মানবতাই ধর্ম !
বৈশাখ মাস,চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি। সাবের চাচা এসে বললেন-“বাবা,হুনলাম ঢাকায় নাকি গোন্ডগোল হইতাছে?”
-জ্বী চাচা,অবস্থা বেশী ভালা মনে হয়না।
“বাবা আমার পোলাডা তো ঢাকায় কাজ করে,ওর একটু খবর আইনা দিতে পারবা”?
-চাচা,আসলে আমি তো কোনদিন ঢাকায় যাই নাই,আপনে বরং আজিজ ভাইরে কন। উনার তো অনেক জানাশুনা।
এই বলে আমি চা’টা শেষ না করেই বাড়ির পথে ছুটলাম।
রাতে দেখি বাবা রেডিও নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।
আমাকে দেখে বললেন-“দেখতো খবরটা ধরা যায় নাকি”।
আমি টিউন করেই গমগমে আওয়াজ শুনতে পেলাম।
কয়েকটি জায়গায় আগুন দেয়ার খবর শুনে বাবা বললেন-“অবস্থা তো বেশী ভালা ঠেকে না”।
আমি কিছু না বলে উঠে গেলাম।
পরদিন বিকেলে শহিদ ভাইয়ের সাথে বাজারে দেখা,বললেন-“বেডা তোরে তো দেহাই যায় না,আস্তাদিন কী ঘরেই থাহস নাকি”?
আমি জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলাম,জিজ্ঞেস করলাম-“চাচী আম্মা ভাল আছেন”?
শহিদ ভাই মাটির নিচে তাকিয়ে বললেন-“মার শরীরডা ভাল না”।
-গঞ্জে গিয়া ঔষধ নিয়া আও,মইনুদ্দি কবিরাজের ঔষধে কামে দেয়।
“হুন, তোর লগে কথা আসিলো”।
-কও,কী কইবা।
“অহন না, সন্ধ্যা নামলে নামায পইড়া কাশেমগো বৈঠক খানায় আইস”।
মাগরিবের নামায পড়ে কাশেম ভাইদের বৈঠক খানায় গেলাম।
গিয়ে দেখি শহিদ ভাই আর কাশেম ভাই সাথে আরও দুইজন অপরিচিত বসে আছেন।
অপরিচিত দুইজনের মাথা মাফলার দিয়ে ঢাকা,মুখ অল্প দেখা যাচ্ছে।
কাশেম ভাই আমাকে বললেন-“দোর-টা দিয়া এহেনে বো”।
আমি দরজা লাগিয়ে সামনে গিয়ে মাদুরে বসলাম।
কাশেম ভাই ঐ দুজনের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
“উনারে মনে লয় আগে দেখতে পারস, উনি বিবিগাঁও এর জসিম ভাই। আর উনি চানপাড়ার সুবলদা”।
আমি দুজনের কাউকেই আগে দেখিনি,তবে জসিম ভাইয়ের নাম আগে শুনেছি। উনি ভাল ফুটবল খেলেন।
সুবলদা কে আমার ভয় করতে লাগল,মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ,একটু পরপর বিঁড়ি ফুঁকছেন।
কাশেম ভাই তাদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ও হইল আমার বন্ধু মিনুর ছোট ভাই শাহেদ। জানেনই তো মিনু গেল বচ্ছর গাঙে ডুইব্বা মরছে”।
সুবলদা ঘাড় নেড়ে বলে উঠলেন-“তোমার ভাই মিনু আমারে খুব মানতো,হে ভাল ছাত্র ছিল বইল্লা তারে খুব মায়া করতাম। তার জানাযায় তো আমি আসছিলাম,কাছে দাঁড়াইয়া তারে মাটি দিসি”।
সুবলদার কথায় আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আসলে আজকাল মিনু ভাইয়ের কথা কেউ বললেই আমার অস্বস্তি লাগে।
-কাশেমদা যদি কইতা কেন ডাকছো।
“হ,এট্টু কামেই ডাকছি। জানসই তো ঢাকায় গোন্ডগোল লাগছে,তয় গোন্ডগোলটা সারা দেশেই ছড়ায় পরতাছে।
প্রত্যেকদিন রেডিওতে গোলাগুলির খবর হুনি। সুবলদা তো ঢাকা ইনভার্সিটির ছাত্র,তিনি বেশ আগেই গোন্ডগোলের জন্য গাঁয়ে চইলা আসছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিজ কানে শুনছেন,রেসকোর্সে তিনি নিজে ছিলেন। এখন কথা হইল যেইডা,আমাগো এইদিকে পাক বাহিনীর আইতে বেশী দেরী নাই। সুবলদার কাছে খবর আসে মুক্তি বাহিনীর জন্য অনেকেই ট্রেনিং নিতে বর্ডার পার হইতে চায়।
আমগো বাঁচতে হইলে ট্রেনিং দরকার। তুই কী আমগো লগে যাবি”?
আমি অবাক হয়ে কাশেমদার দিকে তাকাই। কী বলব ভাবি। এরপর বলি-“দেখো কাশেমদা আমি আসলে ব্যাপারটা ভাল বুঝতাছি না,বর্ডার তো মুখের কথা না। এরপর আব্বা যাইতে দেয়নি হেইডাও একটা ব্যাপার”।
শহিদ ভাই এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন-“দেখ আমরা সবাই মিল্লা ঠিক করছি ঐপাড়ে যামু,কষ্ট হইলেও ট্রেনিং নিতে যাওয়াই লাগবো,কিছু করার নাই। আর আমরা তো একলা না,জসিম ভাই,সুবলদা আছে। উঁনাদের বন্ধুরা আছে,তারা সবাই ইনভার্সিটির ছাত্র,ঢাকায় পলিটিক্স করেন। আর আমরা যদি ট্রেনিং নিয়া আসি তাইলে গাঁয়ের সবার আর চিন্তা নাই।
সবচেয়ে বড় কথা দেশটা স্বাধীন হইব,মেলা সুবিধা হইব,অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করা লাগব না”।
আমি এক মনে শুনে গেলাম কথাগুলি। আসলে আমি ভাবছি শুধু মার কথা আমি গেলে মা থাকতে পারবে তো?
কাশেম ভাইদের বাড়িতে রাতে ভাত খেয়ে বাড়িতে গেলাম,দেখি মা ভাত বেড়ে মাদুর পেতে বসে আছে। আমাকে দেখে মা বললেন-“কীরে,এতো রাইতে কই থাইক্যা আইলি?ভাত বাইড়া বয়া আছি,তোর আব্বা শুইয়া পড়ব অসুস্থ মানুষ”।
-মা একটু কাশেম ভাইগো বাড়িত গেসিলাম।
ভাত খামুনা,খাইয়া আইসি,থুইয়া দাও। আমার কথা শুনে মা উঠে গেলেন।
আমি পা ধুয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকালে ভাত খেতে বসে আব্বাকে বললাম-“আমি যুদ্ধে যাব”।
-“কী বললা?যুদ্ধে যাবা?কেমনে যাবা?যুদ্ধের দরকার কী?হেইডা বড়গো জিনিস,নেতাগো জিনিস,হেরাই করুক।
আমাগো জান দেয়ার দরকার নাই”।
আমি খাওয়া থামিয়ে বললাম-“আমি একলাই না আমার সাথে শহিদ ভাই,কাশেম ভাই, বিবিগাঁও এর জসিম ভাই, চানপাড়ার সুবলদাও যাইবো। আরও অনেকেই যাইতে চায়”।
বাবা সুবলদার নাম শুনে থামলেন। “কে,সুবল যাইব কে?হে না ঢাহায় পড়ালেহা করে।
হের বাপ-মা যাইতে দিবো?
-“সুবলদা নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনছে,উনি থাকলে আর ভয় নাই। আর জসিম ভাইরে তো চিনই,ফুটবল খেলে,উনার অনেক নাম”।
-“তো যুদ্ধে যে যাইবা হেই ট্রেনিং কী তুমাগো আছে?খালি আজাইরা ফাল পারে”।
-“আব্বা আমরা পয়লা ইন্ডিয়া যামু,বর্ডার পার হয়া ট্রেনিং নিমু। উনারা আমাগো সাহায্য করবো।
আর শুনছি কয়দিন পর নাকি আমাগো এইওদিকেও মিলিটারী আইবো”।
আব্বা আমার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন,বললেন-“মিলিটারি এত্তদূরেও আইব”?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম -“আমরা যদি ট্রেনিং নিয়া আই তয় গাঁয়ের মানুষের আর ডর নাই”।
বাবা এরপর আর কথা বললেন না। চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন। বাবা উঠে যাওয়ার পর দেখি মার চোখে অঝোরে পানি পড়ছে।
বললাম-“মা কেঁদোনা”।
কথাটা বলে হতভিহ্বল হয়ে পড়লাম। দেখি মা আরও বেশী কাঁদছে। আমারও চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। মার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম-“মা,তুমি যেমন আমার মা ঠিক তেমনি এই দেশটাও তো আমার মা।
তোমার যদি কিছু হয় আমার আগায় যাওয়াটা যেমনি জরুরী তার চেয়ে কম জরুরী না আমার এখন যুদ্ধে যাওয়াটা”।
-“গেল বচ্ছর মিনু হঠাৎ মারা গেল,আমার জুয়ান পোলাডা!এমনে কী কেউ মরে?এহন তুই যাবি যুদ্ধে। বাবাগো,আমার যে অহন তুই ছাড়া কেউ নাই। তোর কিছু হয়া গেলে আমি তোরে ছাড়া বাচুম কেমনে?”
মার আর্তনাদ শুনে আমি কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। মা সচরাচর আমার জন্য এমন করেন না।
আমি বুঝতে পারছি আমার এভাবে যুদ্ধে যাওয়াটা কেউ মানতে পারছে না। কিন্তু দেশ বাঁচানোর জন্য,দেশের মানুষ বাঁচানোর জন্য আমি এখন যুদ্ধে যেতে মরিয়া। আমি হাত ধুয়ে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলাম। বাইরে এসে আমতলায় বসে ভাবলাম যাই একবার কাশেম ভাইয়ের সাথে দেখা করে আসি।
কাশেম ভাই আমাকে দেখে ইশারা করলেন বাড়ির বাইরে দাঁড়াতে।
কিছুক্ষণ পর এসে বললেন-“কীরে কী খবর”?
-“কাশেম ভাই আমি যুদ্ধে যামু,তয় বাড়িত কেউ রাজী না। তুমি কী একটু সবাইরে বুঝাইবা”?
-“আমার কথা কী হুনবো বেডা”?
-“আমি অহন কী করি”?
-“কাউরেই আর কিছু কওয়ার দরকার নাই,সময় আইলে রওনা দিমু। রেডি থাকিস,আরও কয়েকজনরে রাজী কইরা দুই-এক দিনের মইধ্যে রওনা দিমু”।
আমি বাড়িতে চলে আসলাম। রাতে বাবা ঘরে ঢুকে বললেন রাতে যেন ঘর থেকে বের না হই,দিনকাল ভালনা।
বাবার কথা শুনে মনে হল তিনি চাচ্ছেন আমি যেন যুদ্ধে যাই। হঠাৎ আমার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসল। আমি বর্ডার পার হয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার স্বপ্নে বিভোর। আমার চোখ তখন দেশ স্বাধীন করার স্বপ্নে বিভোর।
তিন দিন পর আমাদের গ্রামের মাঠে শহিদ ভাই আমাকে বললেন রাতে রেডি থাকতে।
সবাই শুয়ে পরলেই আমরা রওনা দিবো। রাত গভীর হতেই আমি একটা পোটলায় আমার তিনটা শার্ট আর দুইটা লুঙ্গী নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলনা। আমি জানি মা আমাকে যেতে দিবে না। মাঠে আমরা নয়জন এক হয়ে পা বারালাম সীমান্তের পথে।
সাথে কিছু টাকা। জমিয়ে ছিলাম কয়েক মাস ধরে। ভাবছিলাম একটা সাইকেল কিনবো,হল না আর কেনা। জানিনা এই অল্প কিছু টাকা দিয়ে কয়দিন চলবে।
[গল্পটা এখানেই শেষ নয়।
গল্পটা উত্তম পুরুষে লেখা পাঠকদের সুবিধার জন্য। শাহেদরা ট্রেনিং শেষ করে ওদের গ্রামে ফিরে গেল। গেরিলা যুদ্ধে শাহেদ অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। সম্মুখ যুদ্ধে শাহেদ ওর পায়ে গুলি খেল,একটা হাত উড়ে গেল গ্রেনেড ছুঁড়তে গিয়ে। যুদ্ধ শেষে শাহেদ বিয়ে করল ওদেরই গ্রামের বীরাঙ্গণা আয়শাকে।
শাহেদরা যখন থানা শহরে একটা অপারেশনে ছিল ঠিক তখনই মিলিটারিরা ওদের গ্রামে আগুন লাগায়, নির্বিচারে হত্যা করে শিশু থেকে বয়স্ক নারী-পুরুষ । আর গ্রামের অল্প বয়স্ক মেয়েদের করে ধর্ষণ। আয়শা তাদেরই একজন। শাহেদের মা-বাবা মিলিটারির হাতেই মারা পরে। আর এতে সহায়তা করে ওদের গ্রামেরই মাওলানা সাহেব যাকে সবাই অত্যন্ত সম্মান করত]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।