'স্কুলের জামা পড়ে কেউ বেড়াতে আসে?' শোভন ভাইয়ার কথায় সাদিয়া নিজের জামাটার দিকে তাকালো। নীল রঙের ফ্রক। স্কুলে, বাসায় সমানে ব্যবহার করতে করতে নীল রঙটা অনেক হালকা হয়ে গেছে।
'তোমরা স্কুলের জামা পড়ে বেড়াতে যাও না?'
'না আমরা বেড়ানোর জামা পড়ে বেড়াতে যাই। ' শোভন বললো।
শোভন ক্লাস টুতে পড়ে। সাদিয়া নার্সারিতে। একই স্কুলে।
শোভন ভাইয়ার কথায় সাদিয়ার মন খারাপ হলো। শোভনদের বাগানে ওরা ছোটাছুটি করছিলো।
আর শোভনদের ঘরে বসে সাদিয়ার মা গল্প করছে। সাদিয়া ছোটাছুটি বাদ দিয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলো। তারপর মন খারাপ করে গিয়ে বসলো মা'র পাশে। মা খেয়াল করলেন না।
সন্ধার আগে আগে ও মা'র সাথে বাসায় ফিরে এলো।
তিনটি বেড়ার ঘর। একটি ঘরে ওরা ঘুমায়। একটি ঘরে রান্না, খাওয়ার ব্যবস্থা। আর অন্যটিতে ওরা তিন ভাইবোন পড়াশোনা করে। সাদিয়া, সামিয়া আর ওদের বড় ভাই রিমন।
সাদিয়া সবার ছোট। রাতে পড়ার ঘরের মাটিতে ওদের দুই চাচা ঘুমায়। ঘরের সাথে বেশ বড় উঠান। নানান গাছ।
'সাদিয়া যা, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে আয়।
' মা'র কথায় সাদিয়া গেলো কলপাড়। ওর বড় দুই ভাই বোন হাত-মুখ ধুয়ে এসেছে। ওর জন্য কল চেপে বালতিতে পানি রেখে গেছে। সাদিয়া দীর্ঘ সময় নিয়ে একগাদা পানি খরচ করে হাতমুখ ধুলো।
পড়ার ঘরে ঢুকতেই মা'র ধমক, 'আবারো জামা ভিজিয়েছিস?' সাদিয়া তাকিয়ে দেখলো সত্যিই জামার নিচের অংশ ভিজে গেছে।
ও খেয়াল করেনি।
ওদের মা-ই তিন ভাই বোনকে পড়ান। ওর ভাইয়া আর আপা পড়ছে। সাদিয়ার মাথায় ঘুরছে বেড়ানোর জামা। 'মা বেড়াতে গেলে কি স্কুলের জামা পড়তে হয় না?'
মা সাদিয়ার মাথায় আদর করে হাত বুলাতে লাগলেন।
'কেন মা?'
'শোভন ভাইয়া বললো স্কুলের জামা পড়ে নাকি বেড়াতে যেতে হয়না?'
'যাদের বেড়ানোর আলাদা জামা নেই, তারা স্কুলের জামা পড়ে যেতে পারে। এতে দোষ নেই। '
'ও। '
কিছুক্ষন চুপচাপ অংক করলো সাদিয়া। তারপর বললো মাকে, 'মা আমাকে একটা বেড়ানোর জামা কিনে দিও।
' মা ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,'আচ্ছা দেবো। '
খ
সেলাই মেশিন চলছে ঘটঘট করে। নজরুল চাচা সেলাই করছেন। নজরুল চাচা সাদিয়ার দূর সম্পর্কের চাচা। সাদিয়াদের বাড়ির সামনের অংশে থাকেন।
সামনের অংশটাকে তিনি দোকান বানিয়েছেন। দজর্ীর দোকান। সেখানেই কাজ করেন। সেখানেই ঘুমান।
সাদিয়া মুগ্ধ হয়ে সেলাই মেশিনের দিকে তাকিয়ে আছে।
চাচা কি সুন্দর করে সেলাই করে যাচ্ছেন। একটুও আঁকাবাঁকা হয়না।
'কিরে মা, পুতুলের জামা লাগবো?'
'লাগবে। ' সাদিয়া খুশি হয়ে জবাব দেয়।
'নে।
' নজরুল চাচা একগাদা টুকরো কাপড় ধরিয়ে দেন সাদিয়ার হাতে। সাদিয়া পুতুলের কাপড় নিয়ে দৌড় দিচ্ছিলো। নজরুল চাচা ডাক দিলেন ,'আরে দাড়া , দাড়া। ' সাদিয়ার খুশি আর ধরছেনা। খুশিতে ও শুধু হাসছে।
শুধু হাসছে। হাসতে হাসতে ছুটলো মাকে জামাটা দেখাতে।
কোমড় পর্যনত্দ জামা এক কাপড়ের। হাটুর নিচ পর্যনত্দ অন্য কাপড়। জামার উপরে, নিচে চারটি পকেট।
মানুষের কাজ করে বেঁচে যাওয়া টুকরো কাপড় দিয়ে তৈরী হয়েছে জামা। নজরুল চাচা লেস, বোতাম,পকেট লাগিয়ে খুব সুন্দর করে জামাটা বানিয়েছেন। তাই জামার জোড়াতালি বুঝাই যায় না। মা জামাটা দেখে খুব খুশি হলেন। মেয়েটা কয়েক দিন ধরে জামা জামা করছিলো।
দিতে পারছিলেন না। মন খারাপ হচ্ছিলো। সাদিয়ার বাবা যা বেতন পান তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে। মেয়েকে নতুন জামা কিনে দেবেন কোত্থেকে। নজরুল তাদের দায়িত্বটা পালন করলো।
'জামাটা রেখে দে। কোথাও যাওয়ার সময় পরিস। '
সাদিয়া কিছু বললো না। জামাটা রেখে দিতে ওর একটুও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মা বললে তো রেখে দিতেই হবে।
'রেখে দিতে ইচ্ছে করছে না?' মা জিজ্ঞেস করলেন।
'না। '
'আচ্ছা তাহলে পড়ে থাক। ' সাদিয়ার মুখে আবারো হাসি ফুটলো। সে নতুন জামা পড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
ছুটলো আশেপাশের বাড়িতে।
পরদিন সকালে সাদিয়ার বাবা কারখানায় যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন। কিন্তু পকেটে থাকা টাকা পাচ্ছিলেন না। শার্টের, প্যান্টের সব পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। খুঁজলেন বালিশের, আলনার নিচে।
যদি পড়ে থাকে। পেলেন না। টাকা না পেয়ে সাদিয়ার বাবা রেগে গেলেন। কানে ধরালেন রিমন আর সামিয়াকে। 'তোরাই নিয়েছিস।
নইলে টাকা গেলো কোথায়?'
কানে ধরে দু'জনেই বললো,'আমরা নেইনি বাবা। '
'তোরাই নিয়েছিস। তাড়াতাড়ি বলে দে। নইলে কিন্তু বেত দিয়ে পেটাবো। '
পেটানোর আগেই দুই ভাই বোন জুড়ে দিলো কান্না।
এমন সময় ওদের মা সাদিয়ার জামার পকেট থেকে টাকা বের করে আনলেন। ওর পকেট থেকে টাকা পাওয়ায় সবাই অবাক ।
'মা তুমি টাকা কোথায় পেলে?'
'বাবার পকেট থেকে নিয়েছিলাম। '
'কেন নিয়েছিলে?'
'পকেটে তো টাকা থাকে। আমার পকেটে টাকা নেই, তাই বাবার পকেট থেকে নিয়ে ভরেছি।
' সাদিয়ার সোজাসাপটা জবাব। মা-বাবা হেসে ওকে আদর করলেন। আর ওর উপরে ক্ষেপে গেলো রিমন আর সামিয়া। ওর জন্য এতক্ষন কি বকাটা-ই না দু'জন খেলো।
গ
দুপুরের খাবার খেয়ে তিন ভাই বোন ঘুমিয়ে ছিলো।
প্রচন্ড হৈ চৈ চেচামেচির শব্দে ওদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। নজরুল চাচাকে কারা যেনো খুব বকাঝকা করছে।
'বাটপারের পুত বাটপার, মাইনষের জামা বানাইয়া কাপুড় চুরি করছ। আবার কাপুড় দিয়া আহ্লাদ কইরা আরেকজনরে জামা বানাইয়া দেস। ...'
'দেহেন বাপ-মা তুইল্লা গালি দিবেন না।
আর জামার এট্টু টুকরা কাপড়ের লেইগা যেমুন চিল্লাচিলি্ল লাগাইছেন, এমুন তো জীবনে দেহী নাই। '
'ওই বেটা দুই দেহনের কে? বালা মতোন জামা বাইর কর, নাইলে তোরে জনমকার লেইগা দেহায় দিমু। '
তিন ভাইবোন সামনে গিয়ে দাড়ালো। ষন্ডা মতোন চার-পাঁচজন লোক নজরুল চাচার সাথে হৈ চৈ করছে। এসময় হঠাৎ একজনের,চোখ পড়লো সাদিয়ার দিকে।
'আরে অইত্তো জামা। অই মাইয়া জামা খোল। '
সাদিয়া দৌড়ে তার মা'র কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। 'মা , মা আমার জামা খুলে নিতে চায়। '
সাদিয়ার মা যথাসাধ্য বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেন, 'আপনারা কেমন লোক।
এইটুকু একটা জামার জন্য পাগল হয়ে গেছেন। মেয়েটা জামাটা পড়ছে, তার শরির থেকে খুলে নিতে চান। '
'ওই বেডি, বালা মাইনষের মতন জামা খুইল্লা দে। নাইলে তোরে সুদ্দা থাপরাইয়া জামা লইয়া যামু। ' ষন্ডা মতো লোকটা বললো।
সাদিয়ার মা জানেন এরা মহল্লার প্রভাবশালী লোক। টাকা আছে। আবার অস্ত্রও আছে। এরা ঠিকই তাকে অপমান করতে পারে। মন না চাইলেও অপমানের ভয়ে তিনি মেয়ের শরির থেকে জামা খুলে দিলেন।
'দে মা, দিয়ে দে। আমি তোকে জামা বানিয়ে দেবো। '
'মা..' সাদিয়া দিতে চাইছিলো না। ওর মা জোর করে খুলে জামা দিয়ে দিলেন। জামাটা নিয়ে চলে যাচ্ছে লোকগুলি।
ঝাপসা চোখে সেদিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকলো সাদিয়া। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। জামাটা দিয়ে সাদিয়াকে জড়িয়ে অঝোড়ে কাঁদছেন মা-ও। গরিব হয়ে জন্মালে প্রতিনিয়ত এমন নির্মমতা সহ্য করতে হয়। তিনি জানেন।
সাদিয়া জানতো না। #
শরীফ উদ্দিন সবুজ
নারায়ণগঞ্জ।
মোবাইল ফোন: ০১৯১৩৩৯৮২২০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।