ভাল আছি
প্রতিদিনের মত আজও সকালে না খেয়েই বাসা থেকে কোনো রকমে দৌড়ে এসে অফিসের গাড়িতে উঠেছে শামিম। রোজই গাড়িতে উঠেই একটা ঘুম দেয় । কিন্তু আজ কেনো জানি ঘুম আসছেনা। এরকম অবস্থায় খুব মেজাজ খারাপ লাগে। আজ অবশ্য ঠিক তা লাগছেনা।
এক কাপ চা খেতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব নয় তাই অবশেষে পেপারের দিকে মনোযোগ দিল। অফিসের এই উদ্যোগটা পছন্দ হয়েছে শামিমের। ওর মত যারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অফিসে যায়না তারা সকাল সকাল বেশ আপডেট হয়ে যেতে পারে। মিডিয়া জগতে আপডেট থাকাটা খুব জরুরি।
শামিম অবশ্য ব্যাতিক্রম। ওকে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবেনা এবছর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে গোল্ড মেডেল পেয়েছে। চাকরিটা কষ্ট করে খুঁজে নিতে হয়নি। চাকরিই ওকে খুঁজে নিয়েছে। আর তাই হয়ত এই বাজারে চাকরির দাম টা ঠিক জানা হয়ে ওঠেনি।
পেপার পড়তে পড়তে হঠাৎ পাশে তাকিয়েই দেখে সেই গাড়িটা। হোটেল ব্রীজটাউন ইন্টারন্যাশনালের এই গাড়িটা শামিম প্রায়ই দেখে অর্থাৎ যেদিনই গাড়িতে ঘুম আসেনা আর কি। গাড়িটা সম্ভবত এয়ারপোর্টে যায়। প্রতিবারই খিলখেতের কাছে কোথাও এসে অফিসের গাড়ি ঐ গাড়িটাকে ওভারটেক করে চলে যায়। শামিম ঠিক করেছে ব্রীজটাউনের এই হোটেল থেকে এয়ারপোর্টে ট্রান্সপোর্ট ফাসিলিটির ওপর একটা প্রতিবেদন করবে।
বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছা শামিমের অনেক দিন থেকেই। সেই ফার্স্ট ইয়ারে একটা প্রজেক্ট করেছিল। তখন একটা টুরিজম এর সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। আজ গাড়ীটাকে যতদুর সম্ভব ফলো করবে শামিম। এবার ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গিয়েছে।
গাড়িতে সব বিদেশি সাদা চামড়ার লোক, সেজন্যই হয়তবা এত ফাসিলিটিজ। গাড়িটা কিন্তু অনেক সুন্দর। অফিসের গাড়িটা একটুও মানাচ্ছেনা ঐ গাড়িটার পাশে। গাড়িতে এক ভদ্রমহিলাকে দেখা যাচ্ছে । এক্কেবারে প্রিন্সেস ডায়নার মত সুন্দর, অথবা পৃথিবীর সকল সুন্দরি রমনীকে শামিমের প্রিন্সেস ডায়নার মত মনে হয়।
আসলে শামিমের ধারনা সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা আর মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতা সবগুলো কোনো মেয়ের মধ্যে একসাথে থাকা সম্ভব নয়, আর এর একমাত্র ব্যাতিক্রম প্রিন্সেস ডায়না।
অফিসে যেয়েই চা হাতে নিয়ে শামিম পাশের ডেস্কের ফারদিনার সাথে গাড়িটার গল্প করে। গাড়িতে এক টাকওয়ালা লোকের মাথায় রোদ পরে কেমন চকচক করছিল, এমন টাকওয়ালা লোকের সাথে ফারদিনার বিয়ে হলে কেমন হবে এই সব দুষ্টামি আর কি। এই দুষ্টামি গুলোর জন্যই অফিসে ওকে সবাই খুব পছন্দ করে।
আজ অফিসের গাড়িতে উঠার পর থেকেই মাথায় ঘুরছে হোটেল ব্রীজটাউনের গাড়িটা।
আজ নিশ্চই একই সময় থাকবেনা গাড়িটা,এটাই তো স্বাভাবিক। রোজ রোজ একই সময় কি আর ফ্লাইট থাকে। এর মধ্যেই শর্মির ফোন আসায় মাথা থেকে গাড়ির বিষয়টা সরে গিয়েছে। ঠিক এমন সময় হঠাৎ পাশে তাকিয়ে শামিম একটু অবাক হয়ে গেল। গাড়িটা ঠিক পাশাপাশি চলছে।
শামিমের অবাক হওয়াটা আরেকটু বেড়ে গেলো যখন দেখলো পেছনের সিটে কালকের ঐ টাকওয়ালা বসে আছে। মাথার মধ্যে ঘুরছে প্রিন্সেস ডায়না। কিন্তু প্রিন্সেস ডায়না হয়তো কালকেই ঢাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু তাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। না দেখা যাচ্ছেনা।
জানালা বরাবর পাশের সিটে বসে আছে এক প্রৌঢ়া। তার দিকে এত মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে সামনের সিট থেকে সাব্বির ভাই টিপ্পনী কাটলেন। তাই অবশেষে পেপারেই মনোনিবেশ।
রাতে বিষয়টা নিয়ে শর্মির সাথে একটু আলাপ করা দরকার। কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
হয়ত কিছুই না, ওটাও হয়ত কোনো অফিসের গাড়ি। এমনও হতে পারে,ঐ গাড়ির লোকজনও ঠিক একই জিনিস ভাবছে । এভাবেতো আগে ভাবিনি। এবার বেশ মজা লাগছে। যা হোক মাথাটা এবার একটু হালকা হয়েছে।
কখন ঘুমিয়ে পরেছে নিজের অজান্তে, শর্মিকে আর ফোন করা হয়নি। ইদানিং সকাল সকাল অফিস যেতে হয় তাই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে অথচ আগে মনে হত এত তাড়াতাড়ি মানুষ কিভাবে ঘুমায়।
পাশের গাড়িটার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে শামিম। আজ প্রয়োজনে ড্রাইভারকে বলে গাড়িটার পাশাপাশি চলতে হবে। আজ ও জানালা বরাবর সিটে ঐ বয়স্ক মহিলা,পেছনের সিটে চকচকে টাকওয়ালা ভদ্রলোক।
হঠাৎ দেখে মহিলার গলাটা কাটা,মাথা নেই আর হাতটা লম্বা হয়ে বের হয়ে এসে ঢুকছে শামিমের দিকে। ভয়ে সাব্বির ভাইকে ডাকতে যাবে এমন সময় দেখে কোথায় সাব্বির ভাই কোথায় ড্রাইভার, গাড়িতে সব গলাকাটা মানুষ। চারিদিকে শুধু রক্ত। মহিলার হাতটা শামিমের গলার কাছে আসতেই শামিমের ঘুমটা ভেঙে গেলো। যাক এ যাত্রায় বেঁচে গিয়ে ভালোই লাগছে।
মাঝরাতে শর্মিকে ফোন করলে ওকি রাগ করবে? করলে করুক ,বিষয়টা কারো সাথে শেয়ার করা দরকার।
বাসা থেকে বের হবার সময় বুদ্ধি এলো বাইক নিয়ে রওনা দেয়ার। অফিসের গাড়ি থেকে ঠিকভাবে ফলো করা যায়না। আর শর্মিও আজকে ব্রীজটাউনে যাবে। আর কোনো রাতের ঘুম নষ্ট করতে রাজি না শামিম, কাল রাতে ঘুম ভেঙে অসম্ভব ভয় পেয়েছে সে।
বার বার ঘড়ি দেখছে শামিম, প্রতিদিন এই সময়ই গাড়িটা আসে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলনা। শামিমও সাথে সাথে বাইকে স্টার্ট দিয়ে রেডি। আজও পেছনে সেই চকচকে টাক, আস্তে করে গাড়িটার বাম পাশে এগিয়ে গেলো। বয়স্ক মহিলা তাকিয়ে আছে শামিমের দিকে।
পরিচিত মানুষের দিকে মানুষ যেভাবে তাকায় অনেকটা সেরকম চাহুনি। হালকা একটা হাসির আভা চেহারায়। আশেপাশের সিটের মানুষগুলোকেও আগের দিনের মতই লাগছে। এই ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক লাগে ,অফিসের গাড়িতে কেউই তো রোজ একই সিটে বসেনা। মাথার ভিতরে ঘুরছে সেই সুন্দরি রমনী।
এবার ঘুরে গাড়িটার ডান পাশে যাবার চেস্টা করছে কিন্তু ফ্লাইওভারের উপরে পাশাপাশি যাওয়া যাচ্ছেনা। পিছু পিছু ছুটে চলছে, আজ কোনো ভাবেই গাড়িটাকে হাড়িয়ে যেতে দেবেনা।
শর্মি আজ একটু সকাল সকাল বেড়িয়েছে বাসা থেকে। ব্রীজটাউন হয়ে তারপর অফিসে যাবে। ব্রিজটাউনের রিসিপশনে কেউ গাড়িটার কথা বলতে পারছেনা।
এয়ারপোর্টে ট্রান্সপোর্ট তারা দেয়না তা ঠিক নয়, দেয় তবে সেটা খুব ভি আই পি কোনো গেস্ট থাকলে। ইনফ্যাক্ট গত ছয়মাসে এরকম কোন ট্রান্সপোর্ট দেয়া হয়নি।
শর্মি: আপনাদের হোটেলের বাসগুলো কি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার হয়, বা অন্য কোনো কোম্পানিকে আপনারা কি ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস দেন?
রিসিপশনিস্ট: আসলে আমাদের হোটেলে কোনো ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হলে আমরা ভি আই পি গেস্টদের এয়ারপোর্টে ট্রান্সপোর্ট দিয়ে থাকি। আর মাঝেমাঝে গেস্টদের আমরা সোনারগাঁ বেড়াতে নিয়ে যাই।
শর্মির মাথায় কিছুই আসছেনা।
হোটেল থেকে বের হতে যেয়ে শর্মি থমকে দাঁড়ালো। আকাশি রঙের দুইটা বাস থেমে আছে। কিন্তু শামিম তো বললো সাদা রঙের বাস। আবার ভিতরে গেলো শর্মি, নিশ্চই কিছু ঘটনা আছে যা এরা লুকাতে চাচ্ছে। এবার নিজের পরিচয় দিল শর্মি।
সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার সাথে সাথেই কাজ হয়ে গেলো। সরাসরি ম্যনেজারের রুমে। ভদ্রলোক ফরেইনার, সবকথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং শামিমকে গাড়িটার পিছু নিতে নিষেধ করলেন। শর্মির আগ্রহ আরো বেরে গেলো। বিস্তারিত জানতে চাইতেই ভদ্রলোক একটু রেগেই গেলেন।
শামিম আজকেই গাড়িটার পিছু নেবে বলতেই উদ্বেগের কন্ঠে বলে উঠলেন, আগে আপনার বন্ধুকে থামান । প্লীজ কল হিম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন উনি হয়ত এতক্ষনে অনেক দুর এগিয়ে গিয়েছেন। ভদ্রলোক কিভাবে জানলেন শামিম এগিয়ে গিয়েছে। শর্মি নিজেও তো জানেনা শামিম এখন কোথায়।
শর্মি ফোনের পর ফোন দিচ্ছে। কিন্তু গাড়িটা এত বেশি স্পিডে চলছে যে ফলো করাটা রীতিমত কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ফোন ধরতে গেলেই হয়ত গাড়িটা অন্যদিনের মত হারিয়ে যাবে। রেল ক্রসিংয়ে যদি গাড়িটা থেমে যেত তাহলে সবচেয়ে ভাল হত। কিন্তু সময়মত কি আর রেল ক্রসিং পরে।
রেল ক্রসিং পরে অসময়ে যখন অফিসের তারা থাকে। এত স্পিডে গাড়ি চালাতে রীতিমত ভয় লাগছে। অনেক কস্টে গাড়ির ডান পাশে চলে এসেছে। অবশেষে দেখা মিলল সেই রমনীর। এত স্পিডে চলা গাড়ির মধ্যে অবলীলায় হেটে যাচছে সামনের দিকে।
একটা ফাইল নিয়ে আবার পিছনের দিকে ফিরছে। একফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। শামিম বুঝতে পারছেনা এতক্ষনে ড্রাইভারেরতো অন্তত বোঝার কথা একজন গাড়িটা ফলো করছে, তাহলে গাড়ি থামাচ্ছেনা কেনো? গাড়িটা খিলখেত পার হয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা গাড়ির একদম পিছনে চলে এসেছে। শামিম ও গাড়ির ঠিক পিছনে।
ভদ্রমহিলা পিছনের দিকে তাকাতেই শামিমের সাথে চোখে চোখ পড়ে গেল। শামিমের মনে হচ্ছিল পৃথিবির সবচেয়ে সুন্দরি রমনীর চোখে চোখ রেখে এভাবে অনন্তকাল পেড়িয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ সামনের গাড়িতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হল। সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। মহিলার মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে উপরের দিকে ছুটে যাচ্ছে, সারা শরীরে আগুন।
অনেক কস্টে ব্রেক করতে গিয়ে শামিমের বাইক রাস্তার পাশে ছিটকে পড়েছে। শামিমের আর কিছুই মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন বুঝতে কস্ট হলনা যে সে এখন ইন্টেনসিভ কেয়ারে। কথা বলার মত শক্তিও পাচ্ছিলোনা। খবর পেয়ে প্রথম শর্মি এলো।
মা কিছুক্ষন আগেই বাসায় গিয়েছে।
শর্মি: যাক বাবা এ যাত্রায়ও বেচে গেলি। তোর আগে যারাই ঐ গাড়ির পিছু নিয়েছে কেউই বাঁচেনি। তোর তো দেখি কৈ মাছের প্রাণ।
শর্মির বর্ণনায় যা বোঝা গেলো তাতে প্রায় ৩৫ বছর আগে একটা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স শেষে ভি আই পি গেস্টদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাচ্ছিল গাড়িটা।
এয়ারপোর্টের কাছাকাছি গিয়ে গাড়িটায় বিস্ফোরণ হয়।
এরপর অনেকেই ঠিক সকালের ঐ নির্দিষ্ট সময়ে গাড়িটাকে ঐ রাস্তায় যেতে দেখছে। ব্রীজটাউনে যোগাযোগের পরও যারা সাহস করে গাড়িটার পিছু নিয়েছে, সবারই আ্যক্সিডেন্ট হয়েছে একই জায়গায়। অনেকটা কপালের জোড়েই বেঁচে গিয়েছিস তুই।
কথা শেষ করে শর্মি যখন বেরিয়ে যাবে শামিমের দিকে তাকিয়ে মনে হল আরো কি যেন জানতে চায় সে।
শর্মি একটু হেসে দিয়ে বলল তোর সেই পৃথিবির সেরা সুন্দরি রমনী ব্রীজটাউনের ম্যানেজার মিঃ ডিসুজার ওয়াইফ মিসেস মিশৌরি ডিসুজা। আর তিনি এখন বেঁচে থাকলে বয়স হত প্রায় সত্তুর। কি ভাবতে কস্ট হচ্ছে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।