ব্রিটেনের ডোনেশন হটলাইন: আর কতোদিন?
ফারুক যোশী
××××××××××××××××××××××××××××××
ব্রিটেনের বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে চলছে এখন ওয়াজের মাহফিল। অন্য অর্থে যেন চাঁদা তোলার মহোৎসব। অদ্ভুত এক সংস্কৃতি, ব্রিটেনের বাঙালিদের ইসলাম। আলখেল্লা পরে কাঠমোল্লারা হাজির হয় টিভির পর্দায়। বিলেতের ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসার নাম নিয়ে চলে ১২ ঘণ্টার লাগাতার ‘ডোনেশনবাজি’ (অন্য অর্থে চাঁদাবাজি)।
রমজান মাস মুসলমানদের জন্য পবিত্র মাস। ধর্মীয় বিবেচনায় এ মাসের তাৎপর্যটাই আলাদা। বিশাল-ব্যাপক। এ মাসে ডোনেশন দিলে পরকালে বহুগুণে পাওয়া যাবে। জিন্দা-মুর্দার কল্যাণ হবে।
এক দিলে সত্তর গুণ আসবে। এ-তো ধর্মের কথা। টিভি পর্দায় প্রতিরাতের শব্দ এগুলো। আর ঐ ধর্মের কথাগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার হয় এই বিলেতের বাংলা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানি টিভি চ্যানেলগুলোর অবস্থাও এখানে তথৈবচ।
বিলেতে আছে পাঁচটি বাংলা টিভি চ্যানেল। বাংলা টিভি, চ্যানেল এস, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, এনটিভি। পাঁচটি টিভি চ্যানেলই ব্রিটেনের বাংলাভাষিরা ফ্রি দেখে থাকেন। এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, এনটিভিতে দর্শকরা বাংলাদেশের প্রতিদিনের বিনোদন উপভোগ করে। কিন্তু রমজানে সব চিত্রই পাল্টে যায়।
দোষ দেয়ার কিছুই নেই। ব্যবসায়িক হিসাব অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ ঐ চ্যানেলগুলো ১১ মাস অপেক্ষায় থাকে ঐ একটি মাসের। শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা নয়। চ্যারিটি নামের দোকানদাররা ঐ মাসে পসরা সাজায়।
কেউ চক্ষু হাসপাতাল, কেউ শিশুদের বস্তি থেকে তুলে আনা, কেউ শিশুদের হাফিজ বানানো, কেউ গরু-খাসির মাংস বণ্টন, এরকম অসংখ্য বাহারী কথার ফুলঝুরি, সঙ্গে কিছু ভিডিও ফুটেজ, ব্যস হয়ে গেলো- মসজিদ-মাদ্রাসা আর আল্লার ওয়াস্তে দান করার কি আকুল আবেদন। আর তা করতে গিয়ে আধুনিক গবেষণা পর্যন্ত চলছে এসব কার্যক্রমে। সেজন্যে শুধু যে বাংলাদেশ থেকে আসা অর্ধশিক্ষিত মোল্লারাই এ ডোনেশন তুলছেন তাই নয়, এখানে আছেন ব্রিটেনের শিক্ষায় একাডেমিক শিক্ষিত কিছু তরুণও। তাইতো দেখা যায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে যেমন চাঁদা তোলার ধুম পড়ে অর্থাৎ একজনের চাঁদা দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নারায়ে তাকবির শব্দে মাহফিল প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি একটি আধুনিক দেশের টিভি চ্যানেলগুলোও গমগম করে এরকম শব্দেই। মসজিদের মুসল্লা-ইট-পাথর-সুড়কি-গম্বুজ-টয়লেট প্রভৃতি নির্মাণে এক একটি চাঁদার পরিমাণ ঘুরতে থাকে টিভি পর্দার স্ক্রলে এবং লাইভ কল আসে একের পর এক।
প্রেজেন্টার পাউন্ডের প্রত্যয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদা প্রদানকারীকে একটা ম্যাসেজের জন্য বলেন। চাঁদা প্রদানকারী তার পূর্বপুরষের শান্তি কামনা করে পরকালের মুক্তির জন্য দোয়া করতে বলেন- তারা যেন পেয়ে যান অনন্ত শান্তির রাস্তা। তারপর প্রেজেন্টার বলে দেন দয়া করে ডোনেশন হটলাইনে ফোন করে চাঁদা প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে। পরকালের চমৎকার বার্তা যেমন মসজিদের একটা মুসল্লার জন্য ১০০ পাউন্ড দিলে সেই কিয়ামতের দিন সরাসরি বেহেস্তÑ সেখানে আপনি পাবেন নির্মল বাতাস আর সুবাসিত জায়গায় বসার এক অসাধারণ আবাস। মোহে আটকে থাকা ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষগুলোর দানের প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আলখেল্লা পরা একজন লোককে কেন্দ্র করে বসা আরো কয়েকজন (প্যানেল) শুধু মারহাবা-মাশাল্লা বলে চিৎকার করে ওঠে।
আর এভাবেই পুরুষ বিশেষত নারী আর শিশুদের তারা উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়, চলে মধ্যরাত থেকে সেহরি পর্যন্ত। যদি ত্রিশটা রোজা হয় তাহলে পাঁচটা টিভি চ্যানেলে এবার ১৫০টি ফান্ড রেইজিং আপিল হবে। এই দেড়শটি আপিল থেকে টিভি চ্যানেলগুলো উপার্জন করবে এক মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি । আর চ্যারিটি নামের সংগঠনগুলো উপার্জন করবে কতো? তার অবশ্য হিসাব কেউ কোনোদিন দিতে পারবে না।
কারণ এই সংগঠনগুলোর খুব কম সংখ্যক মসজিদ-মাদ্রাসারই সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। গত ক’বছরে দেখা গেছে অনেক আপিলে এমনকি কোনো চ্যারিটি সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন নম্বর না দেখিয়েই তোলা হয়েছে চাঁদা। অর্থাৎ দেশ থেকে এসে অর্থ তোলা হয়েছে। এ অর্থ কোথায় গেছে, তার কোনো হদিস নেই আজো। গত বছর ইতালিভিত্তিক একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে উঠেছে প্রায় লাখ লাখ পাউন্ড।
কিন্তু এ টাকা সমজিদ নির্মাণের কাজে লাগেনি বলে ব্রিটেনভিত্তিক কাগজে বেরিয়েছিল। আজিজিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট সংগঠনের নামে ‘হেল্প, সেইভ দ্য রোম মস্ক’ নিয়ে এই ফান্ড রেইজিং আপিলে পেয়েছে তারা কয়েকশ হাজার পাউন্ড। কিন্তু অর্থের সদ্ব্যবহার দেখেনি কেউ। উপরন্তু ইতালির ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি অভিযোগ করেছে এ সংগঠনটি মূলত বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদেরই সহায়তা করছে। ইদানীং খবর বেরিয়েছে ইতালি প্রবাসী এক বাংলাদেশীর জঙ্গি কানেকশনের কথা।
খবর বেরিয়েছে তিনি সম্প্রতি আরো তিনজন বিদেশী নিয়ে জামায়াতের আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের উত্তরার বাসায় গোপন বৈঠক করেছেন, বাংলাদেশে নাশকতমুলক কার্যকলাপ চালাতে। এটি বাংলাদেশে খবর হয়ে যাওয়ায় তিনি পালিয়ে ব্রিটেনে চলে এসেছেন। এর আগে খবর হয়েছিলেন ম্যানচেষ্টারের মোস্তফা। আন্তর্জাতিকভাবে জঙ্গি কানেকশনের সঙ্গে তার নাম ছড়িয়েছিল। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই হিসাব মেলাতে কারও বেগ পেতে হয় না।
আসলেই অর্থগুলো যাচ্ছে কোথায়? এভাবেই খবর হয়েছে আরো কয়েকটি চাঁদাবাজ সংগঠনের। এরা কখনো কোরবানির মাংস গরিবদের বিতরণ করা এবং দুর্গতদের সহায়তার নাম নিয়ে অর্থ তোলে। খবর নিয়ে জানা গেছে, বিশেষত দেশের বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য চাঁদা আদায়ের ন্যূনতম অংশেরও সদ্ব্যবহার হয় না। শুধুমাত্র ভিডিও ফুটেজ তৈরির জন্য দুএকটা কাজ করে পরের বছরের পুঁজি বানিয়ে আনে তারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন কাগজসহ ব্রিটেনের দু’একটা কাগজেও এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এসব কিছু মিলিয়ে দেখা গেছে, প্রতি বছর সংগৃহীত অর্থের সিংহভাগই চলে যায় ডোনেশনবাজদের পকেটে কিংবা সংগঠনের নিজস্ব মতবাদ-কার্যক্রম পরিচালনায়। শুধুমাত্র ব্রিটেনের মাত্র কয়েকটি মসজিদ-মাদ্রাসার হিসাবের স্বচ্ছতা আছে বলে জানা গেছে। কারণ এগুলোর নির্বাহী কমিটিসহ ন্যূনতম জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে, তাই। তাছাড়া এ অর্থগুলো সঠিক খাতে ব্যয় করার অন্য কারণ হলো স্থানীয় বাসিন্দারাই মূলত ঐ অর্থগুলো দিয়ে থাকেন। অনেক চ্যারিটি সংগঠন আছে, যা নিজের পরিবারের কিছু মানুষের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া।
এর মাঝে কিছু সংগঠন এমনকি ব্যক্তির নিজের নামে পর্যন্ত রেজিস্ট্রি করে নেয়া। সুতরাং এগুলোর হিসাব পাওয়ার প্রশ্নটাই অবান্তর। কিন্তু যেহেতু প্রত্যেকেই টিভিতে লাইভ এসে আল্লাহ আর পরকালের সওয়াবের কথা বলেন, তখন অনেকেই বিশেষত মহিলাদের বেনিফিটের (সরকার থেকে পাওয়া) অর্থের একটা অংশ এরা খসিয়ে নিতে পারেন অবলীলায়।
আর সেজন্যই গত চার-পাঁচটি বছর ধরে এ ব্যবসাটা চলছে জমজমাট। কিন্তু এবারে ব্যবসা ভালো যাবে না, এটা ভেবে চ্যারিটি আপিল এবং অর্থ সংগ্রহ নিয়ে গবেষণা করা চ্যানেলটি আর বাংলাদেশের কোনো মসজিদ-মাদ্রাসার নামে এ বছর অর্থ তুলছে না।
তারা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। যেহেতু এটা ধর্মীয় একটা স্পর্শকাতর ইস্যু, তাই এ নিয়ে অনেকেই ঘাঁটাঘাঁটি করার ধৃষ্টতা হয়তো করে না। কিন্তু এরপরও মাঝে মাঝে লেখালেখি হয়। আর এ সুবাদেই হয়তো ধূর্ত চ্যারিটিওয়ালাদের কপাল কিছুটা হলেও পুড়েছে। এবারের অর্থের গতি মন্দা।
চ্যারিটি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, বিশ্ব মন্দা এর জন্য দায়ী। কিন্তু মোটেই তা নয়। এবারে একটা প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমন কোনো রাত নেই, যে রাতে বেরসিক কলারদের কল সহ্য করতে হচ্ছে না তাদের। চ্যারিটিওয়ালাদের চোর-বাটপার-আত্মসাতকারী হিসেবে এখন উচ্চারিত সত্য, চ্যারিটি নিয়ে নানা প্রশ্ন করছে কিছু ‘বেআদব’ মানুষ, তাও টিভিতে লাইভ।
এমনকি দেশ থেকে আসা হুজুরদের ভণ্ড বলা, প্রেজেন্টার কিংবা প্যানেলের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর অসংখ্য প্রশ্নে বড় বিব্রত থাকেন, তারা শংকিত থাকেন কখন কী প্রশ্ন তাদের আক্রমণ করে। এরকম প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দেয়া হয় এবং প্রেজেন্টাররাও আল্লার দরবারে এই কলারদের শুধু হেদায়েত কামনা ছাড়া আর কি-ই করতে পারেন।
সম্প্রতি ব্রিটেন সফরে এসেছিলেন স্থানীয় সরকারের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ। তিনি বলেছিলেন, তার সরকার মনিটর করবে এসব অর্থ জঙ্গি খাতে ব্যয় হবে কিনা, খতিয়ে দেখবেন তারা। সরকারের কাজ সরকার করবে।
কিন্তু ব্রিটেনের সাধারণ মানুষের অর্থগুলো নিয়ে যারা ঠকাচ্ছে, তাদের অন্তত ব্রিটেনের ঐ বাঙালিদের চিনে নেয়া উচিত। চাঁদাবাজদের শনাক্ত করলেই আমরা মুক্তি পেতে পারি। এবং বন্ধ হতে পারে একটি আজগুবি সংস্কৃতির। রোজার পবিত্র মাসের পবিত্রতা রক্ষায় এসব ব্যবসা বন্ধ হওয়া বড় বেশি প্রয়োজন।
ভোরের কাগজ ** ২৯ আগস্ট ২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।