১৭ আগস্ট শনিবার সকালে এই লেখা লিখবার সময় আমি যে শিরোনাম ব্যবহার করছি, সেই একই স্লোগান তার আগের দিন শুক্রবারজুড়ে মিসরের সব সরকারি, বেসরকারি ও স্বাধীন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হচ্ছিল। ওই শুক্রবারটি ছিল মিসরের মহান বিপ্লবের ইতিহাসের সবচেয়ে সহিংস, ভীতিকর এবং উদ্বেগের দিন। এবং সন্ত্রাসীরা এমন পরিকল্পনা করেছিল, যাতে করে হোসনি মোবারকের পতনের দিন অর্থাৎ ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারির ‘ক্রোধের দিবসের’ সমান মাত্রার ষড়যন্ত্র, জ্বালানো-পোড়ানো এবং রক্তপাত ঘটানো যায়।
শনিবার সকালে এই লেখাটি লিখবার জন্য আমি যাচ্ছিলাম আমার আল-আহরাম পত্রিকার অফিসে, আমি গাড়িচালককে ‘আল নাসর’ সড়কে যেতে বললাম। এই রাস্তাটিই মিসরের রাজধানী কায়রোর অন্যতম জনবহুল এলাকা নাসর সিটির ভেতর দিয়ে গিয়েছে।
এলাকাটি প্রাণবন্ত ও সজীব এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে ঘটানো সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোর জন্য বিখ্যাত। আমাদের গাড়ি বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে রাবাআ আল-আদাবিয়া এলাকার মধ্য দিয়ে গেল; কিছু সামরিক এলাকা, তারপরে অজানা এক সৈনিকের সমাধি, তারপর মরহুম প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সমাধিক্ষেত্র এবং তারপর সামরিক কুচকাওয়াজের মঞ্চ। ১৯৮১ সালে এখানেই আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করেছিল একদল ইসলামি চরমপন্থী। গাড়িটি সড়কটি দিয়ে চলছিল। পেরিয়ে যাচ্ছিলাম আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় দপ্তর এবং কায়রো ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার ও অক্টোবর সেতু।
সেতুটি আমরা পুরোপুরি পার হতে পারলাম না। ট্রাফিক পুলিশ সেতুটির মাঝামাঝি, একেবারে রামসেস চত্বরের মাথার ওপর চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।
কয়েক ঘণ্টা আগেই এ জায়গাটি ভয়াবহ গোলাগুলি ও সহিংসতার সাক্ষী হয়েছে। একদিকে ছিল পুলিশ ও এলাকাবাসী এবং অন্যপক্ষে ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসীরা। এই সন্ত্রাসীদের অবশিষ্ট অংশ রামসেস চত্বরের কেন্দ্রে অবস্থিত ফতেহ মসজিদের পাশে অবস্থান ধর্মঘট চালাচ্ছিল।
তখনো তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছিল, যাতে তারা নিরাপদে মসজিদটি ছেড়ে চলে যায়। রামসেস চত্বর আর ফতেহ মসজিদের খুব কাছে অবস্থিত আমার আল আহরাম পত্রিকার কার্যালয়ে বসে যখন লেখাটি লিখছি, তখনো উভয় পক্ষের দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
শুক্রবারের ছুটির দিনে অফিসে আসতে গিয়ে দেখা এই দৃশ্য একই সঙ্গে বিপজ্জনক ও অচেনা। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই সেনা-সমর্থিত পূর্ণ মাত্রার জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে মুরসি সরকার উৎখাতের পরের মিসরের ছবিটি পাঠকদের মনে পুরো ফুটিয়ে তুলতে আমাকে আরও কিছু দৃশ্যের কথা বলতে হবে। মিসর এখন যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা হলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
এই পরিস্থিতি বোঝাতে আমাকে আরও বিশদ করে বলতে হবে।
আমার নাসর সিটির বাসা থেকে গাড়ি করে অক্টোবর সেতুর ওপর দিয়ে রামসেস চত্বরের পাশ দিয়ে আল আহরাম অফিসে আসার রাস্তাটি ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। নিরাপত্তা ও অন্তর্ঘাতের দৃশ্যগুলো কোনো সন্দেহ ছাড়াই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে এই এলাকাটিতে যুদ্ধ চলছিল এবং এখনো তা চলছে। মিসরীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে—তাদের সব প্রতিষ্ঠান ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে—একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরতান্ত্রিক ধর্মীয় ব্যবস্থার লড়াই চলছে, যারা যেকোনো মূূল্যে ক্ষমতা হস্তগত করতে চায়। এর জন্য যত বৈষয়িক ও আত্মিক মূল্যই তাদের দিতে হোক না কেন, তারা লড়ে যাবে।
রাবা চত্বরে পৌঁছানোর আগে গাড়ির গতি ধীর হয়ে গেল সেনাবাহিনীর চেক পয়েন্টে কঠিন তল্লাশি চলতে থাকার জন্য। এই এলাকাটি যার সাক্ষী হয়ে আছে তাকে বলা যায় ‘সব যুদ্ধের জননী’। এখানেই সন্ত্রাসীদের অবস্থান ধর্মঘট ভাঙতে নিরাপত্তা বাহিনীকে চেষ্টা চালাতে হয়। আর এর মোকাবিলায় প্রতিবাদকারীরা সশস্ত্র কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ যাতে সারা মিসরে ছড়িয়ে যেতে না পারে তার জন্য ওই দিন সন্ধ্যায়ই দেশজুড়ে এক মাসের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
চেক পয়েন্টগুলো হলো দেশজোড়া এক বিরাট নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ।
খোলা চোখে দেখলে, রাবা মসজিদ অজস্র ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের মধ্যে পড়ে আছে। তাঁবু, বিছানাপত্তর, ময়লা, নোংরা এবং পোড়া গাড়ি ছড়িয়ে আছে এলাকাটি জুড়ে। কিন্তু একই সঙ্গে কায়রোর বিখ্যাত মসজিদটির মিনার বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের কবলে পড়ে করুণ দশা পেয়েছে। এর চারপাশের এলাকা তথা হাসপাতাল, অতিথিশালা এবং ছাত্রাবাস থেকে পুলিশের থানা ও সামরিক ভবনগুলোও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি।
এমনকি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোও ৪০ দিন ধরে চলা প্রতিবাদের প্রভাব এবং তা বন্ধ করায় চালানো যুদ্ধ অভিযান থেকে রক্ষা পায়নি।
প্রতিবাদ সমাবেশ চলার পুরো ৪০ দিন ধরেই আমি পার্শ্ববর্তী রাবা চত্বর এড়িয়ে চলেছি, যদিও জায়গাটির খুব কাছেই আমি থাকি। এমনকি একজন সাংবাদিক হিসেবে অথবা উৎসুক হিসেবেও আমি কখনো এখানে আসতাম না, যেমন যেতাম না তাদের আরেকটি জমায়েতের স্থান কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী নাহদা চত্বরেও। অবস্থান ধর্মঘট ভেঙে দেওয়ার পরপরই আমি রাবা এলাকায় যাই। আমি নিজের চোখে দেখি কায়রো প্রশাসন এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহযোগী নির্মাণ সংস্থাগুলো কী বিপুল মাত্রায় কাজে নেমে পড়েছে।
সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সমস্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা মসজিদ ও এর চারপাশের এলাকার যা কিছু মেরামত করা সম্ভব, তা তারা মেরামত করছে; যা কিছু রক্ষা করা যায় তা রক্ষা করছে; যা কিছু পরিষ্কার করা যায় তা পরিষ্কার করছে।
আর এসব করা হচ্ছে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে; তারা নিজেরাই মসজিদটি পুনঃস্থাপন করায় আগ্রহ দেখিয়েছে, যেমন তারা মিসরজুড়ে সন্ত্রাসীদের হাতে পোড়ানো বা ধ্বংস হওয়া সব গির্জা মেরামত বা পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছে।
বলা দরকার, মুসলিম ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসীদের হাতে যাওয়ার আগে এই রাবা চত্বরই হয়ে উঠেছিল বিতাড়িত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে লাখো মানুষের বিক্ষোভ এবং অদূরের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে গণমিছিলের যাত্রাবিন্দু।
প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে এ রকম এক মিছিলে অংশ নেওয়ার কথা আমার মনে পড়ছে; সেখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিংবা বিক্ষোভকারীদের ভেতর থেকে আসেনি কোনো অন্তর্ঘাতমূলক পদক্ষেপ।
কিন্তু পরে এই জায়গাটি দখল করেই সন্ত্রাসীরা তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ চালায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি এ ব্যাপারেই আমি লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল: মিসর বিপ্লব অথবা নৈরাজ্য। সেই লেখাতেই এক মিসরীয় নাগরিকের ওপর বর্বর আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছিল মুরসির নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা। সেই ঘটনাটি সব টেলিভিশন চ্যানেলেই দেখানো হয়েছিল।
আমি ও আমার স্ত্রী রাবা চত্বরের মসজিদ থেকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে যাত্রা করা সেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম।
আমরা চাইছিলাম প্রেসিডেন্ট মুরসির পদত্যাগ। এবং সেদিন হামাদা সাবের নামের ওই মানুষটির ওপর যা করা হয়েছিল, তা আমাদের বিরুদ্ধেও ঘটতে পারত।
এখন ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারির মহান বিপ্লবের পর এবং তার পরের শুদ্ধিকরণের পথে মিসরের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বর্তমান যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? সম্ভাব্য চিত্রটি কী হতে পারে তা নিয়ে এই লেখাটি লিখবার সময়ই আমি আমার সহকর্মী মাহের মাকলেদের সঙ্গে আল আহরাম পত্রিকার পোর্টালে বিশ্লেষণ করেছি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: মিসরীয় রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কোনো সন্তোষজনক সমাপ্তি চোখে পড়ছে না। এই যুদ্ধটি এখন প্রতিহিংসার দিকে গড়িয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদী মুসলিম ব্রাদারহুড খোলাখুলি প্রথমবারের মতো অস্ত্র বহন করা শুরু করেছে।
কিন্তু ওই লেখার লেখক বলেছেন: মিসরীয় রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের একটি ভালো দিক হলো, এখানে নাগরিকেরা পাশাপাশি বসবাস করছেন কোনো রকম বিচ্ছিন্নতা ছাড়াই। মিসরীয় সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জাতিগত বৈষম্যকরণ নেই। এর অর্থ হচ্ছে, মিসরের কোনো নগর বা অঞ্চল জনগণের কোনো একটি অংশের পুরোপুরি পক্ষে চলে যায়নি বা কোনো অঞ্চল ধর্মীয়, ভাষাগত বা অঞ্চলগতভাবে বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে যায়নি। রাবা ও নাহদা চত্বরে বিক্ষোভ চালানোর সময় সন্ত্রাসবাদী মুসলিম ব্রাদারহুড সংগঠন চেষ্টা করেছে তাদের ওই দুটি এলাকাকে অন্য সব অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।
মাকলেদ বিশ্বাস করেন যে মিসরের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কিছু সময়জুড়ে চলতে পারে। তবে তা নির্ভর করবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জনগণ ও সমর্থকদের জয় করা এবং রাষ্ট্রের তরফে আইন প্রয়োগ করার সামর্থ্যের ওপর।
তিনি দেখিয়েছেন যে সন্ত্রাসীরা পরাজিত হয়েছে এবং পরাজিত হতেই থাকবে। বিশেষত ক্রমবর্ধমান হারে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ওপর সহিংসতার ঘটনায় তারা মিসরের বিভিন্ন গোষ্ঠী, সমাজের সমর্থন হারিয়ে ফেলছে। মাকলেদ মনে করেন, এই লড়াইয়ে উভয় পক্ষই যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরও এমন কোনো বিন্দুতে পৌঁছাবে না, যেখানে আলোচনার টেবিলে বসা যায়।
অথচ মিসরের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান, ভবন এবং প্রার্থনাগৃহ এর মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিনি মনে করেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চরম আঘাত করা যেতে পারে দলটির অবশিষ্ট নেতাদের গ্রেপ্তার ও তদন্ত করে বিচারের মাধ্যমে তাদের কৃতকর্মকে গোটা দুনিয়ার সামনে পরিষ্কার করার মাধ্যমে। এর মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী শক্তিগুলোর ভুল-বোঝাবুঝিও দূর করা যাবে এবং মিসরের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তাদের চাপাচাপিরও অবসান ঘটবে।
লেখাটি প্রথম আলোর জন্য বিশেষভাবে প্রেরিত
কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।