আমি যখনই কারো সাথে গল্প করি তখনই বলি আমার আম্মু আমাদের জন্ম দিয়েছেন, আর লালন পালন করেছেন আব্বা। এরপর তাদের কাছে ব্যপারটা ব্যাখ্যা করতে হোত, মোটামুটি আমার কাছের মানুষেরা সবাই জানে আমার আব্বার কথা। আমার শৈশবে মায়ের আদরের চেয়ে বাবার আদরটাই মনে পড়ে বেশী। মেয়েরা বাবার ন্যাওটা হয়, কিশোরী বয়স পর্যন্ত বাবার দিকেই টানটা প্রবল ছিল, এরপর ধীরে ধীরে টানটা মায়ের দিকে চলে গেছে। তাই বাবার কথা বলতে গেলে শৈশবটাই চোখের সামেনে ভেসে ওঠে।
আমরা ছ' ভাইবোন; তিন ভাই তিন বোন। প্রতিটি ভাই বোন জোড়া জোড়া। একভাই একবোন পিঠাপিঠি, এমনি করে তিনটি সেট। তিন নম্বর সেট এর শেষটি হলাম আমি, আমার পিঠাপিঠি ভাইটি আড়াই বছরের বড়। এতগুলো ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করা আম্মুর জন্য একটু কষ্টেরই ছিল।
আমার আম্মু নরম টাইপ মহিলা, সংসারে আমাদের সবার খাবার তৈরী করতেন এটাই ছিল ঢের। আব্বা সব গুলাকে লালন পালন করেছেন। গোসল করানো, হাত পায়ের নখ কেটে দেয়া, চুল কাটা, মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া, আমাদের সবকটি ভাইবোনের জন্য একাজ গুলো আব্বা করতেন। আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি, প্রতিবার ভাইবোনদের কারো জন্মের সময় আম্মু ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়তেন, তখন সদ্যজাত পিচ্চিটার পাশাপাশি আম্মুর দেখাশোনাও আব্বা করতেন।
সবার ছোট হওয়াতে সবার কাছে আদর আহ্লাদ বেশি পেয়েছি, সবচেয়ে বেশি পেয়েছি মনে হয় আব্বার কাছ থেকে।
আমি যখন অনেক ছোট, তখনও আমাদের বাসায় বিদ্যুৎ আসেনি, সন্ধ্যায় বড়পা অথবা আম্মু হারিকেন জ্বালাতো। তখন রাতে গরমে ঘুমুতে পারতাম না আমি। সমস্ত রাত আব্বা আমাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতেন, একটু থামলে সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত, আবার আব্বা বাতাস করতেন! বড় হবার পর এটা ভাবলেই আমার কষ্ট হোত, সারাদিন অফিস করে আব্বা কিভাবে সারারাত আমাতে পাখা দিয়ে বাতাস দিতেন! আমাদের গোসল করাতেন আব্বা, ছুটির দিনে চলতো ঘষাঘষি, ইশ কত ব্যাথা পেয়েছি কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারিনি। ঈদের দিন শীত গরম যাই থাক সাত সকালে ঠান্ডা পানিতে ঘষেঘষে গোসল তারপর আপুদের হাতে সাজুগুজু।
আমি একটু ছোট বয়সে লেখাপড়া শুরু করি।
আমার স্কুলের জামা কাপড় আব্বা পরিস্কার করে দিতেন। যখন ক্লাশ সিক্স এ উঠলাম, তখন স্কুল ড্রেস হল ফ্রক এর বদলে সালোয়ার কামিজ আর ভাঁজ করা ওড়না। আব্বা তখন বললেন এই পিচ্চি মেয়েটা কেমন করে ওড়না পড়বে? তখন থেকে আব্বা আমার স্কুল ড্রেস ছুটির দিনে ধুয়ে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করে রাখতেন, জুতোটা সাদা ধবধবে করে রাখতেন। আমি টেরও পেতাম না এর পেছনে কত কষ্ট করতে হয়, শুধু আরাম করে পড়তাম। ক্লাশ এইটের পর খেয়াল করলাম আমার অন্য বন্ধুরা নিজেরাই এ কাজগুলো করে, তখন বোধদয় হল, এবং নিজে একাজ গুলো করা শুরু করলাম, আব্বার যত্ন পাওয়াটা ও শেষ হল।
বংশগতির ধারাবহিকতায় আমার তিনভাই ই বেশভাল শিশুলালন পালন কারী বাবা।
বিকেলে সবাই মাঠে খেলতে যায়, আমাদের ছোটবেলায় এই ঢাকাতেও অনেক বড় বড় মাঠ ছিল। আমি খেলাধুলায় একেবারে আনাড়ী, তারপরও দলেবলে সবার পেছন পেছন দৌড়াতাম। এই বৈকালীন আনন্দে বাধা হলেন আব্বা। অফিস থেকে ফিরে বাড়ীতে পা দিয়েই শুরু হোত, "মামনি টা কোথায়?" মামনি তখন খেলার মাঠে এটা মানতে তিনি নারাজ।
আম্মুকে বলতেন বাসায় ফিরে ওকে না দেখলে ভাল লাগে না। আম্মু জানিয়ে দিলেন আব্বা যখন ফিরবেন তখন যেন বাসায় থাকি এরপর আবার না হয় গেলাম। কি আর করা, তাই করতে হোত।
আব্বা ছিলেন প্রচন্ড রকম রাগী, সংসারে তাঁর ছিল একছত্র আধিপত্ত। বড় চারভাইবোন আব্বার রাগের বহর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন বিশেষত পড়ার সময়।
পড়া না পারলে ভীষন মার খেতে হোত উনাদের। আমাদের ছোটদুটোর যখন পড়াশোনার পালা এল তখন বড় ভাই বেশ বড়, তিনি বলে দিলেন আব্বাকে আপনার এদের পড়ানোর দরকার নেই, এদুটোকে আমরা পড়াবো। আমাদের পিঠ বেঁচেছিল সে কারনে। আব্বার কাছ থেকে পাওয়া সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল কান ধরে উঠবস করা, খেলা শেষে বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যা পেরুনোর জন্য এ শাস্তি পেতে হয়েছিল। আমার বড় ভাই আব্বাকে ডাকতেন আমাদের সংসারের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বলে।
কলেজে পড়বার সময় কোচিং ক্লাশ শেষ হতে সন্ধ্যা হোত, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকবার অনুমতি কারোরই ছিল না। কাজেই একদিন আম্মুর সাথে তুলকালাম বাঁধালেন, যে কোচিং এ সন্ধ্যা পার হয় সেখানে পড়ার দরকার নেই। পরে যখন বোঝালাম যে পড়তে পড়তে ই সময় যায়, তখন আবার বুঝলেন, যেমন চট করে রাগতেন, তেমন ই আবার বুঝিয়ে বললে ঠান্ডা। কোচিং থেকে ফিরে আব্বার হাতে বানানো চা খেয়ে পড়তে বসতাম, এখন ভাবি কোথায় আব্বা আমার বানানো চা খাবেন, তা না আমি উনার বানানো চা খেতাম। আমার আব্বা খুবই ভাল চা বানান, সে কারনে আম্মু আজো চা বানাতে পারেন না; অবশ্য চা বানানো ছাড়া আর কোন রান্না আব্বার জানা নেই।
সাত সকালেও কলেজ যাবার আগে আব্বাই চা টা বানিয়ে দিতেন, কখনো বা গরম দুধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হল ঢাকার বাইরে, ঢাকায় কোথাও চান্স পেলাম না। বড়পা বলল খুব ভাল হয়েছে, হলে থাকতে পারবি, আব্বার জ্বালায় হলে থাকতে পারিনি। আব্বা খুব দোটানায় পড়ে পড়তে পাঠালেন। সবাকে বলতেন সবগুলো ছেলেমেয়ে ঢাকায় পড়লো, সবার ছোটটাকে ঢাকার বাইরে পাঠাতে হবে, একদম ভাল লাগছে না।
মাস খরচের টাকাটা ব্যাংকে পাঠালেও চলে, তবু আব্বা সেটা দেবার জন্য প্রতিমাসে হলে যেতেন। হলে কারো বাবা আসাটা একটা উৎসবের মত ব্যপার। আমরা সবকটা (৫-৬ জনের গ্রুপ) দলবেঁধে হাজির হতাম। আগে থেকেই জানা থাকতো তাই যৎসামান্য নাস্তা এবং চাও বানানো হত। অন্য কারো বাবা আসলে তিনি মেয়ের সাথে সারাদিন থাকতেন, দুপুরে বাবা মেয়ে একসাথে খেত, ঘুরতো তারপর বিদায়।
আমার আব্বা মায়ের বানানো খাবার, মৌসুমী ফল এবং টাকা নিয়ে যেতেন। আমরা সব দল বেধে উনার সাথে যেয়ে বসতাম, একটু ফ্রেশ হবার পর চা নাস্তা খেতে খেতে বাড়ীর সবার খবর জিজ্ঞেস করতাম, উনি শুধু বলতেন ভাল, সবাই ভাল আছে। এর বেশী কিছু না। শুধু ভাল আছে দিয়ে আলাপচারিতা বেশীক্ষন চালানো যেত না। ফলে দশ মিনিটের মাথায় বলতেন, তাহলে এবার যাই মামনি? আমি বলতাম না না আরেকটু বসেন।
এমনি করে বড়জোর আধঘন্টা আটকে রাখা যেত, তারপর আবার ঢাকায় চলে যেতেন। একবারও বলতেন না, ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখি, তোমর ক্লাশ কোথায় হয় দেখি, কিচ্ছু না। আম্মুকে ঝাড়তাম, সবার আব্বা কতক্ষন থাকে, আর আমার আব্বা! এরকম করে না আসলে কি হয়? তারপরও আব্বা এভাবেই আসতেন, এটাই হয়তো উনার ভালবাসা প্রকাশের একটা মাধ্যম ছিল, ব্যাংকে টাকা পাঠালে তো আর মামনি টা কে দেখা যেত না!
আব্বা প্রচন্ড পরিশ্রমী এবং নিয়মতান্ত্রিক একজন মানুষ। গত চারপাঁচ বছর ছাড়া বাকী সারাজীবন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছেন, যেটা আমরা ছেলেমেয়েরা ও পারিনা। আমি ভোরে কোনকালে উঠতে পারিনা।
আব্বা সবসময় বলেন ডিসিপ্লিনড হও, ডিসিপ্লিন না শিখলে কোন উন্নতি হবে না। ভীষন ডিসিপ্লিনড, অসম্ভব গোছালো, পরিশ্রমী, স্বাবলম্বী বাবার মেয়ে হয়ে আজো ডিসিপ্লিনড হতে পারলাম না। এলোমেলো অগোছালো হয়েই কাটলো জীবন! আব্বা এই ৮৩ বছর বয়সেও নিজের হাতে চা বানিয়ে খান, দুপাটি বাঁধানো দাঁত নিজ হাতে পরিষ্কার ঝকঝকে রাখেন, হট ওয়াটার ব্যাগে পানি ভরে নিজেই পিঠের পিছনে দিয়ে বসে টিভি দেখেন, সেদিন বেশী গরম দিয়ে পিঠটাই পুড়িয়ে ফেলেছেন। উনার নিজের ঘরটা পরিপাটি করে গোছানো। কি বিছানা, কি আলমারী, কি টেবিল সব এত গোছানো, ধুলো বিহীন!
তারপরও আব্বা ভীষন একা।
আমার আব্বার কোন বন্ধু নেই, এলাকায়, কিংবা কর্মস্থলে কোথাও কোন বন্ধু নেই। পরিবারে ছেলেরা ছেলেবৌরা কোন কিছু লাগবে কিনা জানতে খোঁজ নিতে আসে প্রতিদিন, প্রতিবেলা। নাতি নাতনিরা ঘরে এসে হুটোপুটি করে খানিকক্ষন, আব্বা কিছুক্ষন মজা পান তারপর বিরক্ত হন, বলেন হয়েছে এবার সব যাও, তখন ওরা পালায়। আমরা মেয়েরা কখনো মুঠোফোনে খবর নেই, কখনো স্বশরীরে দেখে আসি। কেউ সময় নিয়ে দুটো গল্প করতে আসে না, আব্বার গল্প করতে ইচ্ছে করে কিনা আমি তাও জানিনা।
কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে, নিজেকে নিয়ে তিনি বেশ আছেন।
দীর্ঘ জীবন পার করে আব্বা এখনো ভাল আছেন। এর মাঝে উনার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে অনেকবার। প্রতিবার আমাদের আশংকা ছিল, এইবুঝি শেষ, স্রষ্ঠার কৃপা, আবার তিনি ফিরে এনছেন আমাদের মাঝে, এতটাই সুস্থ হয়ে যে আমরা ভাবতেই পারিনা, কত বেশী অসুস্থ তিনি ছিলেন ক'দিন আগেও। সবার ছোট হওয়াতে সংসারের শেকড়টা আমার একটু আলগা বলে, আব্বার কষ্টের সময়গুলোতে পাশে থাকতে পেরেছি।
গেল বছর রোজা রাখলেন, মসজিদে যেয়ে তারাবিহ পড়লেন। দেখেই কি যে ভাল লাগলো। বার্ধক্য জুড়ে আছে সারা শরীরময়, তাই সর্বক্ষন অনুযোগ এ কষ্ট সে কষ্ট। বোঝাই এগুলো হবেই। তবু অনেক ভাল আছেন আপনি আব্বা।
সারাজীবন শক্ত সবল আব্বা যেন এটা মানতে পারেন না।
সবাই বাবামায়ের দীর্ঘজীবন কামনা করেন, আমি কামনা করি সুস্থ জীবন, যেন সুস্থ থাকতে থাকতেই স্রষ্টা তাদের আপন করে নেন। যেন কারো করুনায় তাদের জীবনযাপন করতে না হয়।
এখন আব্বার বাড়ী যাচ্ছি আব্বাকে দেখতে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।