটনার ধারাবাহিকতা ছিল প্রায় সবাইকেই জামিনে ছেড়ে দেওয়ার পালা।
শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশের মাটিতে পা রেখেই বলেছিলেন, ‘আমি তাদের মাফ করে দিলাম। কিন্তু ভুলব না। ’ ৬ জানুয়ারি ২০০৭-এর মন্ত্রীপরিষদের তালিকা দেখে এটাই মনে হলো শেখ হাসিনা ঠিকই ভোলেননি।
একটি বিষয় স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, দিনবদলের যে খতিয়ান শেখ হাসিনা দেশবাসীকে দিয়েছেন তা মেনেই আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। আর এখন মন্ত্রীপরিষদ গঠনও সেই দিনবদলেরই একটি প্রাথমিক ধাপ বলা যেতে পারে। যারা বাদ পড়েছেন, এদের অনেকেই আগের টার্মে শেখ হাসিনার মন্ত্রীপরিষদে ছিলেন। তাদের বেশ ক’জনের বিরুদ্ধে নানারকম দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ১৯৯৬-২০০০ সালের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের পর এর সহৃত্র ধরেই আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়।
সে মামলাগুলো এখনো আদালতে বিচারাধীন। শেখ হাসিনা সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আপাতত মনে হচ্ছে।
একটি কথা মানতেই হবে, পনেরো কোটি মানুষের বাংলাদেশে অনেক মেধাবী রাজনীতিকই রয়েছেন। তাদেরও সুযোগ দেওয়া উচিত। বিশ্বের রাজনীতির অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।
এই বাস্তবতা না মানলে দিনবদলের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। শেখ হাসিনা সে কথা মনে রেখেই এগিয়েছেন। যারা প্রবীণ, তারা সংসদে থেকে নানাভাবেই নবীন মন্ত্রীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। দেশসেবাই যদি মূল লক্ষ্য হয়, সেখানে মন্ত্রীর চেয়ার কখনোই কোনো ফ্যাক্টর হতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, জিমি কার্টার কিংবা ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর বিশ্বমানবতা, বিশ্ব পরিবেশের পক্ষে যে পরিশুদ্ধ কাজ করে যাচ্ছেন, তা যে কোনো দেশের নেতাদের পাথেয় হতে পারে।
এবার মন্ত্রীপরিষদে যারা স্থান পেয়েছেন, তাদের অনেকেরই মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা না থাকলেও রয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা। সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ূয়া, আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম নাহিদ, এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, তারা অনেকেই উঠে এসেছেন প্রত্যন্ত জনপদ থেকে। সঙ্গত কারণেই দেশের পোড়-খাওয়া মানুষের চাওয়া তাদের কাছে অনেক বেশি। প্রত্যাশা করছি, গণমানুষের সেই চাওয়াকে সর্বশক্তি দিয়ে তারা কাজে লাগাতে ব্রতী হবেন। পূরণ করতে পারবেন এই প্রজন্মের স্বপ্ন।
বাংলাদেশের মন্ত্রণালয় হচ্ছে ৪৬টি। প্রধানমন্ত্রীসহ শপথ নিয়েছেন মাত্র ৩২ জন। তাই অদূর ভবিষ্যতে আরো মন্ত্রী নেওয়া হবে সে প্রত্যাশা করাই যায়। সে সময় জাপার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জাসদের হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননসহ আরো কিছু মুখ মন্ত্রী পেতে পারেন এমন গুঞ্জন আছে। মন্ত্রী মর্যাদায় আরো কেউ কেউ উপদেষ্টাও হতে পারেন।
একটি কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে, জামায়াত-জাতীয়তাবাদী চক্র দেশে যে জাল বিস্তার করার চেষ্টা করেছিল তা ছিন্নবিছিন্ন না হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জেতা তো দূরের কথা, অংশই নিতে পারত না। সে অবস্থার অবসান হয়েছে ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে। আর এই ওয়ান-ইলেভেন অনেককেই সম্মুখীন করেছে কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষায়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা পুরস্কৃত হবেন এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। যারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন, তাদের মনে রাখতে হবে দলীয় অঙ্গীকারগুলো।
স্মরণ রাখতে হবে, কোনোভাবেই যেন তারা মানুষকে দেওয়া ওয়াদাগুলো ভঙ্গ না করেন। না হয় তাদের পরিণতিও হতে পারে অনেক সিনিয়রের মতো। রাজনীতিতে নতুনের অবগাহন না থাকলে রাষ্ট্রে নবপ্রাণের স্পন্দন আসে না। ২০২১ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে তাই সিংহভাগ নতুন মন্ত্রীর শুভযাত্রাকে স্বাগত জানাতেই হয়। শেখ হাসিনা অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে শুরু করেছেন তার এবারের ক্ষমতার যাত্রা।
তিনি তা সমুন্নত রেখে এগিয়ে যাবেন বলেই বিশ্বাস। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ দুষ্টদ্বচক্র সম্পর্কেও সজাগ থাকতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। কারণ, কর্মের পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
------------------------------------------------------------
দৈনিক সমকাল। ঢাকা।
২৩ জানুয়ারি ২০০৯ প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।