আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাদুকা সঙ্কট

এই গল্পটি জুতা লইয়া। কেহ এই গল্পের মধ্যে যদি অন্য কিছু আবিষ্কার করেন এবং তাহা লইয়া চিল্লাফাল্লা করেন, তাহলে আমি তার দায় লইতে পারিব না। অফিসে জুতা লইয়া গণ্ডগোল শুরু করিয়াছিলেন ওহাব সাহেব। অনেকে বলিয়া থাকে গণ্ডগোলটা শুরু করিয়াছেন হানিফ সাহেব। কে গন্ডগোল শুরু করিয়াছিলেন, তাহা লইয়াও একটা গণ্ডগোল হয় মাঝে মাঝে।

ওহাব সাহেব ফাটা কোম্পানীর কালো চামড়ার আট নাম্বার জুতা পরেন। জুতায় ফিতার জন্য দশটা ফুটা আছে। ইহা লইয়া তাঁর গর্বের অন্ত নাই। আহারে বসিযা তিনি স্ত্রীকে মাঝে মাঝে বলেন, "বুঝলা গুলজারের মা, ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জুতা। এতে কোন সন্দেহ নাই।

যারা সন্দেহ করে, তাদের জন্য আমার করুণা হয়। হাসি পায়। " ওহাব সাহেবের স্ত্রী কিছু বলেন না। ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালো জুতা তাঁর পরার কোন প্রশ্নই আসে না, তিনি পরেন স্যান্ডেল। তাই ইহার গুণাগুণ সম্পর্কেও তাঁর কোন বক্তব্য নাই।

ওহাব সাহেব পুত্র গুলজারকেও ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালো জুতা কিনিয়া দিয়াছেন। তাহারা দুইজন সকালে একই সাথে বাটী হইতে বাহির, একই প্রকার জুতা পরিধান করিয়া। দেখিয়া ওহাব সাহেবের বেশ আনন্দ হয়। কী সুন্দর দৃশ্য। বাপবেটার পায়ে একই কোম্পানীর একই রকম জুতা।

ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা। আহা। হানিফ সাহেব ওহাব সাহেবের দীর্ঘদিনের সহকর্মী, তিনি আবার পরেন বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা। বোম্বাই কোম্পানীর জুতার মাপ কিঞ্চিৎ ভিন্ন, রন্ধ্রও দশটার স্থলে বারোটা। কালা জুতা হানিফ সাহেব পছন্দ করেন না, তিনি বাদামী জুতার ভক্ত।

তাঁহার পুত্র দিলদারও বাদামী জুতা পরে, একচল্লিশ নাম্বার, সেই বোম্বাই কোম্পানীর। জুতা পায়ে দিয়া মাঝে মাঝে হানিফ সাহেব তৃপ্ত শ্বাস ফেলেন, আহা, কী জুতা বানাইলো বোম্বাই কোম্পানী! তাঁর পায়ে সেই জুতার স্বাদ অমৃতের মতো মনে হয়। একদিন মুখ ফসকাইয়া এই কথাই বলিয়া ফেলিয়াছিলেন হানিফ সাহেব, "আহা!" ওহাব সাহেব পাশের টেবিলেই ছিলেন, তিনি সহাস্যে মুখ তুলিয়া বলেন, "কী মিয়া, আহাউহু করো ক্যান?" হানিফ সাহেব দুপুরবেলা অফিসে জুতা খুলিয়া টেবিলে পা তুলিয়া বসিয়া কাজ করেন, জুতা তাঁহার পদযুগল হইতে খুলিলেও আরাম লাগে, আবার পরিধান করিলেও আরাম লাগে। তিনি বলিলেন, "বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা, বুঝলা ওহাব, এরা জিনিসও বানাইছে একখান!" ওহাব সাহেব মুখমণ্ডলকে জুতার ন্যায় কালো করিয়া ফেলেন, বলেন, "হানিফ, জুতা শুধু পায়ে দেয়ার জিনিসই না। জুতার মর্যাদা বুঝার চেষ্টা করো।

জুতা মানুষের মান সম্মানের প্রতীক। একে পারলে মাথায় তুলে রাখতাম, খোদার ইশারায় পায়ে দিয়া চলতেছি। শুইনা রাখো, দুনিয়াতে জুতা একটাই আছে ভদ্রলোকের, ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা!" হানিফ সাহেব হাসিয়া উঠেন। "কী যে বলো ওহাব। বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা পায়ে দিয়া দ্যাখো মিয়া, কী আরাম।

জুতা তো জুতা না, জাম্বুরার শরবত!" ওহাব সাহেব নাক সিঁটকাইলেন। "দ্যাখো, ঐসব ফালতু জুতা পায়ে দিয়া তোমার মাথাটা গরম হইছে। ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা পর মিয়া। আমার বড় শালার ক্যানসার ভালো হইয়া গ্যালো এই জুতা পায়ে দিয়া!" হানিফ সাহেব একটু অপমানিত হন শ্যালক তুলিয়া কথা বলায়। "কী যে কও ওহাব।

জুতা হইলো বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা, বাকি সব জুতা নিকৃষ্ট, কমজাত!' ওহাব সাহেব তপ্ত হইয়া উঠেন। "ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা যাদের পায়ে দেয়ার যোগ্যতা নাই, তাদের মুখে জুতা নিয়া বড় বড় কথা মানায় না!" এইরূপে তর্ক প্রবলতর হতে থাকে। হানিফ সাহেব কটাক্ষ করিয়া বলেন, ওহাব সাহেবের পূর্বপুরুষ তো খড়ম পায়ে হাঁটিতো, জুতার মর্ম তিনি বুঝিবেন কীরূপে? ওহাব সাহেব ফুঁসিয়া কহিলেন, হানিফ সাহেবের পূর্বপুরুষ তো মনিবের ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা বগলে লইয়া হাঁটিতো, পায়ে কী দিতে হয় তিনি কীভাবে বুঝিবেন? এক পর্যায়ে প্রবল তর্কাতর্কি, একে অন্যের দিকে ফাইল নিক্ষেপ শুরু হইল। আরেক সহকর্মী কুদ্দুস সাহেব আসিয়া বহুকষ্টে দুইজনকে শান্ত করলেন। "এই বয়সে কী শুরু করলেন আপনারা?" কুদ্দুস সাহেব বিরক্ত হইয়া কহিলেন।

হানিফ সাহেব আর ওহাব সাহেব দুইজনেই যুগপৎ গর্জাইতে থাকেন, কুদ্দুস সাহেব তাঁহাদিগকে ধমকাইয়া নিবৃত করেন। বড় সাহেব হাউকাউ শুনিয়া সবাইকে তলব করেন। ওহাব সাহেব আর হানিফ সাহেব তড়বড় করিয়া গিয়া একজন আরেকজনের নামে অভিযোগ করেন, গণ্ডগোলে কিছুই বোঝা যায় না। বড় সাহেব বিরক্ত হইয়া কুদ্দুস সাহেবকে বলেন, "কী হইয়াছে, বলেন দেখি? কুদ্দুস সাহেব কিছু বলার জন্য মুখ খোলেন, কিন্তু ওহাব সাহেব তাঁহাকে থামাইয়া দ্যান। "সাক্ষী দেয়ার আগে বলেন, আপনি নিজে কোন জুতা পায়ে দ্যান, ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা, নাকি বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা?" হানিফ সাহেবও প্রশ্ন রাখেন, "হ্যাঁ বলেন! আপনি নিজে কোন জুতা পায়ে দ্যান, বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা নাকি ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা?" কুদ্দুস সাহেব বিরক্ত হইয়া বলেন, "সেইটা নিয়ে কথা উঠছে ক্যান? আমি তো জুতানিরপেক্ষ মানুষ, আমি যে-ই জুতাই পায়ে দেই, আপনাদের কাজিয়া নিয়ে তো আর মিথ্যা কথা বলবো না!" ওহাব সাহেব ঠা ঠা করে হাসেন।

"জুতানিরপেক্ষ মানুষ? মানে আপনি ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতাও পরেন, আবার বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতাও পরেন? ছোহ, কী চরিত্রহীন আপনি!" হানিফ সাহেবও জুতানিরপেক্ষতার প্রবল নিন্দা করেন। কুদ্দুস সাহেব বুঝাইবার চেষ্টা করেন, জুতানিরপেক্ষতা মানে ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা আর বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা উভয়ই পায়ে দেয়া নহে, বরং কে কী জুতা পায়ে দিয়া ঘোরে তাহা লইয়া মস্তক ঘর্মাক্ত না করা। জুতা দিয়া মানুষ বিচারের বিরোধী তিনি। ওহাব সাহেব তীব্র আপত্তি তোলেন, কুদ্দুস সাহেবের মতো তথাকথিত জুতানিরপেক্ষর সাক্ষ্য তিনি গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবী করেন। হানিফ সাহেবও সায় দ্যান।

বড় সাহেব কিছুই বুঝিতে না পারিয়া সবাইকে বিদায় হইতে বলেন। ওহাব সাহেব ফিরিয়া গিয়া ঘোষণা করেন, হানিফের মতো নিম্নমানের জুতাপরা লোকের পাশে বসে তিনি কাজ করিবেন না। অফিসে যাহারা ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা পরেন, কেবল তাহাদের পাশে বসিয়া কাজ করিবেন, সে পিয়ন হোক আর বড় সাহেব। হানিফ সাহেবও জানাইয়া দেন, যাহারা বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা পরার মর্ম বুঝিতে পারঙ্গম, কেবল তাহাদের পাশে বসিয়াই তিনি কাজ করিবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসে একটা ভাগবাঁটোয়ারা হইয়া যায়, এক পক্ষে ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার কালা জুতা, অন্য দিকে বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতা।

কিছু লোক অবশ্য সমস্যায় পড়ে। যেমন আলমগীর সাহেব ফাটা কোম্পানীর আট নাম্বার বাদামী জুতা পরেন, তিনি কী করিবেন বুঝিতে পারেন না। মোস্তফা সাহেব পরেন বোম্বাই কোম্পানীর একান্ন নাম্বার কালা জুতা, তিনিও সমস্যায় পড়েন। এরকম আরো কয়েকজন আছেন, যাহারা কোম্পানী মিলাইতে পারিলেও সাইজ মিলাইতে পারেন না, সাইজ মিলাইতে পারিলে রঙ মিলাইতে পারেন না, আবার রঙ মিলাইলে কোম্পানী মিলাইতে পারেন না। তবে এই রকম কিছু এলোমেলো সংখ্যালঘুদের লইয়া ওহাব সাহেব আর হানিফ সাহেব মাথা ঘামান না, তাঁহারা দল ভারি করিয়া দুইজন দুই কোণায় পড়িয়া থাকেন।

অফিসে হয়তো শান্তি ফিরিয়া আসিতো, কিন্তু পরদিন ওহাব সাহেব তাঁর নতুন প্রতিবেশী জগলুল সাহেবের সহিত জুতা প্রসঙ্গে আলাপ করিতে করিতে আবারও উত্তেজিত হইয়া পড়েন। জগলুল সাহেব প্রথমে শান্তই ছিলেন, পরে তিনিও ক্ষেপিয়া ওঠেন। জগলুল সাহেবের পায়ে ফাটা কোম্পানীর সাত নাম্বার কালা জুতা। তবে আজকে ওহাব সাহেব তেমন একটা হইচই করেন না, শুধু জগলুল সাহেবের টেবিলে পড়িয়া থাকা নতুন স্ট্যাপলারখানি নিজের জিম্মায় লইয়া আসেন। ওদিকে হানিফ সাহেবও জনৈক অভাগা ইয়াকুবের পায়ে বোম্বাই কোম্পানীর একচল্লিশ নাম্বার বাদামী জুতায় আটটা ফুটা খুঁজিয়া পাইয়া ক্ষেপিয়া ওঠেন।

ভালো জুতায় ফুটা থাকে বারোটা, আটটা ফুটা লইয়া জুতা পরার শখ কেন? বেচারা ইয়াকুবের নতুন বলপয়েন্ট পেনখানি তিনি আনমনে নিজের পকেটে গোঁজেন। এমনি করিয়া রোজ রোজ চলিতে থাকে। জুতানিরপেক্ষ কুদ্দুস সাহেব এবং আরো কয়েকজন বোঝানোর চেষ্টা করেন সবাইকে, কিন্তু লাভ হয় না। জুতানিরপেক্ষতা আবার কী? এইসব আজেবাজে কথা শুনিতে কেহ রাজি নহে। বড় সাহেব অফিসের এইসব গণ্ডগোলে ভারি অসহায় বোধ করেন।

কী বলিবেন ইহাদের, কী বুঝাইবেন? বুঝাইতে গেলে ইহারা সকলে মিলিয়া তাঁহার উপর চড়াও হইবে, কারণ তিনি জুতাই পরেন না। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চড়িয়া অফিসে আসেন, পাতলা একজোড়া চপ্পল পরিয়া থাকেন সর্বদা। নেট থেকে সংগৃহিত । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.