শওগাত আলী সাগর
১.
‘ওয়াজ দ্যাট অ্যা ওয়ার অর সিভিল ওয়ার ?’ – আচমকা প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আমি ও সেরীন দুজনেই ওর মুখের দিকে তাকাই। মুখের ভাব দেখে বুঝার চেষ্টা করি আসলে মেয়েটা কি বলতে চাইছে। কিন্তু আমাদের কারো কাছ থেকেই তাৎক্ষনিক কোনো জবাব না পেয়ে খানিকটা যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠে সে।
- ‘আই ওয়ানটেড টু নো, ওয়াজ দ্যাট অ্যা সিভিল ওয়ার অর ওয়ার ?’ স্পষ্ট করে উচ্চারন করে সে।
এবার প্রশ্নটা পরিষ্কার হয়ে উঠে আমাদের দুজনের কাছেই। গ্রেড ওয়ানে পড়ুয়া মেয়েটি ঠিক কি বললে সহজে বুঝবে তা ভাবতে খানিকটা সময় নেই আমি। ততক্ষণে সেরীন বলতে শুরু করে - ‘দ্যাট ওয়াজ অ্যা ওয়ার। লিবারেশন ওয়ার। ’
- ‘দ্যাট ওয়াজ অ্যা ওয়ার, নট সিভিল ওয়ার !’- যেন আপনমনেই প্রশ্ন করে বর্ণমালা।
কিংবা স্বগতোক্তি ।
সাড়ে ছ বছর বয়সী এই মেয়েটিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে বুঝাবো তা নিয়ে খানিকটা ভাবনায় পড়ে গেলাম।
বাংলাদেশ আর্টস এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে উন্মুক্ত ম্যুরালে ছবি আঁকার কর্মসূচী নিয়েছে। ছবি আঁকবে শুধু ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা। দেয়ালে বিশাল ক্যানভাস।
বাচ্চাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে রঙ তুলি। তারা তাদের মনের খেয়াল মতো যা খুশি আঁকবে ওই ক্যানভাসে। প্রোগ্রামটা যেহেতু বিজয় দিবসে ফলে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বাংলাদেশের একটা প্রতিফলন এতে ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। সেই ছবি আঁকার আনুষ্ঠানে বর্ণমালাকে নিয়ে যাবো আমি। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের গৌরবগাথার একটি দিন বলে কথা।
আমার মনে চাপা একটা কৌতূহলও ছিলো। অংশগ্রহনকারী হিসেবে যাদের ভাবা হচ্ছে এদের প্রায় সবারই জন্ম এই কানাডায়। তাদের কাছে তো নিজের দেশ মানেই কানাডা। বাংলাদেশ তাদের কাছে ভিন্ন কোনো দেশ। বাবা –মার দেশ- সেটিও তাদের জানা।
কিন্তু ‘কানাডা ডে’ তাদের কাছে যতোটা আপন, বাংলাদেশের বিজয় দিবস কি তাদের ততোটা টানবে ?
বর্ণকে কথাটা বলতে সে রাজি কি নারাজি ঠিক বোঝা গেলো না। ভাবলাম, অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে বিষয়টা সম্পর্কে তাকে একটু ধারনা দেওয়া ভালো। সেরীনই শুরু করলো । জানো মাম্মা, আজ বাংলাদেশের স্পেশাল একটা দিন।
- কেন স্পেশাল ? কিভাবে স্পেশ্যাল ?- প্রশ্নটা যেন ঠোটের কোণায় জমা হয়েই ছিলো।
- আজ বাংলাদেশের বাংলাদেশের মানুষের আনন্দের দিন। আমাদের বিজয় দিবস । ডে অব ভিক্টোরি !
ঠিক এই পর্যায়ে আচমক প্রশ্নটা ছুড়েঁ দেয় সে - ওয়াজ দ্যাট অ্যা সিভিল ওয়ার অর ওয়ার ?
২.
‘ওয়ার’টা যেহেতু তার মাথায় এসেছে যুদ্ধ দিয়েই শুরু করে সেরীন। ‘জানো বাংলাদেশের মানুষগুলোর উপর রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়েছিলো পাকিস্তানীরা। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষগুলোও বা ছাড়বে কেন? তারাও রুখে দাড়ায়।
যুদ্ধ হয়, তুমুল যুদ্ধ, তারপর বাংলাদেশের মানুষেরা জিতে যায় সেই যুদ্ধে। ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে সেই দিন,যেদিন বাংলাদেশের মানুষগুলো জিতে গিয়েছিলো।
-ওয়াও! বাংলাদেশ ইজ অ্যা উইনিং কান্ট্রি ! ইউ পিপলস আর উইনার !
- হ্যাঁ, আজ তারই সেলিব্রেশন ! সেলিব্রেশন অব ভিক্টোরি !
এবার নড়েচড়ে ওঠে বর্ণ। আই উইল বি হ্যাপি টু সি দ্যা সেলিব্রেশন মা। - জবাব দেয় বর্ণ।
সেরীন বললো- তুমি ইচ্ছে মতো যা খুশি আঁকতো পারো সেখানে।
- আমি কি বাংলাদেশকে আঁকতে পারি?
- হ্যাঁ পারো ।
আমরা জানি বর্ণর কাছে বাংলাদেশ মানেই হচ্ছে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা। কোথাও জাতীয় পতাকার ছবিটা দেখলেই সে বলে ওঠে ‘লুক বাবা। দ্যাটস বাংলাদেশ।
’
৩. ড্যানফোর্থে এসোসিয়েশনের অফিসটা জমজমাট। সারাদিন ধরে অঝোরে বরফ ঝড়ছে। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের শূণ্য ডিগ্রীর নীচে। এই আবহওয়ায়ও ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি বেশ। সাতসূরের শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনের পর বিশাল ক্যানভাসটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ছবি আঁকার জন্য।
দশজন করে একেকটি গ্রুপ করে হাতে হাতে রঙ তুলি ধরিয়ে দেওয়া হয়। বর্ণ প্রথম দশজনের দলটির মধ্যেই ঢুকে পড়ে।
আমি সারিবদ্ধ লাইনে দাড়ানো ছেলে মেয়েদের দিকে তাকাই। এদের অধিকাংশেরই জন্ম এই কানাডায়। আমার মেয়েরও।
এরা কানাডীয়ান নাগরিক, তবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এঁরা এসেছে বাংলাদেশের বিজয় দিবস উদযাপন করতে। বাংলাদেশকে নিয়ে ছবি আঁকবে এঁরা।
আমি ক্যানভাসের ওপর চোখ রাখি। আশ্চর্য! প্রায় সবক’টি ছেলে মেয়েই আঁকছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
তাহলে কি এদের সবার কাছেই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা মানেই বাংলাদেশ ? যেমনটি বর্ণের কাছে ! আমি বর্ণের দিকে তাকাই। আপন মনে ছবি আঁকছে সে। চোখে মুখে গভীর মনোযোগের ছাপ। হ্যাঁ সেও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাই আঁকছে। ছবিটা আঁকা শেষ করে বর্ণ আমার কাছে এসে দাড়ায়।
আমি তাকে রঙ তুলি ফেরত দিতে বলি। কিন্তু সে দিকে তার মনোযোগ নেই। আমার গা ঘেষে দাড়িয়ে ফিস ফিস করে সে বলে বাবা, ‘আমি আরো একটি ছবি আঁকতে চাই। ’
আমি জানি, লাইনে আরো ছেলে মেয়েরা অপেক্ষায় আছে। প্রত্যেকের একটি করেই ছবি আঁকার কথা।
‘আমাকে আরো একটি ছবি আঁকতে হবে বাবা’- বলেই ক্যাভাসের সামনে গিয়ে দাড়ায় সে। তুলিতে রঙ মাখিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করে। একটু আগে সে বাংলাদেশের যে পতাকাটি একেঁছিলো ঠিক তার পাশেই আরেকটি ছবি আঁকে সে। আমি তাকিয়ে থাকি কি দ্রততায় তুলির আচড়ে ম্যাপল পাতাকে ফুটিয়ে তুলছে সে ক্যানভাসে। কানাডার জাতীয় পতাকার ছবিটা শেষ করে নীচে নিজের নাম লিখে ‘বর্ণমালা’।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।