আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিবিরের কিলিং মিশন - বেঁচে যাওয়া দুইজন ।


ফেসবুক পাওয়া ঘটনাটা তুলে দিলাম : : শিবির তার প্রতিষ্ঠালগ্নের আগে থেকেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির নাম ধারণ করে পুনর্জন্মের মধ্য দিয়ে পুনরায় এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে তারা তাদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই রক্তপিপাসু হায়েনারা সততা, ন্যায়, প্রজ্ঞা, প্রগতি, মননশীলতা, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে হামলে পড়েছে অসংখ্যবার। তাদের হাতে এ পর্যন্ত জাতির অসংখ্য শ্রেষ্ঠ সন্তান প্রাণ হারিয়েছেন। শিবিরের নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়ে এখনো অনেকেই অসুস্থতায় কাল কাটাচ্ছেন, জীবনকে বয়ে বেড়াচ্ছেন।

রাজপথের টগবগে অনেক প্রতিবাদী যুবক এখন মাথা ঠুকছেন অন্ধকার ঘরের দেয়ালে। রাষ্ট্রযন্ত্র শিবিরের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, মাঝে মাঝে কিছু হম্বিতম্বি ছাড়া। শিবিরের কুখ্যাত সেই ক্যাডাররা এখনো রাজপথে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রায়ই তারা হুঙ্কার দেয়, তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নাকি মিথ্যা। মিথ্যা নাকি সত্যি তা প্রমাণ হয়ে যায় ঘটনা বাস্তবত কি ঘটেছিল তা জানা গেলেই।

শিবিরের দুটি নৃশংস-ভয়ঙ্কর কিলিং মিশনের মধ্য থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া দুজন ছাত্রনেতার ভাষ্য থেকে ঘটনা দুটির পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা হল। ১. সময়টা ৯০ দশকের মাঝামাঝি। রাবিতে শিবির তখন বর্ধিষ্ণু শক্তি। ঈমানী জোর দিয়ে শিবির অন্যদের মোকাবেলা করে বলা হলেও ক্যাম্পাসে ড়্গমতা সংহত করার জন্য তারাই সবচেয়ে বেশি ছল-চাতুরি, দু’নম্বরি করেছে। বাংলাদেশের অন্য কোনো সংগঠনকে নিজেদের বিকাশের জন্য এত ছলা-কলা ষড়যন্ত্র পাকাতে হয়নি।

তখনকার দিনে শিবির নানাভাবে অপরাপর সংগঠনের কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাতো। যেমন, রাজনীতিতে নতুন সক্রিয় হওয়া ছেলেদের দেখিয়ে দেখিয়ে শিবির ক্যাডাররা তরবারি ধার দিত। রাতে হয়ত তার মাথার কাছে ভয়ঙ্কর কিছু একটা রেখে গেল। কিংবা বাইরে দু’একজন আড্ডায় থাকলে তখন শিবির ক্যাডাররা বোরখা পরে হাতে কুড়াল কিরিচ-তরকারি নিয়ে তাদের সামনে হঠাৎ করে উদয় হত। কিছুক্ষণ পর আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যেত তারা।

এরকম ভীতি ও আতঙ্কের সময়ে রাবিতে অর্থনীতি বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন মাহবুবুল আলম ফরহাদ। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। হবিবুর রহমান হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে রাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। সবশেষে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৯৫ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারি শিবির রাবি ক্যাম্পাস দখল করে নেয়। ছাত্রদলকে তখন ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়া হয়। ২২ জুলাই ছাত্রদল ক্যাম্পাসে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা জানান, ক্যাম্পাস প্রত্যেকের।

প্রত্যেক ছাত্রেরই ক্যাম্পাসে থাকার, রাজনীতি করার অধিকার আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা সেরে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ক্ষমতাসীন বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলের নেতা কর্মীরা। দীর্ঘদিন পরে হলে ঢুকে সবাই যে যার কড়্গে চলে যায়। হাবিবুর রহমান হলের ৮৮ নং কক্ষে থাকতেন ফরহাদ। ছাত্রদলের ঐতিহ্যবাহী এই কক্ষটিতে ইতোপূবর্বে ফজলুর রহমান পটল, হারুণুর রশীদ হারুণসহ অনেক বড় বড় নেতার সিট ছিল।

কড়্গে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর হাত মুখ ধুয়ে একটু আরাম করে ফরহাদ যখন বসতে গিয়েছিল তখনই শিবির ক্যাডাররা তার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। সেসময় তিনি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বড় নেতা না হলেও প্রধান সংগঠকদের একজন ছিলেন তিনি। এজন্য তিনি ছিলেন শিবিরের বিশেষ টার্গেট। ফরহাদ ঘুণাক্ষরেও জানতেন না শিবির ক্যাডাররা সংঘবদ্ধভাবে হলের ভেতর ওৎ পেতে বসে আছে। হঠাৎ শিবির ক্যাডাররা কড়্গের ভেতর ঢুকে পড়ে।

এবং তারা ‘ফরহাদকে পেয়েছি’ বলে উল্লাস ধ্বনি দিতে থাকে। ফরহাদ তখন তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আবিভূত হন। চেষ্টা করেন সময় পার করার। যাতে তার বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করতে আসতে পারে। তিনি তাদের সঙ্গে আলাপ জড়াতে থাকেন।

কিন্তু শিবির ক্যাডাররা তার কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তার ওপর হামলে পড়ে। প্রথমেই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় কতগুলো আঘাত করে তারা। ফরহাদের মাথায় দেখা গেছে অনেকগুলো গভীর ক্ষতচিহ্ন। মাথায় আঘাতের পরই ফরহাদ চেতনা হারিয়ে ফেলেন। ঠিক এ সময় শুরম্ন হয় তুমুল বৃষ্টি।

শিবির ক্যাডাররা ফরহাদকে হল থেকে বের করে হাবিবুর রহমান হলের পেছনে নিয়ে যায়। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে তার সারা দেহ। সবশেষে তারা ফরহাদের বাম হাতের কব্জি পুরোটা কেটে নিয়ে যায়। তার মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তারা পরখ করে সে বেঁচে আছে কি না। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই তারা নারায়ে তকবির- আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিতে দিতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যায়।

এরপর বাংলা চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যের মতো সব ঘটনার শেষে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিএনপি তখন ক্ষমতাসীন দল। তবু শিবির ক্যাডাররা তাকে হত্যার উদ্যোগ নিতে পিছপা হয়নি। এ ঘটনার পর মামলা করা হয়েছিল ফরহাদের পক্ষ থেকে।

মামলা পরিচালনা করা হয়েছিল দলীয়ভাবে। আর সব রাজনৈতিক মামলার মতোই এ মামলারও একই অবস্থা হলো। রাজনৈতিক মামলাগুলো সাধারণত ২-৪ বছর চলে। সাক্ষী হয় না। বাদী থাকে না।

অবশেষে এক পর্যায়ে মামলাটির অপমৃত্যু হয়। শাহদাৎ, জব্বার, সোহরাওয়ার্দী হলের সভাপতি তুষার, রাবি শিবিরের সভাপতি মতিউর রহমান আকন্দ, সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম বুলবুল মাইনুলসহ আরো অনেককেই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই মামলার আসামি করা হয়। যদিও জানা যায় যে, শিবির ক্যাডারদের অস্ত্র প্রশিক্ষণদাতা, অসংখ্য মামলার আসামী ডাসমারি এলাকার বাসিন্দা কুখ্যাত ক্যাডার জাফর বাবু; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা, শিবিরের কিলার বাহিনীর সদস্য খুশী; মেহেরচণ্ডী এলাকার শিবিরের মেসগুলোর নিয়ন্ত্রক, বর্তমানে জামায়াতের রোকন, রাবি সংলগ্ন বুধপাড়া এলাকার আলোচিত শিবির ক্যাডার সামাদ; শিবিরের তৎকালীন সাথী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর মসজিদ মিশন একাডেমির পাশের বাসাটির অধিবাসী কুখ্যাত শিবির ক্যাডার শাহীন; শিবিরের রাবি শাখার সভাপতি জব্বার, মাইনুল (মাইনুল বর্তমানে রাজশাহীর লক্ষ্মীপুর মোড়ে জমজম ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের প্রজেক্ট ডিরেক্টর আর জব্বার বর্তমানে যশোরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের প্রজেক্ট ডিরেক্টর); বিনোদপুর এলাকার বাসিন্দা শিবির ক্যাডার সালেকীন এবং সাবেক রাবি ছাত্র শিবির সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীরসহ আরো প্রায় শতাধিক শিবির ক্যাডার সেদিন তার ওপর হামলায় জড়িত ছিল। তখন শিবিরের তেমন কেউ গ্রেফতার হয়নি। বরং বিএনপি ক্ষমতা ছাড়লে হাবিবুর রহমানের আমলে ফরহাদকেই জেলে যেতে হয়।

এমনকি ফরহাদের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়া ১ লাখ টাকাও তসরূপকৃত বলে অভিযোগ এনে ফরহাদকে অপমানিত করা হয়েছিল। অসুস্থতার সময় বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সাদেক হোসেন খোকা, আমানউল্লাহ আমান, ফজলুল হক মিলনসহ অনেকেই তাকে হাসপাতালে দেখতে যান। প্রধানমন্ত্রীর দৈনিক কার্যতালিকাতেও তাকে দেখতে যাওয়ার সময় নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পাটির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ডাকা হরতালের কারণে প্রধানমন্ত্রী আর তাকে দেখতে যেতে পারেননি। ফরহাদ আহত হওয়ার পর বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকা টানা ৪ দিন ধরে একের পর এক সিরিজ প্রতিবেদন প্রচার করে।

অচল এক হাত নিয়ে ফরহাদ এখনো স্বপ্ন দেখেন পরিশুদ্ধ রাজনীতির। ২. দেশ ও জাতির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ছিল প্রদ্যুৎ রুদ্র চৈতীর। বেড়ে উঠেছেন খুলনা শহরে। সেই বোধই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের প্রতি তার অন্তরে তৈরি করেছিল ব্যাপক ঘৃণা। তাই খুলনা অঞ্চলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন নিয়মিত।

কিন্তু জামায়াত-শিবির চক্র সেখানে তাদের শক্তি প্রদর্শন করত। কোনো ধরনের কর্মসূচি তারা সফল হতে দিত না। লাঠি, দা, কুড়াল, কিরিচ, তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত ঘাতকের দল। ফলে কোনো ধরনের কর্মসূচি নিয়ে এগুতে পারত না নির্মূল কমিটি। চৈতী এর প্রতিবাদ করতেন।

কর্মসূচিতে গেলেই তিনি শিবিরের বাধার বিরুদ্ধাচরণ করতেন এবং কখনো কখনো তাদের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়তেন। এরই রেশ ধরে ঘাতক শিবির ক্যাডাররা চৈতীকে চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। চৈতীকে হত্যার উদ্দেশ্যে দু’দুবার তার ওপর হামলা চালালেও তখন তারা ব্যর্থ হয়। এরপর চৈতী চলে আসেন রাজশাহীতে। ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে মাস্টার্স কোর্সে।

সেখানে এসেই তিনি বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী রাবি শাখার হাল ধরেন। ছাত্রমৈত্রীর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি এবার শিবিরের আরো বড় শত্রুতে পরিণত হন। ’৯৪ সালের ২০ ডিসেম্বর ছিল রাবিতে চৈতীর শিক্ষাজীবনের শেষ দিন। তখন তিনি ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক। ক্যাম্পাসে তখন শীতকালীন ছুটির মধ্যবর্তী সময়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা চলছিল।

পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। তীব্র শীত। রাজশাহীতে সেদিন তাপমাত্রা ৫/৬ ডিগ্রি। রিকশায় করে তিনি যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের সামনে হঠাৎ মাথার পেছনে কিসের যেন ছোঁয়া লাগল।

ঘুরে তাকাতেই দেখেন পিস্তল। গুলিও বের হলো সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু ততক্ষণে কিছুটা সরে গেছেন চৈতী। গুলিটা তার কোনো ক্ষতি করতে পারল না। রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে তিনি রাস্তার বাঁ দিকে দৌড়াতে শুরম্ন করেন।

শিবির ক্যাডাররা তখন আর তাকে গুলি করতে পারছিল না। কারণ সামনে-পেছনে, চতুর্দিকে তাদের নিজেদের লোক। তাছাড়া শিবিরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, পিস্তল-গুলির চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কুপিয়ে-কুপিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে কাউকে মারাটা তাদের কাছে অনেক বেশি পছন্দসই। একই ঘটনা ঘটল চৈতীর বেলায়ও। আগে থেকে প্রস্তুত শিবির ক্যাডাররা তখন চারদিক থেকে বোমা ফাটাতে শুরু করে।

যাতে এদিকে কেউ এগিয়ে আসতে সাহস না পায়। পরিকল্পনা মাফিক চতুর্দিক থেকে তারা ঘিরে ফেলে চৈতীকে। তারপর সমস্বরে আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুলে তাকে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। ইঞ্চি মেপে মেপে তাকে আঘাত করা হয়। তার সারা শরীরে প্রতি এক ইঞ্চি পরপর দেখা গেছে লম্বা-গভীর কোপের দাগ।

সারা শরীরে তিনি এই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। শিবির প্রথমে তার পায়ে যে কোপটি দিয়েছিল, তাতে ডান হাঁটুর একটু ওপর থেকে পুরো পা’টিই প্রায় আলাদা হয়ে গিয়েছিল। কোনোমতে এক পাশে একটু চামড়ার সঙ্গে ঝুলেছিল পা’টি। এক সময় কোপাকুপির মধ্যেও কোনো একজন গুলি চালায় তার ওপর। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই গুলিটি না ফোটায় তখনই তাকে মরতে হয়নি।

সারা শরীর থেকে তীব্র রক্তের স্রোত বেরিয়ে আসছিল তার। মাথা মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে নাকের ছিদ্রটাও প্রায় বুজে গিয়েছিল। চৈতীর কানে যেন দূর পরবাস থেকে তখন ভেসে আসতে থাকে তাদের বাক্য বিনিময়। তার মধ্যে একটি বাক্য এখনো তাকে তাড়া করে ফেরে। যেন খুব দূর থেকে কেউ একজন বলছে, ‘ভালো করে চেক করে দেখ, মারা গেছে কিনা?’ সারা পৃথিবী তখন ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে চৈতীর কাছে।

তার পরও সজাগ হয়ে ওঠে মস্তিষ্ক। নিশ্বাস-প্রশ্বাস কিছুক্ষণের জন্য হলেও জোর করে বন্ধ রাখার চেষ্টা চালায় সে। শিবির ক্যাডাররা তাই তখন তার হাল্কা প্রশ্বাস নির্গমনটা ধরতে পারেনি। মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে তারা বোমা ফাটাতে ফাটাতে উল্লাস করে আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুলে ফিরে গিয়েছিল। মেহেরচণ্ডী এলাকার শিবিরের মেসগুলোর নিয়ন্ত্রক, বর্তমানে জামায়াতের রোকন, রাবি সংলগ্ন বুধপাড়া এলাকার আলোচিত শিবির ক্যাডার সামাদ; শিবিরের তৎকালীন সাথী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর মসজিদ মিশন একাডেমির পাশের বাসাটির অধিবাসী কুখ্যাত শিবির ক্যাডার শাহীন; শিবিরের রাবি শাখার সভাপতি জব্বার, সেক্রেরি মাইনুল (মাইনুল বর্তমানে রাজশাহীর লক্ষ্মীপুর মোড়ে জমজম ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের প্রজেক্ট ডিরেক্টর আর জব্বার বর্তমানে যশোরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের প্রজেক্ট ডিরেক্টর); এবং সাবেক রাবি ছাত্র শিবির সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীরসহ আরো প্রায় শতাধিক শিবির ক্যাডার সেদিন তার ওপর হামলায় জড়িত ছিল।

এর কিছুক্ষণ বাদেই বাইরে থেকে রাবিতে আসা একটি ট্যুর গাড়ি এগিয়ে আসতে থাকে ঘটনাস্থলের দিকে। এতক্ষণ বোমার জন্য আটকা পড়ে থাকা গাড়িটি শিবির ক্যাডারদের বেরিয়ে যেতে দেখে দ্রুত তখন এলাকা ছাড়তে চাইছিল। গাড়িতে বসা নারীরা প্রথম লক্ষ্য করে লাশটির দিকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তবু তারা চৈতীর অচেতন দেহটি গাড়িতে তুলে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যায়। ইতোমধ্যে রাবিতে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

সাধারণ ছাত্ররা তখন এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিবির সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়া হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। রাবির সেই পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। ছাত্ররা দলে দলে ছুটতে থাকে মেডিকেলের দিকে। শক্তিহীনতার জন্য বর্বরতার বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে না পারলেও টাকা-পয়সা যার যা ছিল, নিয়ে ছুটে যায় চৈতীর চিকিৎসার জন্য।

রক্ত দেয়ার জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে থাকে ছাত্ররা। ভাগ্য প্রসন্নই বলা যায়। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। অর্থোপেডিক্সের ডাক্তাররা সবাই অপারেশন থিয়েটারে তৈরি ছিল তাদের নিজস্ব রুটিন অনুসারেই। চৈতীকে হাসপাতালে নেয়া মাত্র ডাক্তাররা তার জীবন বাঁচানোর জন্য একযোগে কাজে নেমে পড়ে।

রাত ১০টার দিকে একবার ঘোষণা করা হয় মারা গেছে চৈতী। কিন্তু না, নিজের অদম্য প্রাণশক্তির জোরে বেঁচে থাকেন তিনি বুকে দ্রোহের বীজ নিয়ে। দুই দিন পর জ্ঞান ফেরে তার। রাবির প্রগতিশীল শিক্ষকরা তখন আতঙ্কে কাঁপছেন। অনেক শিক্ষক রাজশাহী মেডিকেলে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন চাদর মুড়ি দিয়ে।

শিবিরের ভয়ে প্রকাশ্যে অনেকেই তখন তার পাশে দাঁড়াতে পারেননি। পরে তাকে ঢাকায় আনা হলে পান্না কায়সার, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, হায়দার আকবর খান রনো, ভাষা মতিনসহ ভারতে চিকিৎসার সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মাদার তেরেসা, জ্যোতি বসু প্রমুখ দেশি-বিদেশি নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাকে হাসপাতালে গিয়ে সমবেদনা জানান। এদিকে চৈতীকে আর রাজশাহী রাখাটা নিরাপদ মনে হয় না অনেকের কাছে। দ্রুত তাকে সরিয়ে আনা হয় ঢাকার পিজি হাসপাতালে। এরপর একবার তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।

বিদেশি ডাক্তারদের একটি দল তার হাড়ে অপারেশন চালায়। ইতোমধ্যে তার শরীরে হাজারখানেক সেলাই করা হয়েছে। শত শত সেলাইবিহীন ব্যান্ডেজ মোড়া ক্ষত ঢেকে ফেলেছে তার সারা দেহ। কৃত্রিম রগ জুড়ে দেয়া হয়েছে শরীরের অনেক জায়গায়। মৃত্যুর মুখোমুখি চৈতীকে এরপরও শিবিরের নিয়োগকৃত এজেন্টরা হাসপাতালের মধ্যে বার দুয়েক হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল।

কিন্তু বন্ধুদের অক্লান্ত রাতজাগা পাহারা তাদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে। ঠিক এই সময়টাতেই ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেননের অনুরোধে ভারতের কমিউনিস্ট পাটি (সিপিএম) চৈতীর চিকিৎসার দায়ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। নিয়ে যাওয়া হয় তাকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতলে। টানা ২ বছর হাসপাতালে থাকতে হয় তাকে। এরপর তিনি দেশে ফেরেন।

কিন্তু এখনো প্রতি ৬ মাস অন্তর তাকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে গিয়ে রক্ত সঞ্চালনের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য ইলেকট্রোথেরাপি গ্রহণ করতে হয়।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.