মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই যুদ্ধাপরাধীর জীবনযাপনে, বিশেষ করে তাঁদের সামাজিক জীবনে আজ থেকে কী পরিবর্তন আসবে, সেটা জানতে আমাদের আগ্রহ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের কাছ থেকে আমরা বিবৃতি দাবি করি। চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের দ্বৈত পাসপোর্ট রয়েছে।
১৯৮৯ সালে সালমান রুশদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কাছে যেতে দেখি। ২০০৩ সালে প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎরত আলোকচিত্র আমরা দেখি।
তিনি তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক। এবার তাঁর কী হবে? তাঁর ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান ডেইলি মেইলকে বলেছিলেন, ‘ব্রিটেন প্রত্যর্পণের অনুরোধ রাখবে না। কারণ, বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। ৬৪ বছর বয়সী মুঈনুদ্দীন মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশনের পরিচালক এবং একটি মাল্টি ফেইথ গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশন নামের প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের একটি প্রকল্প।
ওই প্রকল্পটি ব্রিটিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের কারণে তাঁর প্রত্যর্পণ কঠিন হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কারও প্রত্যর্পণে প্রতিটি দেশের একটি কর্তব্য আছে। ’ এই কর্তব্য সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে চাই। ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও তার নীতি-নৈতিকতার নিক্তিতে ওজন দেওয়া অবস্থানের আলোকে আমরা জানতে চাই ব্রিটিশ সরকার এখন কী বলবে।
হাউস অব কমন্স এখন কী বলবে? তার বিচার বিভাগ কী বলবে?
প্রয়োজনে আদালতের সামনে প্রশ্নটি নিতে হবে। সেই যোগ্যতার পরিচয় সরকারকেই দিতে হবে। ভারত দীর্ঘ কাল বৃথা অভিযোগ করেছে পাঞ্জাবি ও কাশ্মীরি জিহাদিদের অভয়ারণ্য ব্রিটেন। বরফ গলে ১৯৮৪ সালে বার্মিংহামে এক ভারতীয় কূটনীতিককে হত্যার পরে। ১৯৯৩ সালে প্রত্যর্পণ চুক্তি হলো।
এর আওতায় প্রথম দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগী টাইগার হানিফকে ভারত পেল গত বছর। সুরাটের পুলিশ বিভাগ ব্রিটিশ আদালতকে নথিপত্র দিতে পেরেছিল বলেই ওই প্রত্যর্পণ সম্ভব হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ দি ইনডিপেন্ডেন্ট-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রত্যর্পণের অনুরোধকারী রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে, অভিযুক্তকে তারা বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা বা রাজনৈতিক মতামতের কারণে বিচার করতে চাইছে না। মুঈনুদ্দীনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেরেমি হান্ট।
কনজারভেটিভ দলীয় রাজনীতিক। ব্রিটিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘মুঈনুদ্দীন সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ বা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের চাকরি করেন না। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পদত্যাগ করেন। ’ ডেইলি মেইল গত ১৪ এপ্রিল মুঈনুদ্দীনের স্বেচ্ছা-পদত্যাগের তথ্য দিল। ১৯ জুনের বিবিসি রিপোর্টে তাঁকে চ্যারিটি মুসলিম এইডের একজন ট্রাস্টি হিসেবে বলা হলো।
সেখানে তাঁর পদত্যাগসংক্রান্ত তথ্য ছিল না। রায়ের পরে বিবিসি মুঈনুদ্দীনকে ‘মুসলিম নেতা’ বলেছে। মিডিয়া নয়, এখন ব্রিটিশ হাইকমিশনই মানবাধিকারের স্বার্থে আমাদের কাছে মুঈনুদ্দীনের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারে।
এডওয়ার্ড স্নোডেন বিতর্কে বিশ্ব নতুন করে দেখেছে প্রত্যর্পণ যথেষ্ট জটিল বিষয়। ১২৫৯ সালে মিসর তার প্রতিবেশী হিত্তিতেসের সঙ্গে বিশ্বের প্রথম প্রত্যর্পণ চুক্তি করেছিল।
আন্তর্জাতিক প্রত্যর্পণ বিশেষজ্ঞ ম্যাকন্যাবের মতে, আন্তর্জাতিক প্রত্যর্পণ আইনে ‘রাজনৈতিক অপরাধকে’ ব্যতিক্রম বিবেচনা করা হয়। প্রত্যর্পণে রক্ষণশীলতা এখনো একটি বৈশ্বিক প্রবণতা। সোভিয়েত সংবিধান তার নাগরিকদের অন্য দেশে বিচারের জন্য পাঠানো নিষিদ্ধ করে রেখেছে। জার্মানিরও শক্তিশালী সাংবিধানিক রক্ষাকবচ আছে। যুক্তরাষ্ট্রে যৌন নিপীড়নের দায়ে ফেরার রোমান পলানস্কিকে ফরাসিরা মার্কিনদের হাতে তুলে দেয়নি।
তবে ব্রিটেন সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। তারা তাদের আইনে নাগরিকদের জন্য এ রকম সুরক্ষা দেয়নি।
প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচে আন্তর্জাতিক আইনের বরাতে সাধারণত দুটি দোহাই দেওয়া হয়। প্রথমত অনুরোধপ্রাপ্ত রাষ্ট্র বলতে পারে, যে অভিযোগে দণ্ড দেওয়া হয়েছে তা ‘রাজনৈতিক অপরাধ’। দ্বিতীয়ত, অনুরোধ লাভকারী রাষ্ট্র যদি বিশ্বাস করে যে, প্রত্যর্পণের অনুরোধের আসল কারণ হলো রাজনৈতিক, অপরাধ-সম্পর্কিত নয়।
১৮৭০ সালে প্রথম ব্রিটিশ প্রত্যর্পণ চুক্তিতে বলা ছিল, অপরাধের চরিত্র রাজনৈতিক হলে তাদের আত্মসমর্পণের দরকার নেই। ওই সময়টায় ইউরোপ থেকে বহু মানুষ পালাচ্ছিল। কার্ল মার্ক্সকেও তখন ব্রিটেন আশ্রয় দিতে চেয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ইউরোপীয় সন্ত্রাস দমন কনভেনশন অবশ্য ‘রাজনৈতিক অপরাধের’ ধারণাকে যথেষ্ট সীমিত করে দিয়েছে।
মুঈনুদ্দীন আজও পাকিস্তানি অখণ্ডতার সমর্থক।
এ বিষয়ে বিবিসি ও আল-জাজিরাকে অকপটে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। মওদুদী ও তাঁর জামায়াত-আলবদর কিন্তু রাজনৈতিক ভিন্নমত অর্থে অখণ্ডতাকে দেখেনি। মওদুদী অখণ্ডতায় ‘জিহাদে’র বিষ ঢালেন। ফতোয়া দিয়েছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বায়ত্তশাসন কুফরি। হিন্দুঘেঁষা।
ইসলামবিরোধী। সে কারণেই এর নিয়ামক বুদ্ধিজীবীরা ২৫ মার্চ থেকেই টার্গেট হলেন। এর অন্যতম ঘাতক হিসেবে দণ্ডিত মুঈনুদ্দীন আজ থেকে একজন ধিক্কৃত ফেরারি। তাঁর কৃতকর্মের দণ্ড দিতে ব্রিটেনের কি কিছুই করার নেই?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।