সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডটি সম্পর্কে পড়ে খুবই ব্যথিত হয়েছি। পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে খুন করেছে তাদেরই সন্তান ঐশী রহমান (১৭)। জানতে পেরেছি হত্যার আগে মেয়েটি তার অভিভাবককে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল। নিজের মা-বাবাকে হত্যা করার বিষয়টি অকল্পনীয়। কিন্তু ঐশী ইয়াবায় আসক্ত ছিল। তাই তো অভিভাবকদের হত্যাকাণ্ডের সময় কোনো মূল্যবোধ বা নৈতিকতা কাজ করেনি কিশোরীটির মধ্যে। পাঠক, এ ধরনের ঘটনা দেশে নতুন নয়। এর আগেও মাদকাসক্ত সন্তানের দ্বারা অভিভাবকদের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে উদ্বেগের বিষয় এই যে, এ ধরনের ঘটনাগুলো আগের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে চার দশকের বেশি সময় ধরে মাদকের ব্যবহার হচ্ছে। মাদকাসক্তের সংখ্যা হয়তো এখন লাখ থেকে কোটি ছাড়িয়েছে। তবে মাদক সেবনকারী ও মাদকে আসক্তি দুটি ভিন্ন বিষয়। যারা মাদকে আসক্ত তারা দীর্ঘ সময় ধরে মাদক গ্রহণ করে। দীর্ঘ সময় ধরে মাদক সেবনের ফলেই একজন ব্যক্তির মধ্যে মাদকাসক্তির বৈশিষ্ট্য বাড়তে থাকে। মাদকাসক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে কৈশোরে প্রথমে দু-একটি সিগারেট দিয়ে শুরু হলেও ক্রমেই সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত বন্ধুদের পাল্লায় হালকা মাদকদ্রব্য গ্রহণ অতঃপর ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সে শুরু হয় 'হার্ড কোর ড্রাগ' সেবন। সে সময় একজন মাদকসেবী ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন ইত্যাদি সেবন করতে শুরু করেন। তবে বর্তমানে মাদক ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। ৫-৬ বছর আগেও মাদকাসক্তদের মধ্যে ফেনসিডিল ও হেরোইনের ব্যবহার বেশি ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানসহ অনান্য মাদক চালানকারী দেশগুলোতে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে মাদকের চালান কমে গিয়েছে। এ অবস্থায় দেশে সহজলভ্য সিনথেটিক বা অর্গানিক মাদকের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। মাদক নিরাময় হাসপাতালগুলোতে গিয়ে দেখা যাবে যে, আসক্তদের ৭০ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। মূলত স্কুল ও কলেজগামীদের টার্গেট করে ইয়াবা তৈরি করা হয়। ইয়াবা আকৃতিতে ছোট, এর গন্ধ স্ট্রবেরির মতো, দেখতেও রঙিন এবং আকর্ষণীয়। ফলে কম বয়সীরা সহজেই ইয়াবায় আসক্ত হয়। অন্যদিকে ইয়াবা অতিমাত্রার আসক্তিজনক একটি বড়ি। এর অল্প সেবনেই আসক্তি জন্মে। সেবনের পর সেবনকারীরা গল্প করতে, উচ্চ শব্দে গান শুনতে পছন্দ করে। আতঙ্কের বিষয় এই যে, প্রথমে ১টি ট্যাবলেট খাওয়ার পর একজন সেবনকারীর মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তা পুনরায় অনুভব করতে সেবনকারীরা আরও বেশি ইয়াবা সেবনে আগ্রহী হন। সেবনকারীর মধ্যে সেবনের 'টলারেন্স ডেভেলপ' করলে একসঙ্গে ৫-৬টি ইয়াবা খেতে চান। কিন্তু ক্ষণিক আনন্দ ফুর্তির জন্য ইয়াবার জগতে একবার প্রবেশের পর সেবনকারীর পক্ষে সে জগত থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। ইয়াবা সেবনকারীদের নিদ্রাহীনতা, গা ব্যথা ও হতাশা বেড়ে যাওয়াসহ অনান্য উপসর্গ দেখা দেয়। তবে টলারেন্স ডেভেলপ করার আগেই যদি নতুন সেবনকারী একসঙ্গে ৮-১০টি ইয়াবা সেবন করেন তাহলে কখনো কখনো তার মৃত্যুও হতে পারে। ভারতের কিংস কলেজের সহায়তায় এক গবেষণায় জানা যায় যে, অতিমাত্রার ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে 'সাইকোসিস' নামক মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে ২৫% রোগীর মধ্যেই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়। এ অবস্থায় একজন রোগী ঘরের মধ্যে থেকেও মনে করেন যে, বাইরে থেকে কেউ তাকে অনুসরণ করছেন। সে কারণে তিনি ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখেন। রোগীর মধ্যে এমন ধারণা জন্ম নেয় যে, তার পরিবারের সদস্যরাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। অর্থাৎ সাইকোসিস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এক ধরনের হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়। আর এ রোগে আক্রান্তরা খুন করার মতো ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধাবোধ করেন না। এ অবস্থায় রোগীরা মনে মনে কথা বলেন। তার মধ্যে দ্বৈত সত্তার জন্ম নেয়। তখন মন থেকে তারা যে নির্দেশ পান সে অনুযায়ীই কাজ করেন। ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেন। নিজের মনের দেওয়া নির্দেশ অমান্য করা সাইকোসিস আক্রান্ত রোগীর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঐশী যেহেতু মাদকে আক্রান্ত ছিল সে কারণে তার অভিভাবকদের উচিত ছিল তাকে মাদক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চিকিৎসা করানো। এমনকি বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও উচিত হবে মেয়েটির মানসিক ভারসাম্য সঠিক আছে কিনা এবং তার মধ্যে মাদকাসক্তির কোনো লক্ষণ রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা। তবে মাদকাসক্ত অভিভাবকদের বলতে চাই যে, শারীরিক শাস্তি বা শাসন করে মাদকাসক্তদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসাই প্রতিরোধের একমাত্র পথ। অর্থাৎ এ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো মাদকাসক্তদের ঘরে আটকে রেখে কোনো প্রতিকার মিলবে না। সে কারণেই ঐশীর মা-বাবাকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ধারণা করছি যে, ঐশী নিশ্চয়ই কয়েক বছর ধরেই নেশা করে আসছিল। সে ক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত ছিল তার চিকিৎসা করানো। এটি পরীক্ষিত যে, শারীরিক শাস্তি প্রয়োগে মাদকাসক্তরা মাদক পরিহার করেন না। কারণ এটি একটি মানসিক রোগ। মতিষ্কে যার তীব্র প্রভাব কাজ করে। নেশা সহজলভ্য হওয়ায় দেশের ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাদকদ্রব্য সাপ্লাই বন্ধ করার বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। সন্তানরা কাদের সঙ্গে মিশছে এবং মাদক খাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। মাদকদ্রব্য সেবন করলে সংশ্লিষ্টদের কাছে কাউন্সিলিং করাতে হবে। অভিভাবকদের যদি তার সন্তানের আচরণ নিয়ে সন্দেহ হয় তবে সে ক্ষেত্রে সন্তান মাদক গ্রহণ করছে এটি স্বীকার করবে না। তবে তাকে যদি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে পরীক্ষা করানো হয় সহজেই এর প্রমাণ মিলবে। অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে, চিকিৎসা করানো গেলে মাদকাসক্তি নিরাময়যোগ্য একটি রোগ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন মাদকে আসক্ত হন। এ ১০ জনের জেনেটিক্যালি মাদক পরিহার করার মতো মানসিক শক্তি থাকে না। সাধারণত একজন ব্যক্তিকে তার জিন ও পারিপার্শি্বক অবস্থা মাদক গ্রহণে প্রভাবিত করে। মাদকাসক্তরা চিকিৎসার জন্য সাধারণত চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। তবে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সন্তানদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।