আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাত্রার মাত্রাহীন সংকট এবং প্রসঙ্গ নীতিমù

দুঃখ-কষ্ট, হতাশা, অনিশ্চয়তা, সীমাহীন দুর্গতি- এ সবই যেন যাত্রার ললাট লিখন। সেই ঔপনিবেশিককালে যখন ইংরেজ সরকার মুকুন্দ দাশের স্বদেশী যাত্রা বন্ধ করে দিয়েছিল, জারি করেছিল একটি সংস্কৃতিবিরোধী কালাকানুন (ইবহমধষ চষধপবং ড়ভ চঁনষরপ অসঁংবসবহঃ অপঃ, ১৯৩৩), সেই সময় থেকেই নানা মাত্রিক সংকটে বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যাত্রার যাত্রাপথ। জীবিকাশ্রয়ী শিল্প হিসেবে সংস্কৃতির দুটি বড় মাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র ও যাত্রা। চলচ্চিত্রের ধারা প্রবাহমান। কিন্তু যাত্রার অবস্থা ম্রিয়মাণ। কখনো ভাসে। কখনো ডোবে। 'যাত্রা' আমাদের জাতীয় নাট্যধারা, যা আমাদের সংস্কৃতির বিকাশের জন্যই জরুরি। পরিতাপের বিষয় এটাই যে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা কখনো এই 'জরুরি' বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেননি। সরকার, প্রশাসন এবং মহল বিশেষের ঔদাসীন্য ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অতীতে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ প্রায় অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর ২০০৯ সালে গঠিত নতুন সরকারের আমলে যাত্রা কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়। স্বাধীনতার ৪২ বছরের মাথায় যাত্রার জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করে সরকার বাস্তবিকই এক্ষেত্রে এক উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু নীতিমালা-পরবর্তী অবশ্য করণীয় কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন যাত্রাসংশ্লিষ্টরা।

যাত্রাশিল্পে বহুমাত্রিক সংকটের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল বিগত কয়েকটি সরকারের আমলে। তার মধ্যে একটি নিষেধাজ্ঞা। বাংলাদেশে যাত্রার ওপর প্রথম সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞার সার্কুলার জারি হয় ১৯৮৪ সালের ১৭ অক্টোবর। এরপর ১৯৮৫ সালের ১০ জানুয়ারি। ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে আরও একটি সার্কুলার আসে। সার্কুলারগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয় ডিসি অফিসে। ফলে সঙ্গত কারণেই যাত্রা প্রদর্শনীর অনুমতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাত্রানুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞার ভয়ালরূপ আমরা দেখি ১৯৯১ থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে। আশা করা হয়েছিল, '৯০-এর আন্দোলনের পর নির্বাচিত সরকারের আমলে যাত্রার সুদিন আসবে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। '৯১-এর মার্চ মাসে সরকার গঠনের মাত্র সাত মাসের মাথায় ৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সার্কুলারে সারা দেশের আলো ঝলমল যাত্রা মঞ্চগুলো একে একে নিভে যায়। হঠাৎ এ ধরনের আদেশের ফলে হাজার হাজার যাত্রাশিল্পীর জীবন-যাত্রা নেমে আসে মানবেতর পর্যায়ে। লাগাতার আন্দোলনের ফলে ৩৩ দিন পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সরকার। কিছুদিন পর আবার নিষেধাজ্ঞা, আবার আন্দোলন। এভাবে ১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দফায় দফায় মোট ছয় বার যাত্রাশিল্পে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। নিষেধাজ্ঞা জারির কারণে ওই সরকারের আমলে দেশে যাত্রা প্রদর্শনী বন্ধ ছিল ১০১৪ দিন। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকারও বেশি। তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর নির্দেশেই এভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল বারবার। তারই উত্তরসূরি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের আমলে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা জারি হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সংস্কৃতি অঙ্গন। রাজপথে যাত্রাশিল্পীদের আন্দোলনে কামাল লোহানী ও মামুনুর রশীদের মতো সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বরা সোচ্চার হন। কয়েকটি সংবাদপত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতি প্রক্রিয়ায় অহেতুক কিছু প্রশাসনিক জটিলতা দেখা যায়। প্রচলিত ব্যবস্থা এটাই যে, যাত্রা প্রদর্শনীর অনুমতি প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মহানগর এলাকার জন্য পুলিশ কমিশনার এবং জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠানের জন্য জেলা প্রশাসককে। তবে অনুমতির জন্য এসপি, এএসপি, টিএনও এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মতামতের প্রয়োজন হয়। এসব মতামত প্রক্রিয়া থেকেই জটিলতার সৃষ্টি। ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদে প্রায় কর্মকর্তা লিখে দেন, এলাকার পরিস্থিতি খারাপ। অনুমতি দেওয়া সমীচীন হবে না। তবে বর্তমান লেখকের অভিজ্ঞতা, এক শ্রেণীর পুলিশকে 'খুশি' করতে পারলে তেমন অসুবিধা হয় না। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এনডোর্সমেন্টের কড়াকড়ি। দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা অবদমনের লক্ষ্যে ইংরেজ সরকার ১৯৩৩ সালে বেঙ্গল প্লেসেস অব পাবলিক অ্যামিউজমেন্ট নামে যে আইনটি চালু করেছিল, বাংলাদেশে এখনো তা বলবৎ। এর ৬নং উপ-ধারায় এসেছে এনডোর্সের বিষয়টি। এক জেলা থেকে আর এক জেলায় যাত্রা করতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন থেকে ওই দলের লাইসেন্স এনডোর্স করাতে হয়। এতে অবশ্য সরকারিভাবে একটা ফি ধার্য আছে। তবে দলমালিকের কাছ থেকে অযৌক্তিভাবে অনেক বেশি আদায় করা হয়। প্রত্যেক জেলা প্রশাসনে রয়েছে এলআর ফান্ড অর্থাৎ লোকাল রিক্রিয়েশন ফান্ড। যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচসহ বাণিজ্যিকভাবে আরও কিছু অনুষ্ঠান হলে এ ধরনের তহবিলের জন্য টাকা-পয়সা গ্রহণ করা হয়। নির্ধারিত টাকার পরিমাণ এক এক জেলায় এক এক রকম। যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতির জন্য মতামত সংগ্রহ, এলআর ফান্ড আর এনডোর্স বাবদই বিপুল অঙ্কের টাকা চলে যায়। এরপর আছে প্যান্ডেল নির্মাণ, দল বায়না করা, স্থানীয় প্রভাবশালীদের জন্য চাঁদা এবং থানা-পুলিশের বখরা। বিভিন্ন খাতে এ অসম্ভব ব্যয় মেটানোর জন্য কখনো কখনো আয়োজকদের কিছু বাড়তি 'উপকরণ' যুক্ত করতে হয়। তবে এটি যাত্রা থেকে একটি বিচ্ছিন্ন বিষয়। বিকৃতরুচির প্রদর্শকরা এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে যাত্রানুষ্ঠানের নামে অশালীন নৃত্যগীতের ব্যবস্থা করে থাকে। এই বিকৃতির সঙ্গে যাত্রাশিল্পীদের আদৌ কোনো যোগাযোগ নেই। ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেখেছি, সরকার আসে সরকার যায়। সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে কিছু না কিছু 'সরকারি দৃষ্টি' পড়ে। কিন্তু যাত্রা চলে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির মতো। যাত্রা যে আবহমান বাংলার এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শিল্পটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো যায়- এসব বিষয় সম্পর্কে উদাসীন থেকেছেন রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু যাত্রা আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, এর ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে- এই প্রত্যয় নিয়ে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ ৭ দফা দাবি জানায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীকে। সেই থেকে শুরু যাত্রা নীতিমালা প্রণয়নের কাজ। বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও চড়াই-উতরাইয়ের পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে 'যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা' গেজেটভুক্ত হয় ২০১২ সালের আগস্টে। নীতিমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালককে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের যাত্রাশিল্প উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে এ পর্যন্ত ৫১টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন করা হয়েছে। সংস্কৃতি সচিব সুরাইয়া বেগম এনডিসি স্বাক্ষরিত 'যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০১২' প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয় ওই বছরের ৭ আগস্ট। ১২টি অনুচ্ছেদ সংবলিত এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী যাত্রাচর্চার উন্নয়ন, বিকাশ ও প্রসার, সুস্থ ও সৎ যাত্রাচর্চার বহমান ধারাকে আরও সমৃদ্ধ এবং বেগবান করা, উপযুক্ত যাত্রাদল ও যাত্রাশিল্পী গড়ে তোলা, একটি সৃষ্টিশীল পেশাভিত্তিক কর্ম হিসেবে যাত্রাকে প্রতিষ্ঠিত করা। যাত্রাশিল্পের ঐতিহ্যগত পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং বিদ্যমান সংকট নিরসনে যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালার বাস্তবায়নের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি। বর্তমান সরকার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যাত্রার উন্নয়নে কিছু ভালো কাজ করেছে। একাডেমির নিজস্ব অনুষ্ঠানমালায় যাত্রা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একাডেমির প্রযোজনায় যাত্রাপালা 'ঈশা খাঁ' এবং যাত্রাপালাকারে মুনির চৌধুরীর 'রক্তাক্ত প্রান্তর' মঞ্চায়িত হয়েছে। ২০১১ সালে সরকারের অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে যে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়, শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগের ফলে যাত্রাশিল্প খাতেও বরাদ্দ মঞ্জুর হয়েছিল। নীতিমালা বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে আরও দুটি কাজের সুপারিশ করার দাবি জানিয়েছেন যাত্রাশিল্পীরা। একটি হচ্ছে- জাতীয় যাত্রামঞ্চ প্রতিষ্ঠা, আরেকটি আবৃত্তি বিভাগের মতো পৃথক যাত্রা বিভাগ খোলা। এসব সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বিগত দিনের সব হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানি ধুয়েমুছে শুরু হতে পারে যাত্রার নবযাত্রা।

লেখক : যাত্রাব্যক্তিত্ব ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.