* আমি খুজে বেড়াই নিজেকে *
আমার বাবা, তিনি চাকুরি করতেন রাষ্ট্রা্য়ত্ব ব্যাংকে। জনতা ব্যাংকে। পাকিস্তান আমলেই তিনি ইউনাটেড ব্যাংকে একজন সামান্য টাইপিষ্ট হিসেবে চাকুরী শুরু করেন। তিনি শুরু থেকেই তার কাজের প্রতি সচেতনতা, কর্তব্য পরায়নতা, নিয়মানুবর্তিতা ও সততার জন্য ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। এবং এর জন্য তিনি অনেকের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন।
পাকিস্তানকে দুমড়ে মুচড়ে পুর্বপাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হয়। এবং ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তান কে জনতা ব্যাংক নামে রুপান্তরিত করা হয়। সকল বাংগালী কর্মকর্তাদের বহাল রেখে ব্যাংক টিকে জাতীয়করন করা হয়। অল্পদিনেই তিনি তার কর্মদক্ষতার সাক্ষর রেখে জুনিয়র অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তারও কিছুদিন পরেই তিনি অফিসার, সিনিয়র অফিসার এবং প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে প্রমোশন পান।
তার চাকুরী জীবনে তিনি ২৬ বছর ব্রান্চ ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাঝখানে ১ বছর তিনি আন্চলিক অফিসে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যাক্তি জীবনে ও চাকুরী জীবনে তিনি পুরো সময়টিতে সততার সহিত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার ক্লায়েন্টদের প্রতি খুবই দায়িত্বশীল ছিলেন। দায়িত্বশীল ছিলেন তার স্টাফদের প্রতিও।
তার কার্যালয়ে কেউ কোন সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসলে তিনি তা তাদের সন্তুষ্টির সহিত অল্প সময়ে তা সমাধান করে দিতেন। নানা প্রলোভনে তিনি কখোনোই বিচ্যুত হতেন না। তার কার্যালয়ে লেনদেন কারিদের সাথে তার সম্পর্ক খুবই চমৎকার ছিলো। তিনি যখন কোন ব্রান্চ থেকে ট্রান্সফার হয়ে বিদায় নিয়ে আসতেন আমি দেখেছি অনেকেই আবেগ ধরে রাখতা পারেননি।
তার আন্চলিক কার্যালয়ের জিএম, ডিজিএম সকলেই তাকে তার সততা এবং কর্মদক্ষতার জন্য তাকে সমীহ করতেন।
একবার হলো কি তার আন্চলিক কার্যালয় থেকে হঠাৎ করে একজন পদস্থ কর্মকর্তা শাখা অফিসে এসে আমার বাবাকে ভীষন রাগান্বিত হয়ে বকাবকি করে গেলেন তার জুনিয়র স্টাফদের সামনে। বাবা ব্যপারটা বুঝতে পারেননি। তিনি অপমানিত বোধ করলেন কিন্তু পদস্থ কর্মকর্তাকে তিনি কিছুই বলেননি তখন।
পরের দিন তিনি সকালবেলা ঐ অফিসারের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। উনাকে জিগ্গেস করলেন আপনি আমাকে সকলের সামনে কেন এভাবে যা খুশি তাই বলে আসলেন এটাতো আপনি ঠিক করেন নাই।
তখন উনি বল্লেন দেখেন আমি ঐদিন গগল্স পরে গেছি আপনার ওখানে কারন আমি আপনার চোখে তাকিয়ে কথা বলতে পারবোনা। আমি এখানে বাসা নিয়ে সপরিবারে থাকি, আমার একটা বড় খরচ আছে। আপনার ব্রান্চ থেকে আমাকে টাকা পয়সা দিয়ে সহযোগীতা না করলে আমি কেমন করে চলি। আমার বাবা ততক্ষনে বুঝলেন আসল কথা। তিনি রাজী হলেননা।
শেষে কিছুদিন পরে উনি অনেক চেষ্টা তদবির করে আমার বাবাকে চাকুরির কর্মস্থল পরিবর্তন করে দেন এবং নিজের এরিয়ার না রেখে অন্য এরিয়ায় পাঠিয়ে দেন। বাবা এতে মনে খুব কষ্টপান। তিনি ঐ কার্যালয়ে ১২ বছর সহ উক্ত এরিয়ায় টানা ১৫বছর ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। আমরাও আমাদের শৈশবের স্থান ছেড়ে আসতে চাইছিলাম না। অবশেষে নিয়ম অনুযায়ি আমাদেরকে চলে আসতে হলো।
যেদিন আমার বাবা চলে আসবেন সেদিন ঐ শাখার গ্রাহকগন আমার বাবার জন্য বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিলো উপজিলা মিলনায়তনে। বিশাল হলরুম লোকে লোকারন্য হয়ে পড়েছিলো। মিলনায়তনের বাইরেও প্রচুর লোক সমাগম। অনেকেই আমার বাবার জন্য তার হাত ধরে কেঁদেছিলো, আপনজন হারানোর বেদনায়।
বিদায় অনুষ্ঠানে উক্ত এরিয়া অফিসের সেই কর্মকর্তাকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিলো। তিনি এসে নিজে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। আমার বাবার প্রতি মানুষের এই ভালোবাসা দেখে। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা কেমন করে সাধারন গ্রাহক এলাকার স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষকদের মন জয় করে নিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য। এহেন পরিস্থিতি দেখে সেই অফিসার আমার বাবাকে ডেকে একটু আড়ালে গেলেন তার হাত ধরে বললেন, আমি মনে হয় ভুল করে ফেলেছি, আপনাকে বদলি করা ঠিক হয়নি।
আমাকে ক্ষমা করে দিবেন.....।
যা হোক ব্যথাতুর হয়ে আমরা নোয়াখালী চলে আসি। আমরা প্রায়ই (আমরা চার ভাই বোন) ওখানে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম। যেদিন যেতাম কেমন আপন আপন লাগতো। সবাই আমাদের খুবই স্নেহ করতেন।
যেই শুনতেন আমার বাবা ঐ এলাকায় এসছেন অনেকেই দুরদুরান্ত থেকে তার সাথে দেখা করতে আসতেন আর দুঃখ করে বলতে আপনিও ছিলেন আর এখন যিনি আছেন পয়সা ছাড়া কোন কাজ হয়না। আমার গর্বে বুক ফুলে উঠতো। এখনো ওখানকার সবাই আমার বাবার খোজ খবর নেন।
এরপরেও উনি আর ২/৩ জায়গায় খুবই সুনামের সহিত চাকুরি করেছেন। এবং সাধারন গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছেন।
এমন অনেক শাখা ছিলো যেগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনে এসেছিলো উনি দায়িত্ব নেয়ার পর তা লাভজনক শাখায় এবং অনেক সময় দেখা গেছে এরিয়ার সবচেয়ে লাভবান শাখায় পরিনত হয়েছিলো। শাখা অফিস কে দ্বিগুন বৃদ্ধি করতে হয়েছিলো।
উনি আরোও বড় পদে যেতে পারতেন কিন্তু তার একটাই দুর্বলতা ছিলো এবং তা ছিলো তার শিক্ষাগত যোগ্যতা। আমার বাবা যখন ৪০দিন বয়সে তখন আমার দাদা মৃত্যু বরন করেন। তাতে তার পরিবার অকুল পাথারে পড়েন।
আমার বড় জেঠাও অনেক ছোট ছিলে। আমার বাবা জ্যাঠা গন অনেক কষ্ট করে কোন মতে এন্ট্রাস পাশ করেই চাকুরিতে ঢুকে যান। সংসারের হাল ধরেন। আমার বু (দাদী) ও জ্যাঠা অনেক কষ্ট করে আমার বাবা চাচা দের লেখা পড়া করান। আমার বাবা দুর গাঁয়ে লজিং থেকে স্কুলের গন্ডি পার হন।
যা হোক উনি উনার সততা কর্মদক্ষতা শৃংখলাবোধ তাকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যায়। পরবর্তিতে তার প্রমোশনের জন্য বেশ কয়েকবার ফাইল উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হয়। কিন্ত শিক্ষাগত সার্টিফিকেট জনিত দুর্বলতার কারনে বারবার বাধার সম্মুখীন হন। শেষে তিনি তার চাকুরীকাল সমাপ্ত করেন।
একবার, আমি/আমরা খুবই ছোট(আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন ছিলাম)ছিলাম, দুজন লোক এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে।
হাতে বিশাল বিশাল ২ কাতল মাছ নিয়ে এসেছিলেন। আম্মা এবং আমরা অবাক, কি ব্যপার মাছ কে পাঠিয়েছে, কোথা থেকে এলো? তারা জানালেন তোমার আব্বু পাঠিয়েছেন, পৌছে দিতে বললেন, উনি পরে আসবেন।
আমরা খুবই খুশি অত বড় বড় মাছ দেখে। আম্মা বটি আর ছাই নিয়ে বসলেন মাছ কাটবেন বলে। আমরা চার ভাইবোন গোল হয়ে বসে দেখছি আম্মা অত বড় মাছ কাটবেন বলে।
মাছ কাটতে যাবেনএমন সময় দেখি আব্বা উপস্থিত। তিনি মাছ দেখে বল্লেন, কোথা থেকে এলো এই মাছ। আমরা অবাক, আরে বলে কি? পরে বিস্তারিত শুনে উনি মাছ দুটো হাতে নিলেন। তারপর বাসার পাশে কচুরিপানা ওয়ালা ডোবাতে মাছ দুটো ছুঁড়ে মারলেন। আমাদের বুকটা হু হু করে উঠলো।
এতো বড় মাছ আব্বা ফেলে দিলো, কেন? পরে জানা গেলো উনার কোন ক্লায়েন্ট লোন নিতে এসেছিলো কিন্তু তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি তাই লোন নিতে পারেননি। অফিসে ঘুষ সেধেছিলেন কিন্তু দিতে না পেরে এই কান্ড ঘটিয়েছেন। তখন মনে অনেক কষ্ট পেলেও এখন ভাবতেই ভালো লাগে। এই হলো আমার বাবা, গর্ববোধ করি।
আমার বাবার সমপর্যায়ে বা নীচের অফিসার যারা চাকুরি করেছে তারা কত অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন।
চোখ ধাঁধানো বাড়ি, গাড়ি, চাকুরি শেষে ব্যবসা বানিজ্য, চাকচিক্যের লাইফ লীড করছেন অথচ তাকে চাকুরি শেষে পেনশন বিক্রি/এককালীন পাওনা টাকা দিয়ে জমি ভরাট করে একটা টিনের ঘরে বসবাস করেন। কিন্তু এনিয়ে উনার কোন আক্ষেপ নেই বরং রয়েছে পরম তৃপ্তি।
চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার কিছুদিন পরেই তিনি শারিরিক ভাবে এবং মানসিক ভাবে ভেংগে পড়েন। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। হৃদরোগের চিকিৎসায় তাকে বাইপাস অপারেশন করা হয়েছিলো, আমাদের সেকি অবস্থা।
ভয় পেয়ে ছিলাম সবাই। ২০০৪ সাল তখন। কারন এমন পরিস্থিতিতে আমরা কখনো পড়িনি। ভয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরুতে এনজিও প্লাস্টি করিয়েছিলাম। তাও আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩লক্ষ টাকা ধার করে।
পরে বাড়িতে জমি বিক্রি করে বন্ধুর ধারের একটা বড় অংশ পরিশোধ করা হয়েছিলো। বাকিটা আমি অল্প অল্প করে শোধ দিয়ে ছিলাম। ৬ মাস ও টেকেনি এনজিওপ্লাস্টি, পুরো টাকাটাই শুধু শুধু। এবার আল্লার নাম করে বাবাকে সাহস দিয়ে ডিসিশন নিলাম বাইপাস করাবো, যা হোক আবার টাকা পয়সা এদিক সেদিক করে জড়ো করে তার অপারেশন করালাম। মাশাল্লাহ গত ৬ বছর উনি খুবই ভালোভাবে সুস্থ আছেন।
উনি অবশ্য খাওয়া দাওয়াতে অনেক শৃংখলা রক্ষা করে নিজেকে সুস্থ রেখেছেন।
তিনি এখন গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন। আমারা ৩ ভাই সবাই ঢাকাতে বর্তমানে চাকুরিরত। আমার বাবা এবং মা দুজনে একা থাকেন। আমরা উনাদের ছেড়ে এই শহরেই পড়ে আছি।
এটো করে বলি ঢাকায় আসুন সবাই একসাথে থাকি উনারা শুনবেননা, ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে। গ্রামেই থাকবেন। গ্রামের বাড়িতে ছোট একটা পুকুর কেটেছেন, ফলজ বনজ গাছের বাগানকরেচেন। বাড়ীর পাশে লাগোয়া এক চিলতে জমি উচু করে ভরাট করে টুকটাক সবজি চাষ করেন। সারা বছর ওখানে ২/৪ পদের সবজি সবসময়ই থাকে, নিজের হাতে সবজি বাগান করেন।
পুকুরে মাছের চাষ করেন। এসব নিয়েই উনি এবং আম্মা গ্রামেই রয়ে গেলেন। প্রতিদিন উনাদের সাথে ফোনে কথা বলে থাকি খোজ খবর আদান প্রদান করি।
উনারা যেন অনেক বছর ভালোভাবে বেঁচে থাকেন।
আমার বাবা ছিলেন ভীষন বদরাগী।
উনার মাইর আমিই সবচাইতে বেশি খেয়েছি। এমনও ছিলো সপ্তাহে ৫/৬দিনই মাইর খেয়েছি। অন্যরাও খেতো কিন্তু আমি নিয়মিত। যা হোক সে সব আরেক দিন লিখবো।
যারা এই লেখা পড়েছেন অনেক ধন্যবাদ।
লেখায় মুন্সিয়ানা নাই বলে অনেকের পড়তে বিরক্তি লাগতে পারে।
আসলে কেন যেন আমার বাবাকে খুব মিস করছি তাই লিখে ফেললাম।
বাবা এবং মাকে নিয়ে ছোটবেলা-বড়বেলার স্মৃতিগুলো আরো লিখবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।