আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্টেশন

ঈদ মুবারাক

আজ কেন জানি খুব লেইট হচ্ছে ট্রেন আসতে। স্টেশনে প্রচন্ড ভীড়। গরম,ভীড়, মানুষের উৎকন্ঠা সব মিলিয়ে খুব হযবরল অবস্থা। রাত বাড়ছে আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভীড়। রাত বারোটায় একটা ট্রেন আসল।

মানুষ গুলি পড়িমরি করে ছুটল ট্রেন ধরার জন্য। খুব অল্প সময়ের মাঝে ট্রেন ছেড়ে গেল স্টেশনের ভীড় তাতে একটু কমেছে বলেই মনে হচ্ছে। রাত একটায় একটা ট্রেন আসার কথা। আবীর বিরক্ত হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছিল। পাশ থেকে স্বপ্ন বলে উঠল ' তোর ভাব দেখে মনে হচ্ছে ট্রেন এই এলো বলে।

শুনলি না স্টেশন মাষ্টার কি বলল, ট্রেন ২ঘন্টা লেইট। সো বসে থাকো ওয়েটিং রুমে। অত ঘড়ি দেখিস না বুঝলি সময় স্থির মনে হয় তাতে। তার চে' চল চা খেয়ে আসি। রাতটা বড়ই নিস্তব্ধ...' বকবক করেই যাচ্ছে স্বপ্ন।

আবীর আবার ঘড়ি দেখল। বন্ধ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। সেই কখন থেকে ১২টায় কাঁটা স্থির হয়ে আছে। স্টেশন মাষ্টার এর রুমের পাশেই ওয়েটিং রুম। টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে।

গুমোট পরিবেশ। ছোট্ট একটা রুমে গাদাগাদি করে বসে আছে লোকগুলো। একে গরমের দিন তার উপর মেঘলা আবহাওয়া। কেমন থমথমে পরিবেশ। এই মফস্বল শহরে ওরা দু'বন্ধু এসেছিল একটা ওয়ার্কশপের কাজে।

তিন দিনের ওয়ার্কশপ। আজই ঢাকায় ফিরে যেতে হবে ওদের। খুব জরুরী একটা কল পায় সন্ধ্যার দিকে আবীর। অবিলম্বে ঢাকায় ফিরতে হবে। এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে ভাবেনি ওরা।

ওদের প্ল্যান ছিল ওয়ার্কশপের শেষে একটু ঘুরে দেখবে আশপাশটা। তা আর সম্ভব হলো না। তড়িঘড়ি করে এই মধ্যরাতেই ট্রেন ধরতে হচ্ছে। আবীরের কেন জানি ভাল লাগছে না। এই মাঝ রাতে নির্জন মফস্বলের স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার কোন ইচ্ছা ওর নাই।

কেমন জানি গা ছমছমে পরিবেশ। দু'পাশেই ঘন জঙ্গল। লোকালয় থেকে বেশ দুরে স্টেশনটা। রাত যত বাড়ছে ততই চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন আরো চেপে ধরছে। আবীরের অস্বস্তি লাগছে।

অনুভবে কিছু একটা ধাক্কা দিচ্ছে। এই নিরাবতার মাঝে কি যেন আছে। কোথাও একটা পেঁচা ডেকে উঠল জমাট নিরাবতাকে ভেঙ্গে দিয়ে। চমকে গেল ওর আপাদমস্তক। এত ভয় ভয় লাগছে কেন? অদ্ভুদ তো! ওয়েটিং রুমে ফিরে যায় আবীর।

কিছুক্ষণ পর ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠে একটানা 'কুউউউউ...' শব্দে। স্বপ্ন বসে বসে পা দুলাচ্ছে। কানে হেডফোন। একটুপর হিহি করছে আর মনের সুখে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। ঠিক রেডিও শুনছে।

আবীরের হিংসা লাগল খুব। মনে মনে কষে একটা গাল দিল 'শা-লা আছে বেশ মজায়। ' 'কি রে তোকে কি ভুতে ধরেছে নাকি?' স্বপ্ন হাসতে হাসতে জানতে চায়। 'কেন? কি হয়েছে?' আবীর সিগারেট ধরাতে ধরাতে পাল্টা প্রশ্ন করল। 'না আমার তো কিছু হয় নাই।

তোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছিস। কেমন ভুতে পাওয়া মানুষের মত চেহারা হয়েছে হা হা হাআহা...' আবীর তেড়ে আসে মারতে। স্বপ্ন সাৎ করে সরে যায় হাসতে হাসতে। ' দূর শালা! ট্রেন আসে না কেন?' নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে যায় আবীর। কি যে একটা গুমোট ভাব মনের ভেতর।

অশান্তি লাগছে। বাথরুমে যেয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিল বেশ কিছুক্ষণ। মাথাটা ভাল করে ভিজিয়ে নিল। লোকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। ভাল লাগছে একটু।

ফ্রেশ হয়ে ওয়েটিং রুমে ফিরতেই বুকের ভেতর একটা ধাক্কা লাগল। কেউ নেই! পুরো খালি! আবারও শুনশান নিরাবতা। মানুষ গুলো গেল কোথায়?! দৌঁড়ে বাইরে আসে আবীর। স্টেশনের দু'পাশে তাকায়। কেউ নেই! এমন কি স্টেশন মাষ্টারের রুমটাও অন্ধকারে ছেয়ে আছে।

'স্বপ্ন' আবীর জোরে একটা হাঁক দেয়। কেউ উত্তর করল না বরং নিরাবতার গায়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে এল । আবীর সামনের দিকে এগুচ্ছে আর স্বপ্নকে খুঁজতে লাগল। 'স্বপ্ন! কোথায় তুই? দেখ ফাজলামী করিস না। সবসময় ইয়ার্কি ভাল লাগে না।

স্বপ্ন!' প্রতিটি শব্দই ফিরে ফিরে আসছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর আশেপাশে। স্টেশনটা ছাড়া আর কোথাও এতটুকু আলো নেই। স্টেশনের কাছেই একটা চায়ের স্টল। সম্ভবত ওদিকে গিয়েছে স্বপ্ন।

তাড়াতাড়ি পা চালায় আবীর। কয়েক পা যেতেই থমকে দাঁড়ায়। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ! বুকের ভেতরটা হীম হয়ে গেল ওর। এর মানে কি?! সব লোকজন কোথায় উধাও হল? আর স্বপ্নই বা গেল কোথায়? রেল লাইনের দিকে তাকায় আবীর। আবছা আলোতে চকচক করছে রেলের পাত গুলো।

দু'পাশের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় ও। কোথায় জঙ্গল?! নিরেট আধাঁরে ঢাকা। আলোকিত স্টেশনটুকু ছাড়া সবই যেন গিলে ফেলেছে এই জমাট অন্ধকার। দ্রুত পায়ে ফিরে আসতে থাকে ওয়েটিং রুমে। হৃৎপিন্ড এত জোরে বাড়ি খাচ্ছে যে মনে হচ্ছে যেকোন সময় বিস্ফোরিত হবে।

ওয়েটিং রুমের সামনে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল কোথাও আর তার সাথে সাথেই পুরো স্টেশন ডুবে গেল গভীর আধাঁরে। বিদ্যুৎ চলে গেছে। এখন?! আবীর প্রচন্ড আতংকিত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বারবার একটু আলোর উৎসের জন্য। 'স্বপ্ন কোথায় তুই? স্ব-প্ন!' গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েও স্বপ্নের সাড়া মিলল না। খোলা জায়গায় কেন জানি আতংক বাড়তেই থাকল ওর।

এক ছুটে ওয়েটিং রুমে ঢুকে পড়ল আবীর। হাতড়ে হাতড়ে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। সমস্ত অস্তিত্ব গ্রাস করে নিচ্ছে ক্রমবর্ধমান আতংক। হঠাৎ করেই লাইট জ্বলে উঠল আবারও পুরো স্টেশন আলোকিত হয়ে গেছে। আলো দেখে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে ওর শ্বাস প্রশ্বাস।

ফস করে ম্যাচের কাঠি জ্বালালো কে যেন! চমকে চারপাশে তাকায় আবীর। কোণার চেয়ারটাতে কে যেন বসে আছে। বোঝা যাচ্ছে না এত দূর থেকে। ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে অবয়বটা। হাল্কা একটা সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের বাতাসে।

কোন এক বিচিত্র কারণে আবীর খুব স্বস্তি অনুভব করছিল। ওর মাথায় একবারের জন্য এলো না এই আগুন্তক কে? পিন পতন নিরাবতা। আবীর ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকালো। আবার সেই সর্বনাশী অন্ধকার! জানালার ওপাশে কিছু নেই। কখন জানি স্টেশনটা উধাও হয়ে গেছে আধাঁরে।

নিকষ কালো অন্ধকার জমে আছে জানালার কাঁচে। ফিসফিস করে মানুষটি ওকে নিষেধ করল ওদিকে তাকাতে তাতে নাকি 'সে' টের পেয়ে যাবে ওর অস্তিত্ব। চমকে ফিরে তাকায় আবীর কোণে বসা আগুন্তকের দিকে। খুক করে কেশে গলা পরিস্কার করে কথা বলতে চাইল ও। কিন্তু একটা শব্দও বের হলো না গলা দিয়ে।

অর অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তরে আবারও ফিসফিসানি ভেসে এলো ওর কানে। 'সময় হলেই জানবে। কথা বলো না। ' আবীর ভাল করে দেখতে চাইল মানুষটিকে। কিন্তু অস্পস্ট আলোতে কিছু বোঝা গেল না।

হঠাৎ কার পায়ের শব্দে পুরো রুম কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। বিদ্যুৎ চমকের মতই আচমকা মানুষটি ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। ও অবাক হয়ে অনুভব করে গরম ছ্যাঁকা লাগল ওর বুকের ভেতর। মানুষটি ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। জড়িয়ে ধরেছে বললে ভুল হবে।

ঢেকে ফেলেছে কিছু একটা দিয়ে। ও প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল ভয়ে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। যে ওকে ধরে আছে সে খুব শক্তিশালী। বুঝতে পারছিল আবীর।

কিছুক্ষণ পর থেমে যায় পদশব্দ। মানুষটি ওর কানে কানে বলে ' ও টের পেয়ে গেছে তোমার অস্তিত্ব। আসছে 'সে'। প্রস্তুত হও। ' খুব জোরে ছুটে আসছে কিছু একটা।

আবীর কিছু বুঝে ওথার আগেই ওকে বাথরুমের মধ্যে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল মানুষটি। ঠিক সেই মুহুর্তেই ওয়েটিং রুমের দরজা দরাম করে খুলে যায়। জ্ঞান হারাবার আগে আবীর আবছা ভাবে দেখতে পাইয় দরজার নিচের অংশ দিয়ে প্রচন্ড আলোর ঝলকানিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নিরেট আধাঁর। 'আবীর। আবীর এই আবীর ওঠ আর কত ঘুমাবি? ট্রেন এসে গেছে তো।

' স্বপ্নের গলায় খুব তাড়া। আবীর ধরমর করে উঠে বসে। দেখে সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ওর প্রিয় বন্ধু। ট্রেন ছেড়েছে। আবীর বসে আছে জানালার পাশে।

রহস্যময় স্টেশনটা ছেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কে ছিল ঐ আগুন্তুক? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে সেই কখন থেকে। হঠাৎ দেখে স্টেশনের উপরে বসে আছে সেই আগুন্তক। হাসল ওকে দেখে। তারপর বিশাল আকৃতির পাখা মেলে উড়ে গেল কোথায়।

প্রচন্ড একটা ধাক্কা লাগল ওর স্নায়ুতে। ফিসফিস করে কে যেন বলে গেল 'আর ভয় নেই আবীর। 'সে' আর তোমাকে খুঁজে পাবে না। যাত্রা শুভ হোক। হাআহাহাআহা...' বহুক্ষণ কানে বাজতে লাগল হাসির শব্দ।

বাতাসে রেশ থেকে গেল সেই অচেনা কন্ঠের। আবীর বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে বসে থাকে। ট্রেনের গতি বাড়ছে। ' কুউউউউউউউউ......' । ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।