সুখে থাকতে ভুতে কিলায়, কথাটা প্রাচীন প্রবাদ। কিন্তু কাউকে সুখে থাকতে দেখলেও ইদানীং অনেকে ভুতের কিল খায়, কেন খায় জানি না। বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বলদ প্রকৃতির পাঠকদের জন্য আমার এই লিখা নহে। বিশ্লেষণে অ্যালার্জি থাকলে বা বুঝতে প্রবলেম হইলে মুড়ি খান, আপনি এখনো রাজনীতি বুঝেন না, পোলাপান মানুষ।
প্রথমেই শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরকে যদি টাইমফ্রেমে বিভিন্ন সেগমেন্টে ভাগ করি, তাহলে শুরু করতে হয় ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ থেকে ১৫, ১৫ থেকে ২১ এবং ২১ থেকে বর্তমান।
৫ তারিখ কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা দিলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হল। উল্লেখ্য একই অপরাধে এর আগে বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। সুতরাং এমন রায়ে খুশি হতে পারলো না কেউই। সরকার নাটকীয় ভাবে এই রায়ের বিপক্ষে অভিনয় করে যেতে লাগলো, অনেকটা এমন যে তারা প্রমান করতে চাইছে এই ট্রাইব্যুনালের উপর তাদের বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ নেই। জামাত শিবিরও এই রায় মানে না, কারন তারা চায় কাদের মোল্লা সহ তাদের সমস্ত নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি।
আবার সাধারণ জনগণও এই রায় মানতে নারাজ, কারন একই অপরাধে একজনের ফাঁসি আর আরেকজনের যাবজ্জীবন হতে পারে না। পরবর্তীতে এই ঘটনার জের ধরে কতিপয় ব্লগারের আহবানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে শাহবাগ এলাকায় অবস্থান নেয়। শুরু হয় আন্দোলন। এই আন্দোলনের একটাই দাবী ছিল সেটা হচ্ছে সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত করা। পরবর্তীতে যদিও আরও কিছু দাবী এর সাথে যুক্ত করা হয়।
আম জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ১৫ তারিখ পর্যন্ত বীর দর্পেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। মনে রাখা ভাল এই আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থায় বর্তমান সরকারের কয়েকজন বলিষ্ঠ নেতা গনমঞ্চে উঠতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। জনরোষ তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল।
১৫ই ফেব্রুয়ারি সম্মুখসারির ব্লগারদের একজন থাবা বাবা ওরফে রাজীব হায়দার শোভন নিজ বাসার সামনে খুন হন, অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা তাকে নির্মম নৃশংসতায় হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। শাহবাগ আন্দোলনে নেমে আসে নতুন ক্রোধানল।
রাজীবের লাশ নিয়ে আসা হয় উত্তাল জনতার ভিড়ে, জানাজা দেয়া হয় সমগ্র প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকারীদের উপস্থিতিতে। কিন্তু ইতিমধ্যেই থাবা বাবার পূর্ব প্রচারিত লেখা ও ব্লগগুলো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে ছড়িয়ে দেয়া হয়। বলা বাহুল্য, থাবা বাবা একজন স্বঘোষিত নাস্তিক ছিলেন এবং অত্যন্ত নিকৃষ্ট ভাষায় তিনি ইসলাম ধর্ম, আল্লাহ্, রাসুল (সঃ) ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কটূক্তি করেন। ফলশ্রুতিতে থাবা বাবা জনসাধারনের সহানুভূতি হাড়িয়ে উল্টো ধর্মপ্রাণ মানুষের রোষানলে পতিত হন এবং অন্যান্য ব্লগারদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে। আমার দেশ সহ আরও দু একটি পত্রিকা থাবা বাবার লেখাগুলো তাদের দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করে।
যার ফলে সমগ্র দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে, নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে অবমাননা করার শাস্তি দাবী করে শুরু হয় নতুন আন্দোলন। এর মধ্যে সমমনা ১২ ইসলামী দল একজোট হয়ে হরতালের আহবান জানায়। ইতিমধ্যেই ১৯ জন ব্লগারের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সরকার আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ করে গ্রেফতারের পায়তারা শুরু করে, এবং জামাত শিবিরের রাজনীতি করার অধিকার নিষিদ্ধ করার দাবী আরও ত্বরান্বিত হয়।
১৫ই ফেব্রুয়ারির পর সম্মুখে নেতৃত্বদানকারী ব্লগারদের দলের প্রস্থানের সুবাদে ছাত্রলীগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন সম্পূর্ণ রূপে কুক্ষিগত করতে সক্ষম হয়, যেটা ২১শে ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশ দেখলেই বোঝা যায়।
২১শে ফেব্রুয়ারিতে তাদের মহাসমাবেশের মাধ্যমে তারা পরবর্তী কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের ইতি টানে। ২২শে ফেব্রুয়ারির হরতালের পর সেদিন রাত থেকে আবার শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচী শুরু হয়, যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান।
আঞ্চলিক একটা প্রবাদ আছে, চোরেরে কয় চুরি কর আর গেরস্থরে কয় সজাগ থাক। থাবা বাবা সহ অন্যান্য নাস্তিকদের নেতৃত্ব নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে আন্দোলনের কৃতিত্ব পুরোপুরি ছাত্রলীগ নিয়ে নেয়। তোতা পাখি হব না, এরূপ চরিত্রের নেতাদের নেতৃত্ব মানি না, এই টাইপ কথা আমি নিজেও এক সময় বলছিলাম।
অথচ কখন যে নিজেই তোতা পাখি বনে গেলাম সেটা টেরও পেলাম না। একটা প্রশ্ন যদিও সেই প্রথম থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, থাবা বাবাকে মেরে কার সবচাইতে বেশী ফায়দা হাসিল হতে পারে। জামাত শিবিরের প্রতি সবার সন্দেহ যেহেতু বেশী, সুতরাং তাদের কি লাভ হতে পারে এটা চিন্তা করলাম প্রথমে। কিন্তু কিছুই পেলাম না। কারন জামাত শিবির ধর্মকে ভালবাসে না, বরং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, থাবা বাবা বা অন্য যেই হোক, ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করা নিয়ে এদের কিছুই আসে যায় না।
তাকে বাঁচিয়ে রেখে তার লেখাগুলো ছড়ালে বরং লাভ হত বেশী। এরপর মনে হল থাবা বাবার ব্যক্তিগত শত্রুও থাকতে পারে, যে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিএনপি বর্তমানে একটি অসাড় রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে ধরে রেখেছে। তারাও আছে বিপদে, জামাত শিবিরের সঙ্গ ত্যাগ করতে পারছে না নৈতিকতার কারনে, আবার তাদের প্রতি মৌন সমর্থন দেয়ার কারনে তাদের প্রতিও সাধারণ জনগণ রুষ্ট হয়ে আছে। এরপর চিন্তা করলাম, ইসলাম বিদ্বেষী লেখাই কি থাবা বাবা হত্যার মূল কারন? কিন্তু তার লেখাগুলো তো বেশ পুরনো।
ইসলাম বিদ্বেষী লেখার কারনে খুন হয়ে থাকলে আরও আগেই হতে পারতেন। শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলাম সরকারী দলের কোন স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে কি না। যে বিশ্লেষণটি বের হল তাতে দেখা যায় রাজীব হায়দারের খুনের ঘটনায় সরকারই সবচাইতে লাভবান হয়েছে। প্রথমত জামাত শিবিরের ঘাড়ে দায় চাপানো ও তাদের রাজনৈতিক অধিকার নিষিদ্ধ করা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পায়তারা, পড়ন্ত আন্দোলনকে আবার সচল করা অনেকটা তুষের আগুনে পেট্রোল ঢালার মত, আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক অর্জন হল প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজেদের করায়ত্ত করা। আরিফ জেবতিকের ব্যাপারে যতদূর জানি, তিনি নাস্তিক নন।
এছাড়াও নেতৃত্বদানকারী বাকি ব্লগারদের সবাই যে নাস্তিক ছিল এটা আমার মনে হয় না। কিন্তু তাদের সবাইকে একত্র করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দিয়ে সরকার নিরাপত্তার নামে বরঞ্চ তাদেরকে শনাক্ত করার বিষয়টি সহজ করে দিয়েছে। যার কারনে তারা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে আন্দোলনের পিছনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে টানা হেঁচড়ার নাটক করে তার পত্রিকায় বিষয়গুলো ফলাও করে ছাপানো হয়েছে। আর এই পুরো নাটকটি এতো চমৎকার ও নিপুণতার সাথে পরিচালনা করা হয়েছে যে জন সাধারণের বোঝার উপায় নেই, কারন রাজনীতিতে আবেগের কোন মূল্য নেই কিন্তু আবেগকে কাজে লাগিয়ে অনেক বড় কিছু অর্জন করা যায়।
সরকার এই সুযোগে আইন সংশোধন করল, হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনগণের চোখে ধুলো দিলো, কিছু সস্তা জন সমর্থন আদায় করলো ইত্যাদি। সংখ্যা গরিষ্ঠতার কারনে বর্তমান সরকার চাইলেই কিন্তু জামাত শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে পারে, ইচ্ছে মত আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু তারা জানে, ক্ষমতা চলে গেলে তাদের তৈরি করা আইনের কারনে তারাই বিপদে পড়বে। একারনে তারা চাইছে যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় আবার আসতে। তাই জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগুলোকে আবার কলা-মুলোর মত ব্যবহার করে যাচ্ছে।
তবে এই নাটকটির আয়োজনের জন্য এই সরকার আসলেই অস্কার পাবার যোগ্য। ভেবে পাই না এরা কিভাবে এতো সুন্দর একটি নাটক প্রণয়ন করলো আর সাধারণ মানুষও কিভাবে এই নাটককে সফল করার পেছনে উঠে পড়ে লাগলো!!! এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে সাধারণ জনগণ কবে, কিভাবে জেগে উঠবে এখন সেটাই দেখার বিষয়। একাত্তরের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বর্তমান সরকার যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ওদের ডেকে জিগ্যেস করি, ভাই একাত্তরের চেতনা জিনিষটা কি? এই চেতনাই কি শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারির কারন? এই চেতনাই কি সাগর-রুনির খুন হবার কারন? এই চেতনাই কি হলমার্ক, পদ্মা সেতু দুর্নীতির কারন? কষ্ট পাই এই কথাগুলো বললেই একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ছাগু বা রাজাকার নামে সম্বোধন করে। করুক, তাতে কিচ্ছু আসে যায় না।
আফসোস সেই দিনটির জন্য যেদিন তারাই নিজেদের কপাল থাপড়ে কাঁদবে।
এডিটেডঃ আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে ভুলে গেছি। সেটি হল সরকার কিন্তু এই এক ঢিলে ব্লগারদেরকেও জনরোষে ফেলে দিয়েছে। ব্লগারদের মুক্তচিন্তা ও তা প্রকাশ করার ক্ষমতা এখন রীতিমত হুমকির মুখে। জনসাধারণের কাছে ব্লগার মানেই নাস্তিক।
বলে রাখি আমি একজন গর্বিত মুসলিম, নাস্তিক নই। কিন্তু এখন নিজেকে ব্লগার হিসেবে বাইরে পরিচয় দিতে ভয় হয়। তাই সকল ব্লগারের কাছে অনুরোধ, আপনারা নিজেদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করবেন না। মতাদর্শের ভিন্নতা থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা যেন কারো ক্ষতির কারন না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।