আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিনবদলের সংস্কৃতি / রফিকউল্লাহ খান

আমার ভাল লাগার জগৎ শিল্প, সাহিত্য সংস্কতি। এবং সবার উপরে দেশ।

দিনবদলের সংস্কৃতি রফিকউল্লাহ খান একটি জাতির আত্ম-আবিষ্কার ও আত্মবিকাশের প্রধান অবলম্বন তার সংস্কৃতি। যদিও বর্তমান বিশ্বে জাতি বা নৃগোষ্ঠীভিত্তিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য নানা কারণে বিপন্ন। পুঁজিনির্ভর সভ্যতার ক্ষমতা বিস্তারের আগেও যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছিল না, তা বলা যাবে না।

শক্তিমান বলদীপ্ত সংস্কৃতিগুলো কিভাবে কোনো ভূ-খন্ডের সমৃদ্ধ লোকায়ত সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ কওে কিংবা উভয়ের মিশ্রণে একটি সৃষ্টিশীল রূপ পায়, মধ্যযুগের ভারতবর্ষ তার প্রমাণ। দীর্ঘকাল প্রচলিত ‘লোকায়ত’ শব্দবন্ধের সঙ্গে এ যুগের বহুল আলোচিত প্রপঞ্চ ‘নিম্নবর্গে’র মধ্যে সাধর্ম্য নির্মাণ করতে যথেষ্ট যুক্তি দাঁড় করানো যেতে পারে। কিন্তু পৃঁজি যখন অস্ত্রশক্তি অপেক্ষা বলদীপ্ত চরিত্র নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় কেন্দ্রগুলোকে গ্রাস করতে শুরু করে তখন থেকেই মানবসংস্কৃতির পুরো অবকাঠামো অস্থির হয়ে উঠে। ব্যক্তিমানুষের স্বাস্থ্যেও একটা নিরূপিত মানদণ্ড রয়েছে। শরীরের ভেতর-বাইরের উপকরণ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর সহজাত প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হলে কেবল স্বাস্থ্যহানি নয়, মানুষের মৃত্যুও ঘটতে পারে।

একটি সমাজ বা জাতির স্বাস্থ্যের জন্যও এই সহজাত স্বাভাবিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্রাজ্যলোভী শক্তিগুলো সভ্যতার বিভিন্ন স্তওে কত সমাজ বা জাতিকে যে স্বাস্থ্যহানি কিংবা মৃত্যুও মুখে ঠেলে দিয়েছে, ইতিহাস বেত্তারা তার অল্পই লিপিবদ্ধ করতে পেরেছেন। ইতিহাসবেত্তারা সভ্যতার সেই স্তরের পথিক- যেখানে শিক্ষার সঙ্গে শক্তির সম্পর্ক নিবিড়। পৃথিবীর অনেক সভ্যতারই ইতিহাস নেই। তার কারণ, সেখানে তথ্য লিপিবদ্ধ করার মতো জ্ঞানি জন্ম নেয়ার আগেই সেগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে।

অথবা বলা যায়, ঐসব আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে ছিলনা কোনো ভাড়াটে লেখক বা জ্ঞানী। বিভিন্ ভূ-খন্ডের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে সংস্কৃতির একটা পরিকাঠামো মাত্র পাই- জীবন ও জীবিকার বহুস্তরীভূত জগতের সন্ধান পাই না। ‘বাঙালির কোনো ইতিহাস নেই’- বলে খেদোক্তি করেছিলেন উনিশ শতকের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম আস্থাভাজন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেটাও তিনি ভালোই বুঝেছিলেন। এবং নিরাপদ সাহিত্য-আঙ্গিকে ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করেছিলেন।

সে ইতিহাস বাঙালির না হলেও ভারতবর্ষের। এবং বাঙালি জীবনের যে স্তরে এসে তাঁর ইতিহাস কল্পনার গতি থেমে যায় তাহলো আগমনকে বিধাতার আশীর্বাদ হিসেবে মেনে নেয়া। বঙ্কিমচন্দ্রেও কালে ভারত ভূ-খন্ডের সর্বকালে সেরা গণজাগরণ ‘সিপাহি বিপ্লব’ সংঘটিত হয়। ইতিহাসের সেই গতি ও শক্তির বিবরণ উনিশ শতকের নবজাগরণের পন্ডিতবর্গ লিপিবদ্ধ করেননি। ১৭৫৭ সালের ঘটনাপ্রবাহকে ইংরেজরা যেমন অপব্যাখ্যা করেছে তাদেও ভাড়াটে ইতিহাসবেত্তাদের দিয়ে তেমনি বাঙালি লেখকরাও সে ইতিহাস উপস্থাপনে বিপরীত দিকে আতিশয্যেও চরম সীমায় পৌঁছে গেছেন।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্য অনুসন্ধানে দীর্ঘকালের অবিশ্বাস্য নীরবতা কেবল বিস্ময়কর নয়, আত্মবিনাশীও বটে। ইতিহাস চর্চা অসুস্থ হলে কেবল একটি ভূখন্ডেরই স্বাস্থ্যহানি ঘটে না, তার অন্তর্গত জাতিগোষ্ঠীগুলোও গভীর সঙ্কটে নিক্ষিপ্ত হয়। বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে যে মহাদুর্যোগ, তার কারণ ইতিহাস চর্চার অসঙ্গতি এবঙ সাংস্কৃতিক আত্ম-আবিষ্কাওে অনীহা। বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি যে কোনো কালেই স্বচ্ছ প্রকৃত সত্য সন্ধানী ছিল না, উনিশ শতক থেকেই তার সূত্রপাত। আর রাজনীতির জন্ম তো আরো পরে।

আজকের যুগের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর বৈশ্বিক সমরূপতার তত্ত্ব মষড়নধষ যবমবসড়হরুধঃরড়হ কিংবা বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর পুঁজিশক্তির অনায়াস বিচরণ সে যুগে ছিল না। তারপরও ভারতের ভাষাভিত্তিক জাতিগুলোর মধ্যে সমৃদ্ধতম বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি স্বাস্থ্যকর রূপ লাভ করতে পারেনি। একটি উপনিবেশিত (পড়ষড়হরুবফ) সমাজের ধর্ম-বর্ণ-স¤প্রদায়ের মধ্যে অস্তিত্বের প্রশ্নে ঐক্য থাকা স্বভাবিক। কিন্তু বিভেদেও জাল বিস্তৃত হয় পুঁজিশক্তির মাধ্যমেই। প্রথম পর্যায়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্য পুঁজি (গধৎপযধহঃরষব পধঢ়রঃধষ) এবং পরবর্তী পর্যায়ে ব্রিটিশ রাজশক্তির শিল্পপুঁজির(ওহফঁংঃৎরধষ পধঢ়রঃধষ) হাতছানি অভিন্ন রূপ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কগত দুরত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হলো।

এই দুরত্বের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালি জাতি। তার পূর্বে পশ্চিমের খন্ডায়ন ঘটেছে। এবং সাম্রাজ্যবাদী খেলায় একটা ংবপঁষধৎ জনসাধারণের কাঁধে ধর্মনির্ভর রাষ্ট্র চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকায়ত জীবনের ঐক্য চেতনায় অনেকটা জাতিস্মরের মতোই তেইশ বছরের অব্যাহত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর রচনা কওে বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সংস্কৃতির শক্তি কত বিপুল ও সুদূরপ্রসারী ভাষা আন্দোলন তার প্রমাণ।

বাঙালির আত্মরক্ষার সবচেয়ে বড় শক্তি-উৎস এখন তার সংস্কৃতি। পুঁজি, তথ্য প্রযুক্তি ও বিনোদন সংস্কুতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের মধ্যে শরীরের রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী। পরিবর্তনের ধারাকে অস্বীকার করা চরম কূপমন্ডুকতা। বিশ্বগতির সমান্তরাল হতে না পারলে ধ্বংস অনিবার্য। সেইসঙ্গে নিজের সংস্কুতিকেই করতে হবে শক্তিকেন্দ্র।

রাষ্ট্র প্রধান-সরকার প্রধান থেকে শুরু করে প্রতিটি বিবেচক মানুষেরই উচিৎ হবে আত্মসমীক্ষার পথে চলা। কেননা, এই একবিংশ শতাব্দীর শূণ্য দশকের অন্ত্যে দাঁড়িয়েও বাঙালির সঙস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির অনুধাবন নানা কারনে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নে পরিণত হয়েছে। উপনিবেশিত সমাজের জটিল বাস্তবতায় গড়ে উঠা বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষায়িত ব্যাখ্যা যে বহুলাংশে আরোপিত ছিল তাকে নির্দ্বিধায় প্রমাণ করার মতো উপাত্ত জ্ঞানের প্রায় প্রতি শাখার পন্ডিতদের হাতে রয়েছে। আত্মগরিমা এবং অহমিকা জাগানিয়া রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ঘটনাকে বড় ধরনের ‘অর্জন’ মনে করার প্রবণতাও আমাদেও বৈশিষ্ট্য। বাঙালির শক্তি ও শক্তিহীনতার, অতি-আবেগ ও আবেগহীনতার সঙ্গে আত্মসমীক্ষা ও আত্ম-উত্তরণে বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব জাতি হিসেবে পশ্চাদপদ অবস্থানের দিকেই নিক্ষেপ করেছে।

বিশ্ব বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য এই স্বভাবধর্ম যতোটা ক্ষতিকর, প্রতিযোগিতামূলক গতিশীল বিশ্ব পটভূমিতে তা কয়েক লক্ষ গুণ বেশি ক্ষতিকর। একদিকে বিশ্বায়নের চাপ- পুঁজির আধিপত্য এবং বিনোদন সামগ্রীর সহজলভ্যতা, অন্যদিকে ধর্মান্ধ শক্তির আত্মঘাতী অতৎপরতা এই দুই শক্তির সঙ্গে সমান্তরাল যুদ্ধ সম্ভব নয়। মৌলবাদেও মন মধ্যযুগের অন্ধকাওে আর তাদেও অপক্রিয়ায় বিশ্বায়নলব্দ প্রযুক্তি, বুদ্ধি অনায়াসে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কারণে একালের বাঙালিকে হতে হবে সম্মুখবর্তী। তার অস্বিত্বেও শেকড় থাকবে লোকায়ত জীবনের ঐক্যের গভীরে।

ঐক্যে ফাটল ধরার অর্থ হলো ঐ ফাটলে মৌলবাদের রক্তবীজ ঢুকে যাওয়া। নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বে পুঁজি সবচেয়ে শক্তিমান । সাম্রাজ্যবাদ তাকে কতকাল নিযন্ত্রন করবে সেটাই বিবেচ্য। তার প্রবাহ বহুগামী হতে বাধ্য। সেই প্রবাহকে ধারণ করার জনশক্তি বাঙলাদেশের রয়েছে ।

এরপথ ধরেই এদেশে বিস্তার লাভ করতে পারে বহুকাঙ্খিত দিন পরিবর্তনের সংস্কৃতি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.